সব জল্পনা কল্পনার অবসান ঘটিয়ে অবশেষে বহুল আলোচিত ও কাঙ্ক্ষিত দ্বাদশ জাতীয় সংসদ তার কর্মযাত্রা সূচনা করেছে। এবারের সংসদ আওয়ামী লীগের ২২৪টি, জাতীয় পার্টির ১১টি, ওয়ার্কার্স পার্টির একটি, জাসদের একটি, কল্যাণ পার্টির একটি, স্বতন্ত্রের ৬২টি এবং সংরক্ষিত নারী ৫০টি আসন নিয়ে তার অভিযাত্রা শুরু করেছে। ইতোমধ্যে আপাতত ২৫ জন মন্ত্রী ও ১১ জন প্রতিমন্ত্রী চূড়ান্ত করে মন্ত্রিপরিষদের প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ৫৬(২) ধারা বলে এই নিয়োগ দান করেছেন। এরই মধ্যে জাতীয় পার্টিকে সংসদীয় বিরোধী দল হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। তবে বিজিত স্বতন্ত্ররা অফিসিয়ালি নির্দলীয় হওয়া সত্ত্বেও সরকারদলীয় তথা আওয়ামী উৎসমূল (তিনজন বাদে) হওয়ার ফলে তাদেরকে কৌশলগত কারণে সংসদীয় বিরোধী দলের স্বীকৃতি দেয়া হয়নি। তবে এরা প্রত্যেকে স্বাতন্ত্রিকভাবে বিরোধী সাংসদের ভূমিকা পালন করতে পারবে। বলাবাহুল্য, সংসদীয় গণতন্ত্রে বিরোধী সাংসদ বা বিরোধী দল কিংবা বিরোধী জোট খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। কার্যত এরা ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করে।
বিরোধী দল ছাড়া সংসদ যেমন অর্থবহ হয় না তেমনি গণতান্ত্রিক চর্চার মধ্য দিয়ে জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষারও প্রতিফলন ও বাস্তবায়ন ঘটে না। রাজনীতিতে বিরোধী দল সংসদ ও রাজপথ উভয় স্থলেই সরব থাকতে পারে। উল্লেখ্য, নির্বাচন কমিশনের সর্বশেষ তথ্যমতে, (২০২৩ সাল পর্যন্ত) দেশে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ৩৯টি। সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের প্রাক্কালে ৯৩টি দল নিবন্ধনের জন্য কমিশন বরাবর আবেদন করেছিল।
তার মধ্যে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম) ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি (বিএসপি)- এ দুটি দল নিবন্ধন পায়। প্রসঙ্গত, নিবন্ধন আইন ২০২০ অনুযায়ী কোনো রাজনৈতিক দলের গঠনতন্ত্র জাতীয় সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হলে তারা অযোগ্য বিবেচিত হবে। উল্লেখ্য, সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুকে ‘জাতির পিতা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। এ ছাড়াও ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণ, ২৬ মার্চে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ও মুজিব নগর সরকারের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সংবিধানে সন্নিবেশ করা হয়। বলাবাহুল্য, বাঙালি জাতিসত্তাকে পরম সাধনে ও যতনে লালন করে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্র সৃষ্টিতে বঙ্গবন্ধুর সুমহান আত্মত্যাগের কালজয়ী তথা অবিনাশী ইতিহাসই তাকে ‘জাতির পিতা’র আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।
ইতিহাসের এই পরম সত্যধারা অস্বীকার করে কোনো রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী শুধু সাংবিধানিক প্রবিধানে নয়, নৈতিক বিধানেও বৈধতার অধিকার রাখে কি না তা এখন সময়ের জ্বলন্ত জিজ্ঞাসা। অথচ বিএনপি-জামায়াত সহ একাধিক দল বা গোষ্ঠী তাদের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনায় এই পরম সত্যকে স্বীকার করে না। এমনকি সংবিধানে উল্লিখিত বাকি তিনটি ঐতিহাসিক দলিলকেও তারা অবলীলায় অস্বীকার করে চলেছে।
অথচ এগুলো আমাদের বীরোচিত মুক্তিযুদ্ধ ও মহান স্বাধীনতার মৌলিক ও অবিচ্ছেদ্য দালিলিক ভিত্তি। শুধু তাই নয়! এরা ছয়দফা, মুজিবনগর সরকার, চার জাতীয় নেতার মতো রাষ্ট্রীয় মৌলিক ইস্যু গুলোও অস্বীকার করে, বিকৃতি ঘটায়ে কথিত ভিন্ন মতের রাজনীতির নামে কার্যত রাষ্ট্রবিরোধী মতের অপচর্চা ’৭৫ পরবর্তী হতে চালিয়ে আসছে। বিস্মিত বিষয় হলো, এমন ভিত্তিহীন বিতর্কিত মতাদর্শ ধারণ করেই বিএনপি এবং তার দোসর- যুদ্ধাপরাধী জামায়াত সরকার ও বিরোধী উভয় স্থলে আসীন হয়েছে।
বলাবাহুল্য, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সংবিধানে বাঙালি জাতি রাষ্ট্রের মৌলিক চেতনা বিলুপ্তির পাশাপাশি ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে পূর্ববাংলার আবহমান ধ্রুপদী রাজনীতির সৃজনশীল গতিপথ পরিবর্তন করে জাতীয়তা পরিপন্থি অনাদর্শিক পথে দেশকে নিপতিত করানো হয়। গণতন্ত্র ও ভিন্নমত চর্চার নামে জাতীয় চেতনা বিপন্থি এমন বিকৃত ও তথাকথিত রাজনীতি চর্চার দৃষ্টান্ত বিশ্বে দ্বিতীয়টি নাই। এদিক থেকে জাতি হিসেবে আমরা দুর্ভাগা।
এর পার্শ্ব প্রতিক্রিয়াস্বরূপ রাজনীতি এখন আর স্বদেশ প্রেমের ওপর ভর করে না। রাজনীতি এখন অনেকটাই সাম্প্রদায়িকতা, পেশিনীতি ও দুর্নীতির কোপানলে জর্জরিত যা জিয়ার ভয়ঙ্কর দর্শন ‘আই উইল মেক পলিটিক্স ডিফিকাল্ট ফর দ্য পলিটিসিয়ান্স’ এর সফল বাস্তবায়ন বলে মনে হয়। উল্লেখ্য- একটি বৈষম্যহীন, শোষণহীন মানবিক সমাজ গঠনই ছিল বঙ্গবন্ধুর আজীবনের ব্রত। একটি সর্বজনীন সাম্যের সমাজ গঠনে তিনি আজীবন সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে লড়াই করে গেছেন। লড়াই করেছেন পেশিনীতি ও দুর্নীতির বিরুদ্ধেও। রাজনীতিকে তিনি পেশা নয় বরং পরম সেবার ধর্ম হিসেবে লালন-পালন করতেন।
সাধারণ জনগণই ছিল তার রাজনীতির মৌলসত্তা। সময়ের আবর্তে তার অতি সাধনার আওয়ামীলীগ তার সৃজনশীল রাজনৈতিক দর্শন থেকে এখন অনেক দূরে। বর্তমান রাজনীতিতে তার মহান আদর্শাবলি এখন অনেকটাই শুধু মুখরোচক বাক্যে পরিণত হয়েছে। তা শুধু অনুস্মরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে; অনুকরণ ও পালনের ধারের কাছে নেই। রাজনীতি এখন অনেকটাই অর্থ ও পেশিশক্তির বুর্জোয়া পণ্যে পরিণত। জনতান্ত্রিক নয় বরং ধনতান্ত্রিক ও আমলাতান্ত্রিক মনস্তত্ত্ব এখন রাজনীতিকে ক্রমশ গ্রাস করে ফেলেছে।
ম্লান হয়েছে রাজনীতির পরিশীলন চর্চা। উল্লেখ্য, ’৭৫ পরবর্তীতে আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতাসীন হয়েছে তখনই মূলত বিএনপি, জামায়াত, জাতীয় পার্টি প্রধান বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করেছে। তখন কেউই দেশে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের শূন্যতা পূরণে আওয়ামী লীগকে ন্যূনতম তাগিদ দেয়নি। কেননা, তারা কেউই বঙ্গবন্ধুর সর্বজনহিতৈষী রাজনৈতিক দর্শনে বিশ্বাসী নয়। পক্ষান্তরে, আওয়ামী লীগ যখন বিরোধী দলে থেকেছে তখন তারা রাষ্ট্রযন্ত্রের অপব্যবহারের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সুমহান আদর্শ, ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে জাতির মগজ ও মনন থেকে চিরতরে নস্যাৎ করার গভীর ষড়যন্ত্রের অপরাজনীতি করেছে।
এমনকি তাবৎ আওয়ামী লীগকে চিরতরে নিঃশেষ করার লোমহর্ষক ষড়যন্ত্রেও মত্ত থেকেছে যা ২১ আগস্টের মতো নৃশংস গ্রেনেড হামলা ও শেখ হাসিনাকে ২১ বার হত্যা চেষ্টাসহ অসংখ্য ভয়ঙ্কর-ঘৃণ্য উদাহরণে জর্জরিত। বিশেষ করে বিএনপি-জামায়াত বিরোধী দলের মুখোশে সরকার বিরোধিতার নামে কার্যত দেশ বিরোধিতায় অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বহুভাবে সংশ্লিষ্ট থেকেছে যা কখনই গণতান্ত্রিক চর্চা হতে পারে না। বলাবাহুল্য, বঙ্গবন্ধু ও তার আদর্শিক দর্শন কোনো নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠীর একান্ত সম্পদ নয়। তিনি ও তার আদর্শ দল, মত, গোষ্ঠী নির্বিশেষে অবশ্যই পূজনীয় ও অনুকরণীয়। সন্দেহাতীতভাবে, ঐতিহাসিক সূত্রে একমাত্র তিনিই আমাদের জাতীয় রাজনীতির মডেল, আইকন, আইডল।
তার আদর্শকে অস্বীকার করে এদেশের কোনো রাজনীতিই পরিপুষ্ট হতে পারে না। ‘বঙ্গবন্ধু’ থেকে ‘বিশ্ববন্ধু’ স্বীকৃতির মাধ্যমে তার সৃষ্টিশীল রাজনৈতিক দর্শন এখন জাতীয় সীমানা পেরিয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও পরম কৃতিত্বের ইতিহাস গড়েছে; অর্থাৎ পৃথিবীর যে কোনো অধিকার বঞ্চিত ভগ্নদশা জাতি বা গোষ্ঠীর মুক্তির আলোকবর্তিকা হিসেবে তিনি অনন্তকাল অনুকরণীয় হয়ে থাকবেন। প্রসঙ্গত, এই প্রথম জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শপুষ্ট একঝাঁক স্বতন্ত্র সাংসদ আওয়ামী লীগ সরকারের বিরোধীগোষ্ঠী হিসেবে সংসদে অবতীর্ণ হয়ে এক ব্যতিক্রম দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। দেশ পরিচালনায় এই সরকার কতটা বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে ধারণ করবে তা গাইডিং করার এই প্রথম সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। যদিও জাতীয় পার্টি অফিসিয়ালি প্রধান বিরোধী দল হিসেবে এই সংসদে স্বীকৃতি পেয়েছে তবুও বঙ্গবন্ধুর আদর্শ বাস্তবায়নে নীতিগতভাবে তারা দায়িত্বশীল হবে না।
কেননা, বিএনপির মতো জাতীয় পার্টিও সামরিক ব্যারাক হতে জন্ম নেয়া একটি অগণতান্ত্রিক দল যারা হীন স্বার্থ চরিতার্থে ধর্মকে কূটকৌশলে ব্যবহার করে সাম্প্রদায়িকতার লালসালু লাগিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভাজন সৃষ্টি করে জাতীয় রাজনীতিকে কলুষিত করেছে; এমনকি ’৭২ এর মহান সংবিধানকে জিয়ার মতো বিক্ষত করে সাম্প্রদায়িকতার বিষাক্ত বীজ বপনের মাধ্যমে বাঙালি জাতির চিরায়ত অসাম্প্রদায়িক ঐক্যের শুভবন্ধনে ফাটল ধরিয়েছে এবং প্রবল আঘাত হেনেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাতেও। বলা যায়, জিয়া সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তি স্থাপন করেন আর এরশাদ সেই ভিত্তির ওপর ‘রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম’ (?) এর নামে সাম্প্রদায়িকতা নির্মাণ করেন। দীর্ঘ সময়ে এদের সৃষ্ট বিজাতীয় প্রভাবে প্রজন্মের এক বিরাট অংশ এখন জাতিসত্তাবোধে সন্দিগ্ধ ও পক্ষাঘাতগ্রস্ত! ফলে, যুগান্তরে পশ্চাদপদ হয়েছে আমাদের জাতীয় অগ্রযাত্রা।
আধুনিক বিশ্বায়নের যুগে পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ও জাতি যখন আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিযোগিতার কক্ষে ধাবমান তখন আমাদেরকে আজো জাতিসত্তা, ইতিহাস, ঐতিহ্যের মতো মৌলিক ইস্যুগুলোকে বিকৃতির আগ্রাসন থেকে বাঁচানোর জন্য মনস্তাত্ত্বিক ও রাজনৈতিক লড়াই করতে হয়; উদ্বিগ্ন থাকতে হয় এসব পরম সংবেদনশীল ইস্যুগুলোর বিরুদ্ধে অপরাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের আশঙ্কায়! তার ওপর দুর্নীতি, অর্থপাচার, বাজার সিন্ডিকেট, কৃত্রিম মূল্যস্ফীতি প্রভৃতি বিচিত্র নৈতিক অবক্ষয়ের বিভৎসতা সামাজিক ও নাগরিক জীবনকে নিদারুণ বিষণ্ন করে তুলেছে! বিপন্ন হচ্ছে সুশাসন! স্বতন্ত্র সাংসদরা বঙ্গবন্ধুর অবিনাশী আলোয় দ্যুতিময় হয়ে ছায়া সরকারের ভূমিকায় দেশ ও জাতিকে একটি সুন্দর উপভোগ্য আগামীর পথ দেখাবে এ শুভ প্রত্যাশায় আমরা।
লেখক: কলামিস্ট
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ