মার্চ মাস আমাদের স্বাধীনতার মাস। এ মাসেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মোহনী নেতৃত্বে অকুতোভয় ছাত্রজনতা পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, নিপীড়ন আর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বিশ্বের মানচিত্রে আমাদের জাতীয় পতাকা তথা স্বাধীনতার জন্য।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনে প্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়। এই পতাকা আমাদের স্বাধীনতার চেতনার প্রতীক। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর শোষণ, অন্যায়, অত্যাচার, অবিচারের বিরুদ্ধে তৎকালীন ডাকসু নেতাদের উদ্যোগে ২ মার্চ সাড়া দিয়েছিল আমজনতা। প্রকৃতপক্ষে সেদিনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি ছাত্রজনতা স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয় এবং স্বাধীনতা অর্জনের পথে যাত্রা শুরু করে।
পতাকা উত্তোলনই জানান দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের বিকল্প নেই। এই পতাকা উত্তোলন আমাদের ভূখণ্ড ছাড়িয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছে একটি শোষিত ও বঞ্চিত দেশের অধিকার এবং স্বাধিকার আদায়ের বিপ্লবের সূচনা বার্তা। দীর্ঘ ৯ মাসের বহু ত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। স্বাধীনতা সংগ্রামের ৯ মাস এ পতাকাই বিবেচিত হয় আমাদের জাতীয় পতাকা হিসেবে এবং বঙ্গবন্ধুর সাহসী ও দেশপ্রেমিক নেতৃত্বে আমরা অর্জন করি স্বাধীন মাতৃভূমি বাংলাদেশ। ১৯৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর শঙ্কিত হয়ে পড়েছিল পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী।
তারা নিশ্চিতভাবেই ধারণা করেছিল যে ছয় দফার বাস্তবায়ন এবার হয়েই যাবে। যেহেতু সংখ্যাগরিষ্ঠতা আওয়ামী লীগের। ৭১ এর ১২ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় এলেন। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার দুই দফা আলোচনা হলো। সর্বশেষ খবর দ্য ডেইলি স্টার বাংলার গুগল নিউজ চ্যানেলে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘আলোচনা সন্তোষজনক এবং প্রেসিডেন্ট খুব শিগগিরই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করতে সম্মত হয়েছেন।’ ইয়াহিয়া খানের বক্তব্যও ঠিক অনুরূপ ছিল।
তিনি বললেন, ‘শেখ মুজিব তার সঙ্গে যে কথা বলেছেন, যে আলোচনা তুলেছেন সেসব যৌক্তিক ও সঠিক।’ কিন্তু, ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে লারকানায় জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাসভবনে গিয়ে গোপন বৈঠকে মিলিত হলেন পাকিস্তান আর্মির জেনারেলদের সঙ্গে। ৭১-এর জানুয়ারির শেষ দিকে দলের অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঢাকায় এলেন। ঢাকায় বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যেই জাতীয় পরিষদের বৈঠকে ছয় দফার ওপর শাসনতন্ত্র তৈরির কথা বললেন। কিন্তু, ভুট্টো তখন আরও আলোচনার কথা বলেছিলেন।
ভুট্টো চান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন জানুয়ারি মাসের শেষ দিকে হোক। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করলেন। ১৫ ফেব্রুয়ারি, আওয়ামী লীগ তাদের ছয় দফার বিষয়ে আপস বা পরিবর্তন না করলে ভুট্টো অধিবেশনে যোগদানের বিরোধিতা করলেন। এরপর ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর মধ্যে আলোচনা হয়েছিল।
সেই আলোচনার পর ভুট্টো জানালেন তার দেয়া শর্ত না মানলে তিনি কোনোভাবেই অধিবেশনে যোগ দিতে পারবেন না । বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝে ফেললেন আসল কাহিনি। পাকিস্তানিরা নির্বাচনের ফল বানচাল করার জোরালো চেষ্টা করছে। তাই বঙ্গবন্ধুকেও কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়েছিল। অন্যদিকে, ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো মিলে আঁকলেন আরেক ছক। পহেলা মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করলেন ইয়াহিয়া।
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত হতেই মানুষ বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ ছাড়াই রাস্তায় নেমে বিক্ষোভ করল। তখন বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যরা হোটেল পূর্বাণীতে ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের কাজে। এরই মধ্যে বিক্ষোভ মিছিল পূর্বাণীর সামনে। বঙ্গবন্ধু শান্তিপূর্ণ আন্দোলন জোরদার করার পরামর্শ দিলেন। সঙ্গে ঘোষিত হলো ২ মার্চ থেকে ৩ মার্চ দুপুর ২টা পর্যন্ত হরতাল চলবে।
১৯৭১ সালের ২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে প্রথম সবুজ জমিনের লালবৃত্তে মানচিত্র খচিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল। দিনটি জাতীয় পতাকা উত্তোলন দিবস হিসেবে পালন করা হয়ে থাকে। ’৭১-এর মার্চ মাস ছিল আন্দোলনমুখর এবং উত্তাল। একদিকে নির্বাচনে জয়ী আওয়ামী লীগের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার গড়িমসি, অন্যদিকে বঙ্গবন্ধুর ডাকে দেশব্যাপী প্রতিরোধ-সংগ্রাম। পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার লড়াইয়ে এক নতুন মাত্রা সংযোজিত হয়েছিল ২ মার্চে।
একাত্তরের এদিনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় আয়োজিত এক ছাত্র সমাবেশে তৎকালীন ডাকসুর ভিপি আ স ম আবদুর রব সর্বপ্রথম জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন। স্বাধীনতার পর থেকে দিনটি জাতীয় পতাকা দিবস হিসেবে পালিত হয়েছে আসছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থিতিতে ৩ মার্চ পল্টন ময়দানে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের জনসভায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন মোহাম্মদ শাজাহান সিরাজ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্বপ্রথম নিজ হাতে ধানমন্ডিতে তার নিজ বাসভবনে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছিলেন ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ। বিদেশের মাটিতে সর্বপ্রথম অর্থাৎ ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করা হয়েছিল ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল। স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাটি প্রথমে ছিল সবুজ জমিনের ওপর লালবৃত্তের মাঝখানে সোনালি মানচিত্র খচিত। এ পতাকার নকশা করেছিলেন ছাত্রনেতা শিবনারায়ণ দাশ।
মুক্তিযুদ্ধের সময় এ পতাকাটি দেখা গেছে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। পরে ১৯৭২ সালে শিল্পী কামরুল হাসানকে জাতীয় পতাকাকে সার্বজনীন করে তোলার দায়িত্ব দেয়া হয়। তিনি পতাকাটিতে সংস্কার আনেন। শিবনারায়ণ দাশের আঁকা মানচিত্র-সংবলিত পতাকা থেকে মানচিত্র বাদ দিয়ে কামরুল হাসান যে পতাকাটির ডিজাইন করেন, সেটিই এখন আমাদের জাতীয় পতাকা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ২৩ বছর পর ১৯৭০ সালে।
সেই নির্বাচনের ফলাফল ছিল আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ছয়দফা কর্মসূচির প্রতি জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থন। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী আওয়ামী লীগেরই সরকার গঠনের কথা ছিল। ডিসেম্বরে নির্বাচন হওয়ায় জানুয়ারিতেই জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতে পারত, কিন্তু সরকার ও পিপলস পার্টি-মুসলিম লীগ ষড়যন্ত্র করে পিছিয়ে দেয়।
৩ মার্চ অধিবেশন আহ্বান করা হয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ তাতে আপত্তি করেনি, বরং অধিবেশনে যোগ দেয়ার জন্য প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু পশ্চিম পকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দিতে রাজি নয়। এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে ১ মার্চ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিতের ঘোষণার মাধ্যমে।
ইয়াহিয়া খানের এই ঘোষণা যখন রেডিওতে প্রচার করা হলো, তখন ঢাকা স্টেডিয়ামে পাকিস্তানের সঙ্গে কমনওয়েলথ একাদশের খেলা চলছিল। মুহূর্তেই জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। ঢাকা স্টেডিয়াম হয়ে ওঠে এক যুদ্ধক্ষেত্র। বন্ধ হয়ে যায় স্কুল-কলেজ, অফিস-আদালত, দোকানপাট সব কিছু। রাস্তায় নেমে আসে লাখ লাখ মুক্তিকামী জনতা।
দেখতে দেখতে পুরো শহর পরিণত হয় একটি মিছিলের নগরীতে। মিছিলে অংশ নেয়া মানুষের মুখে তখন স্বাধীনতার স্লোগান: ‘জয় বাংলা’, ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ আওয়ামী লীগকে সরকার গঠনের আহ্বান জানাতে পাকিস্তানি সামরিক সরকারের টালবাহানায় পরিস্থিতি ছিল উত্তপ্ত, এ অবস্থায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার ৪৮ ঘণ্টা আগে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করায় বাংলার মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। গণতান্ত্রিক পন্থায় প্রতিবাদ হিসেবে বঙ্গবন্ধু ২ মার্চ ঢাকায় বেলা ২টা পর্যন্ত এবং ৩ মার্চ সারা দেশে পূর্ণ দিবস হরতাল আহ্বান করেন।
অন্যান্য প্রগতিশীল রাজনৈতিক ছাত্র-শ্রমিক সংগঠন হরতালে সমর্থন দেয়। অধিবেশন বসার তারিখ ৩ মার্চ ‘জাতীয় শোক দিবস’ ঘোষণা করা হয়। সেদিন ছাত্রলীগ আয়োজিত পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন এবং বলেন, ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে পরবর্তী কর্মসূচির ঘোষণা দেবেন। একাত্তরের ২ মার্চ বিভিন্ন পত্রিকা ও বার্তা সংস্থার কাছে পাঠানো বঙ্গবন্ধু স্বাক্ষরিত প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় ৩ মার্চ থেকে ৬ মার্চ পর্যন্ত সারা দেশে ৬টা থেকে ২টা পর্যন্ত হরতাল পালিত হবে।
সরকারি অফিস, সচিবালয়, হাইকোর্ট, স্বায়ত্তশাসিত করপোরেশন, পিআইএ, রেলওয়ে, সড়ক ও নৌযান, মিল-কারখানা, বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান, হাটবাজার প্রভৃতি বন্ধ থাকবে। শুধু চালু থাকবে অ্যাম্বুলেন্স, সংবাদপত্রের গাড়ি, হাসপাতাল, ওষুধের দোকান, বিদ্যুৎ ও ওয়াসার কর্মীদের গাড়ি। অর্থাৎ শান্তিপূর্ণভাবে সরকারের সঙ্গে অসহযোগিতার ডাক দেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচিত নেতা বঙ্গবন্ধুর ডাকে যে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়, তা কোনো একক দলের আন্দোলন ছিল না। তা ছিল দল-মত নির্বিশেষে সর্বাত্মক জনযুদ্ধের প্রস্তুতি।
মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামী এবং নেজামে ইসলামের মতো গণবিচ্ছিন্ন ও পাকিস্তানবাদী দল ছাড়া সব রাজনৈতিক দল ট্রেড ইউনিয়ন ও শ্রেণি-পেশার মানুষ তাতে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ছাত্রজনতার প্রতিরোধ সংগ্রামে একাত্তরের ২ মার্চ আলাদা গুরুত্ব বহন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে তৎকালীন ডাকসু নেতাদের উদ্যোগে সেদিনের পতাকা উত্তোলনের মধ্য দিয়েই বাঙালি ছাত্রজনতা স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিমন্ত্রে উজ্জীবিত হয় এবং স্বাধীনতা অর্জনের পথে যাত্রা শুরু করে। পতাকা উত্তোলনই আমজনতাকে জানিয়ে দেয় স্বাধীন বাংলাদেশের বিকল্প নেই।
একই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন অসহযোগ আন্দোলনের কর্মসূচি। অচল হয়ে যায় দেশ, কার্যত পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ বঙ্গবন্ধুর হাতে চলে আসে। আমাদের মুক্তি সংগ্রামের পটভূমি তৈরিতে এ অসহযোগ আন্দোলন পালন করে এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা যা পরবর্তীতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অকুতোভয় নেতৃত্ব এনে দেয় আমাদের কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা। আমরা পাই স্বাধীন ভূখণ্ড বাংলাদেশ।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ