ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ক্ষমার রজনী শবেবরাত

প্রকাশনার সময়: ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১১:২৮

হিজরি বর্ষের অষ্টম মাস শাবানের ১৪ তারিখ দিনগত রাত আমাদের দেশে শবেবরাত হিসেবে পরিচিত। অনেকে ‘লাইলাতুল বারাআত’ও বলেন। ‘শবেবরাত’ বা ‘লাইলাতুল বারাআত’ কোনোটিই কোরআন-হাদিসে কোথাও নেই। হাদিসে এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (মধ্য শাবানের রাত)’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। নির্ভরযোগ্য হাদিস দ্বারা এ রাতের ফজিলত প্রমাণিত।

হজরত আবু মুসা আশআরী (রা.) থেকে বর্ণিত, মহানবী (সা.) বলেন, ‘আল্লাহ তায়ালা অর্ধ শাবানের রাতে তাঁর সৃষ্টির প্রতি দৃষ্টিপাত করেন এবং মুশরিক ও মুশাহিন (বিদ্বেষপোষণকারী) ছাড়া সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (ইবনে মাজাহ: ১/৪৪৫)। মুহাদ্দিনগণ এ হাদিসের বর্ণনাসূত্র নিয়ে প্রশ্ন তোলেননি। বিখ্যাত হাদিস গবেষক নাসিরুদ্দিন আলবানির (রহ.) মতে এ হাদিসটি হাসান। (সিলসিলাতুল আহাদিস আস সহিহাহ: ৩/১৩৫)। সুতরাং মধ্য শাবানের রাত বা শবেবরাত আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে ক্ষমার এক বিশেষ সুযোগ এতে সন্দেহ নেই।

কিন্তু আমাদের সমাজের এক শ্রেণির মানুষ অজ্ঞতাবশত এ রাত নিয়ে বাড়াবাড়ি করতে করতে একে ‘ভাগ্য রজনী’ মনে করেন যা সম্পূর্ণ হাস্যকর। এ রাতে হায়াত, মওত, রিজিক ইত্যাদি নির্ধারণ করা হয় এ ধারণা কোরআন হাদিসের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। সুরা দুখানের ৩-৪ নম্বর আয়াতের ব্যাখ্যায় কেউ কেউ এ রাতকে অন্তুর্ভুক্ত করতে চেয়েছেন। কিন্তু তা প্রত্যাখ্যাত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি একে (পবিত্র কোরআন) এক মুবারক রজনীতে অবতীর্ণ করেছি, আমি তো সতর্ককারী। এ রাতেই প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থিরকৃত হয়। (সুরা দুখান: ৩-৪)। এখানে একটি ব্যাপার স্পষ্ট যে, যে রাতে (লাইলাতুম মুবারাকা) গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো স্থির হয় তা হলো কোরআন নাজিলের রাত। আর কোরআনুল কারিম কোন রাতে নাজিল হয়েছে তা সচেতন মুসলিমমাত্রই জানার কথা। কারণ কোরআন কোন রাতে নাজিল হয়েছে, তা কোরআনুল কারিমে সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত।

আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয়ই আমি একে (কোরআনকে) লাইলাতুল কদরে অবতীর্ণ করেছি। (সুরা কদর: ১)। সুতরাং এখানে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ স্থির হওয়ার যে রাতের কথা বলা হয়েছে তা নিঃসন্দেহে লাইলাতুল কদর। লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান (মধ্য শাবানের রাত বা শবেবরাত) নয়। সুরা দুখানের তৃতীয় আয়াতের ‘লাইলাতুম মুবারাকা’র ব্যাখ্যায় আল্লামা ইবনে কাসির বলেন, ‘কোনো কোনো লোক এ কথাও বলেছেন যে, যে মুবারক রজনীতে কোরআনুল কারিম অবতীর্ণ হয় তা হলো শাবানের পঞ্চদশতম রজনী। এটা সরাসরি কষ্টকর উক্তি। কেননা কোরআনের স্পষ্ট ও পরিষ্কার কথা দ্বারা কোরআনের রমজান মাসে নাজিল হওয়া সাব্যস্ত হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা সুরা বাকারার ১৭৭ নম্বর আয়াতে বলেছেন, ‘রমজান ওই মাস যাতে কোরআনুল কারিম অবতীর্ণ করা হয়।’ (তাফসিরে ইবনে কাসির: ১৬/৬১০)

মধ্য শাবানের রাতের ফজিলত অস্বীকার করা অথবা এর ফজিলত স্বীকার করতে গিয়ে একে ‘ভাগ্য রজনী’ বানিয়ে ফেলা দুটোই বাড়াবাড়ি। ছাড়াছাড়ি ও বাড়াবাড়ি কোনোটিই কাম্য নয়। আমাদের উচিত এ রাতকে ক্ষমার রাত মনে করা। মধ্য শাবানের রাত বা শবেবরাত সংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য বর্ণনাসূত্রের যে হাদিস পেশ করা হয়েছে, তাতে এ রাতে ক্ষমাপ্রাপ্তির দুটো শর্ত দেয়া হয়েছে। হাদিসে বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা এ রাতে তার বান্দাদের ক্ষমা করে দেবেন। তবে মুশরিক এবং হিংসাপোষণকারীকে এ রাতেও আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা করবেন না।

উল্লিখিত হাদিসে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, মধ্য শাবানের রাতে ক্ষমা পাওয়ার জন্য শর্ত হলো অন্তরকে দুটি ত্রুটি (শিরক ও হিংসা-বিদ্বেষ) থেকে খালি করা। প্রথমটি আল্লাহর সঙ্গে সম্পৃক্ত। তা হলো শিরক বা আল্লাহর সঙ্গে কাউকে অংশীদার সাব্যস্ত করা। শিরক সবচেয়ে বড় গুনাহ। যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে, জান্নাত তার জন্য হারাম করে দেয়া হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘যে ব্যক্তি আল্লাহর সঙ্গে অন্যকে শরিক করে, আল্লাহ অবশ্যই তার উপরে জান্নাতকে হারাম করে দেন এবং তার ঠিকানা হলো জাহান্নাম। আর জালেমদের জন্য কোনো সাহায্যকারী নেই।’ (সুরা মায়েদাহ: ৭২)

শবেবরাতে ক্ষমা পাওয়ার জন্য অন্তরকে দ্বিতীয় যে ত্রুটি থেকে মুক্ত করার শর্ত দেয়া হয়েছে তা মানুষের সঙ্গে সম্পৃক্ত। তা হলো হিংসা-বিদ্বেষ। কারও কোনো বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করলেও তার হিংসা বা অকল্যাণ কামনা করা যাবে না। আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘তোমরা হিংস থেকে বেঁচে থাকো। কেননা হিংসা নেকিকে এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে অর্থাৎ জ্বালিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ: ৪৯০৩)। কেউ যদি সারারাত নফল নামাজ পড়ে কিন্তু তার অন্তরকে এ দুই জিনিস থেকে মুক্ত না করে তাহলে সে ক্ষমার অন্তর্ভুক্ত হবে না।

এ রাতে নফল নামাজ পড়া ও আল্লাহ তায়ালার কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করা যায়। তবে তা হবে ব্যক্তিগত, সমষ্টিগত নয়। নফল নামাজ, জিকির, দোয়া ও তিলাওয়াত যাই হোক না কেন সবই একাকীভাবে হওয়া উচিত। এ রাতকেন্দ্রিক দল বেঁধে মসজিদে সমাবেত হওয়া বিদআত। কারণ, এর কোনো প্রমাণ হাদিসে নেই। নবীজি (সা.) তা করেননি, সাহাবায়ে কেরামের যুগেও এর প্রচলন ছিল না। (ইততিজাউস সীরাতিল মুস্তাকিম: ২/৬৩১)। নফল নামাজ পড়লে তা একেবারেই সাধারণ নফল নামাজ হবে। এর জন্য বিশেষ ধরনের নামাজ আবিষ্কার করা, প্রতি রাকাতে বিশেষ কোনো সুরাকে ১০-২০ বার পড়ার বিশেষ ফজিলত মনে করা বিদআত ও পরিত্যাজ্য।

মধ্য শাবানের রাত আমাদের একটা সতর্কবার্তা দিয়ে যায় যে, আল্লাহ তায়ালা যেমন শিরক ক্ষমা করেন না তেমনি কোনো মুসলমান যদি অন্য ভাইয়ের প্রতি হিংসা-বিদ্বেষ পোষণ করে তাও আল্লাহ ক্ষমা করেন না। এ পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় গুনাহ হলো আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে কাউকে শরিক করা। আর শবেবরাতের হাদিসে সেই শিরকের সঙ্গেই হিংসা-বিদ্বেষকে উল্লেখ করা হয়েছে। সংঘাতময় এ সমাজে শান্তি ফিরিয়ে আনতে মধ্য শাবানের রাতকেন্দ্রিক এ হাদিসখানা অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। সমাজ জীবনে ভিন্নমত বা মতবিরোধ থাকতেই পারে। তবে ভিন্নমত, বিরোধ আর হিংসা-বিদ্বেষ এক নয়। কারও কোনো বিষয়ে ভিন্নমত পোষণ করলেও তার হিংসা বা অমঙ্গল কামনা করা যাবে না।

রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘হে বৎস, তুমি এমনভাবে জীবনযাপন করতে যে সকালে সন্ধ্যায় (কখনো) তোমার অন্তরে কারও প্রতি ধোঁকা বা অমঙ্গল কামনা থাকবে না। এটা আমার সুন্নত। (তিরমিজি: ৫/৪৬) কারও অকল্যাণ কামনা করা মারাত্মক গুনাহ জাহান্নামে যাওয়ার কারণ আবার কাউকে ভালোবাসা এক মহান ইবাদত, জান্নাতে প্রবেশের কারণ। নবীজি (সা.) বলেন, ঈমানদার না হওয়া পর্যন্ত তোমরা কেউ জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না। আর তোমরা পরস্পর পরস্পরকে না ভালোবাসা পর্যন্ত ঈমানদার হতে পারবে না...।’ (সহিহ মুসলিম: ১/৭৪)। আল্লাহ তায়ালার দরবার থেকে ক্ষমা পেতে হলে প্রতিটি মুসলমানের উচিত তার অন্তরকে শিরকমুক্ত করা এবং তার আত্মীয়-স্বজন, ভাইবোন, প্রতিবেশী কিংবা যে কারও প্রতি অন্তরে হিংসা-বিদ্বেষ বা অমঙ্গল কামনা থাকলে তা থেকে অন্তরকে মুক্ত করা। সেই ভাইয়ের কল্যাণ কামনা করে আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করা। সব ধরনের শিরক ও হিংসা-বিদ্বেষ থেকে মুক্ত হোক আমাদের অন্তর। আল্লাহ যেন আমাদেরকেও ক্ষমার চাদরে আবৃত করে নেন।

লেখক: প্রিন্সিপাল, বাইতুল হিকমাহ একাডেমি, গাজীপুর।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ