ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইনি দুর্বলতায় চিকিৎসায় অবহেলা বাড়ছে

প্রকাশনার সময়: ০১ মার্চ ২০২৪, ০৭:৫২

চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যু বা অন্য কোনো ধরনের ক্ষতির অভিযোগ আমাদের দেশে নতুন নয়। সম্প্রতি সুন্নতে খতনা করাতে গিয়ে আবারও একটি শিশুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। ইউনাইটেড হাসপাতালের ঘটনারই যেন পুনরাবৃত্তি হলো মালিবাগের একটি মেডিকেল সেন্টারে। অ্যানেস্থেসিয়া বা চেতনানাশক ওষুধ দেয়ার পর আর ঘুম ভাঙেনি মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের চতুর্থ শ্রেণির এক ছাত্রের।

শিশুটিকে সুন্নতে খতনা করাতে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাত ৮টার দিকে ভর্তি করা হয় মালিবাগের একটি মেডিকেল সেন্টারে এবং ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করা হয়। ঘটনার পরপরই অভিযুক্ত দুইজন চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। স্বজনদের অভিযোগ, সাধারণ চেতনানাশক দেয়ার কথা থাকলেও শিশুটিকে পূর্ণ চেতনানাশক দেয়া হয় এবং পরে তার আর জ্ঞান ফেরেনি। শিশুটির পিতার অভিযোগ, চিকিৎসককে বারবার চেতনানাশক দিতে নিষেধ করার পরও সেটি শরীরে পুশ করেন এবং এ মৃত্যুর দায় সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকসহ হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ সবার।

এর আগে গত ৩১ ডিসেম্বর সুন্নতে খতনার জন্য আয়হাম নামের একটি শিশুকে বাড্ডার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল ৯টার দিকে শিশুটিকে চেতনানাশক ওষুধ দেয়া হয়। পরে জ্ঞান না ফেরায় তাকে গুলশানে ইউনাইটেড হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানকার পিআইসিইউতে (শিশু নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র) তাকে টানা সাত দিন লাইফ সাপোর্টে রাখা হয় এবং চিকিৎসক ৭ জানুয়ারি মধ্যরাতে শিশুটিকে মৃত ঘোষণা করেন। সুন্নতে খতনার মতো খুবই সাধারণ চিকিৎসায় আগে কখনো মৃত্যুর ঘটনা শোনা যায়নি, পরপর দুটি ঘটনা চিকিৎসকের অবহেলা বেশ আলোচনা সমালোচনা, কৌতূহল ও নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। এ ঘটনার রেশ কাটতে না কাটতেই রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাহিব রেজা নামের এক যুবকের মৃত্যুর অভিযোগ করা হয়।

রোগীর স্বজনরা অভিযোগ করেছেন, চিকিৎসকের অবহেলার কারণেই এসব মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে। চিকিৎসায় অবহেলা বা ভুল চিকিৎসা একটি শাস্তিযোগ্য অপরাধ হলেও আমাদের দেশে এ ধরনের ঘটনা নিয়ে আইনি পদক্ষেপ নেয়া ও সংশ্লিষ্ট চিকিৎসকের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির উদাহরণ খুব কম।

বাংলাদেশে চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণসহ অনেক বিষয়ে ‘দ্য মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেজিস্ট্রেশন) অর্ডিন্যান্স, ১৯৮২’-এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসায় অবহেলা শুধুই ‘অপারেশন’ বা অস্ত্রোপচার সংশ্লিষ্ট নয়, এর বাইরেও রোগীকে সঠিকভাবে পরীক্ষা না করা, রোগীর সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা, ফি নিয়ে দর-কষাকষি, ভুল ওষুধ দেয়া, মৃত রোগীকে আইসিইউতে আটকে রাখা, রোগীর ওপর জোর খাটানো, রোগীকে চিকিৎসা না দিয়ে অন্যত্র প্রেরণ করা, আইনি জটিলতার কথা ভেবে চিকিৎসা না দিয়ে রোগীকে ফেলে রাখা, হাসপাতালের শয্যা খালি না থাকার অজুহাতে চিকিৎসা না দেয়া, স্বাস্থ্যগত বিষয়ে ভুল রিপোর্ট দেয়া- এগুলোও চিকিৎসা অবহেলার অন্তর্ভুক্ত।

তবে আইনি ভাষায় চিকিৎসায় অবহেলা বলতে বোঝায় একজন চিকিৎসকের কাছে যখন একজন রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন, তখন লিখিত থাকুক বা না থাকুক উভয়ের মধ্যে একটি অলিখিত সুনির্দিষ্ট চুক্তির সৃষ্টি হয়। সেখানে অর্থের বিনিময়ে বা বিনিময় ছাড়াই সেবা প্রদানের বিষয়টি মুখ্য হয়ে ওঠে। চিকিৎসায় অবহেলা বলতে মূলত চিকিৎসক ও রোগীর চিকিৎসার সঙ্গে যুক্ত সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের অবহেলাকেই বোঝায়।

বাংলাদেশে প্রায়ই স্বজনরা ভুল চিকিৎসা বা অবহেলাজনিত কারণে রোগী মৃত্যুর অভিযোগ করেন। এ ধরনের অভিযোগ করার একমাত্র জায়গা হলো বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিল বা বিএমডিসি এবং এটি চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণকারী একটি বিধিবদ্ধ সরকারি প্রতিষ্ঠান। বিএমডিসির নিয়মানুযায়ী, কেউ লিখিত অভিযোগ করলে তা অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছে পাঠিয়ে জবাব দেয়ার জন্য সময় বেঁধে দেয়া হয় এবং অভিযুক্ত ব্যক্তির উত্তর অভিযোগকারীকে জানানো হয়।

তিনি তা গ্রহণ না করলে তদন্ত কমিটি গঠন করে অভিযোগ নিষ্পত্তির ব্যবস্থা করা হয়। এক্ষেত্রে অভিযুক্ত চিকিৎসকের লাইসেন্স স্থগিত করার বিধান রয়েছে। কিন্তু ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৮০ এবং ৮৮ ধারাতে ‘সরল বিশ্বাসে পরিচালিত চিকিৎসাকার্যে’ সংঘটিত দুর্ঘটনার দায় থেকে চিকিৎসককে অব্যাহতি দেয়া হয়েছে।

তবে, বাংলাদেশে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ভুক্তভোগীরা বিএমডিসির এ প্রক্রিয়া ভালোভাবে অবগত না বা এর মধ্য দিয়ে যায় না। আইনেও চিকিৎসকদের দায় নিয়ে স্পষ্টভাবে কোনো কিছু বলা হয়নি। এ ধরনের ক্ষেত্রে খুব বেশি হলে বিএমডিসিতে অভিযোগ করা যায়। তদন্ত কমিটিতে চিকিৎসকরাই থাকেন এবং তদন্ত ও অভিযোগ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রমাণ হয় না কিংবা সিদ্ধান্ত চিকিৎসকের পক্ষে যায়। তাছাড়া চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে অবহেলার অভিযোগ উঠলে তারা কর্মবিরতির মতো কঠোর কর্মসূচি পালন করে অভিযোগ প্রমাণে বাধা সৃষ্টি করে।

তবে, অবহেলাজনিত কারণে মৃত্যু হলে ফৌজদারি মামলা করার সুযোগ আছে। ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধির ৩০৪এ ধারামতে, কোনো ব্যক্তি বেপরোয়াভাবে বা অবহেলাজনিত কোনো কাজের মাধ্যমে কারও মৃত্যু ঘটালে এবং সেই অপরাধ শাস্তিযোগ্য নরহত্যা না হলে, তবে সেই ব্যক্তি অবহেলাকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন। এজন্য তাকে পাঁচ বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদে সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ডে অথবা অর্থদণ্ডে অথবা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত করা যাবে।

এই ধারা অনুসারে অপরাধ হয়েছে কি না, তা প্রমাণের জন্য প্রয়োজনীয় তিনটি উপাদানের ওপর নির্ভর করতে হবে। সেগুলো হলো- অবহেলার কারণে ব্যক্তিটি মৃত্যুবরণ করেছিল, অবহেলার কারণেই মৃত্যুটি সংগঠিত হয়েছিল এবং অবহেলাটি দায়মুক্তির নরহত্যা হিসেবে বিবেচিত নয়। এ ধারা অনুসারে চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ উঠলে আদালতের পরোয়ানা ছাড়াই পুলিশ অভিযুক্ত চিকিৎসককে গ্রেপ্তার করতে পারে। ভুক্তভোগী অনেক সময় বাধ্য হয়ে হাইকোর্টে রিট করে। কিন্তু সর্বোচ্চ আদালত এসব ক্ষেত্রে একজন চিকিৎসককে রুটিনমাফিক গ্রেপ্তারে নিরুৎসাহিত করছে।

তবে, বাংলাদেশে বেশিরভাগ অভিযোগই একটি দেওয়ানি বা ফৌজদারি মামলা হিসেবে আদালতে গড়ায় এবং সেখানে পর্যাপ্ত আইনি কাঠামোর অভাবে চিকিৎসকদের খুব কমই জবাবদিহি করা হয়। বিএমডিসি চিকিৎসকদের আচরণ নিশ্চিত করার জন্য দায়ী সংস্থা হলেও তার সমগ্র ইতিহাসে মাত্র ১৪ জন চিকিৎসককে শাস্তি দিয়েছে এবং শুধুমাত্র একজন চিকিৎসক স্থায়ীভাবে তাদের লাইসেন্স হারিয়েছে। অথচ প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে এর চিত্র সম্পূর্ণ বিপরীত, যেখানে প্রতিবছর চিকিৎসা অবহেলার প্রায় ৫২ লাখ অভিযোগ দায়ের করা হয়। ভারতের জাতীয় ভোক্তা বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন ২০১৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পর্যালোচনা করা ২৫৩টি চিকিৎসা অবহেলার অভিযোগের মধ্যে ১৩৫টিতে ক্ষতিপূরণ দিয়েছে।

এসব কারণে ভারতের চিকিৎসকরা এসব বিষয়ে খুব সচেতন এবং আমাদের দেশের অনেক রোগী প্রতিবছর চিকিৎসার জন্য ভারত গমন করে। বিবিসির সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ভারতের ১৮৬০ সালের দণ্ডবিধি অনুযায়ী, চিকিৎসকের অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হলে দুই বছরের কারাদণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। একইসঙ্গে আর্থিক ক্ষতিপূরণের জন্য যথাযথ সিভিল কোর্টে যাওয়ার বিধান রয়েছে। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের বিভিন্ন ধারায় ভুক্তভোগীকে এক কোটি থেকে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ প্রদানের বিধান রয়েছে।

তাছাড়া ভারতে ‘ইন্ডিয়ান মেডিকেল কাউন্সিল’ রয়েছে যারা চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয় এবং তারা চিকিৎসকদের লাইসেন্স স্থগিত বা বাতিল করতে পারে। অন্যদিকে যুক্তরাজ্যের আইনে চিকিৎসকদের নিয়ন্ত্রণ করে জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল এবং হাসপাতালগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করে কেয়ার কোয়ালিটি কমিশন।

দেশটিতে চিকিৎসায় অবহেলা হলে কঠোর আইনের বিধান রয়েছে। এটি ‘মেডিকেল ম্যানস্লটার ল’ নামেই বেশি পরিচিত। আইনটি বেশ পুরোনো হলেও ২০১৮ সালে এটি সে দেশের পার্লামেন্ট সংশোধন করে। দেশটিতে কোনো রোগী যদি অভিযোগ করে সেক্ষেত্রে জেনারেল মেডিকেল কাউন্সিল তদন্ত সাপেক্ষে চিকিৎসকের লাইসেন্স বাতিল করতে পারে। এ আইনে অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে একটি স্বাধীন কমিটি তদন্ত করে বড় ধরনের কোনো ভুল বা অবহেলা হয়েছে কি না। এটি প্রমাণিত হলে লাইসেন্স বাতিল এবং দুই থেকে ১০ বছরের কারাদণ্ডের বিধান রয়েছে।

তবে, বাংলাদেশে গত বছর স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ‘স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইন ২০২৩’ নামে একটি আইনের খসড়া তৈরি করেছে কিন্তু এটি এখনো আইনে পরিণত করা হয়নি। প্রস্তাবিত এ আইনের খসড়ায় চিকিৎসায় অবহেলাজনিত কারণে রোগীর মৃত্যু হলে ফৌজদারি আইনে বিচার এবং আদালত কর্তৃক নির্ধারিত ক্ষতিপূরণ আদায়ের কথা বলা হয়েছে। উক্ত খসড়ায় হাসপাতালের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হলে লাইসেন্স বাতিল ও চিকিৎসকের ক্ষেত্রে নিবন্ধন বাতিলের সুপারিশের কথা উল্লেখ আছে এবং একইসঙ্গে এসব অপরাধ আমলযোগ্য, জামিনযোগ্য ও আপসযোগ্য হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

চিকিৎসকদের চিকিৎসা অবহেলার জন্য কার্যকরভাবে বিচার না হওয়ার একটি কারণ হলো অপরাধকে ঘিরে আইনি অস্পষ্টতা ও এর যথাযথ প্রয়োগের অভাব। এ কারণে চিকিৎসাজনিত অবহেলা উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে। এদিকে স্বাস্থ্যমন্ত্রী এক বিবৃতিতে বলেছেন, হাসপাতালে চিকিৎসক ও কর্তৃপক্ষের অবহেলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া হবে না।

এ ধরনের ঘটনায় আমি অত্যন্ত মর্মাহত। কিছুদিন আগেও এমন একটি ঘটনা আমরা লক্ষ্য করেছি। সে ঘটনায় আমরা উপযুক্ত ব্যবস্থাও নিয়েছি। তবে সেই ঘটনার পরও যারা সতর্ক হতে পারেনি, এ রকম আর কারও কোনোরকম দায়িত্বে অবহেলা বা গাফিলতি কোনভাবেই মেনে নেয়া হবে না। চিকিৎসায় চিকিৎসকের অবহেলার বিষয়টি যেমন কারও কাম্য নয়, তেমনি চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীরা যাতে ভয়ভীতি ছাড়া স্বাধীনভাবে নিজেদের দায়িত্ব পালন করতে পারেন, তেমন পরিবেশ তৈরি করাও রাষ্ট্রের দায়িত্ব।লেখক: ব্যাংকার ও কলাম লেখক

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ