সুন্দরবন, বাংলাদেশের জীববৈচিত্র্যের আঁধার। শুধু নামে সুন্দর নয়, মুগ্ধ করার মতো গঠনশৈলী আর প্রাণী সম্পদের নিদর্শন এই সুন্দরবন। অসংখ্য পরিচিত অপরিচিত বৃক্ষরাজি, প্রাণিকুল নিয়ে যুগ যুগ ধরে দেশের পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অবদান রেখে চলেছে।
সুন্দরবনের কথা শুনলেই মনের দৃশ্যপটে ভেসে ওঠে গায়ে ডোরাকাটা রয়েল বেঙ্গল টাইগার, গোলপাতা, জোয়ার ভাটা আর মৌয়ালদের কথা। বাংলাদেশের দক্ষিণ অংশে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম জোয়ারধৌত গরান বনভূমি। নানা ধরনের গাছপালার চমৎকার সমারোহ ও বিন্যাস এবং বন্যপ্রাণীর সমাবেশ এ বনভূমিকে করেছে আরও আকর্ষণীয়।
আজ থেকে প্রায় ২০০ বছর আগেও এ বনভূমির এলাকা ছিল প্রায় ১৬ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার। বিশ্বের অধিকাংশ বনভূমির অবস্থা আজ অস্তিত্ব সংকটে। আমাজানের মতো বিশাল বন যার সম্পর্কে স্থানীয়দের ধারণা ছিল যে এটি কোনোদিন সংকুচিত হবে না তাও আজ মানুষের লোভের কারণে আয়তন হারাচ্ছে।
মানুষের লোভের শিকার ও প্রাকৃতিক কিছু কারণে আমাদের সুন্দরবনও আয়তন হারাচ্ছে। বর্তমানে নানা কারণে ছোট হতে হতে প্রকৃত আয়তনের এক তৃতীয়াংশে পৌঁছেছে। ভারতীয় উপমহাদেশ দুইভাগে ভাগ হলে সুন্দরবনের দুই তৃতীয়াংশ বাংলাদেশের এবং বাকিটা ভারতের অংশে পড়েছে। বাংলাদেশের ভাগের আয়তন প্রায় ৬,৫১৭ বর্গকিলোমিটার।
১৮৭৫ সালে সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এ বনভূমির প্রায় ৩২৪০০ হেক্টর এলাকাকে বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। সুন্দরবনের নাম ঠিক কী কারণে সুন্দরবন হলো তা একেবারে স্পষ্ট বলা যায় না তবে প্রচলিত এবং গ্রহণযোগ্য মত যে, এই বনের সুন্দরী বৃক্ষের নাম থেকেই করা হয়েছে। একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালে সুন্দরী গাছ ছিল বনের এক লাখ ৬৬ হাজার ৬৪৫ হেক্টরজুড়ে।
২০১৪ সালে তা কমে গিয়ে এক লাখ ১২ হাজার ৯৯৫ হেক্টর হয়। তথ্যে জানা যায়, ১৮২৮ সালে ব্রিটিশ সরকার সুন্দরবনের স্বত্বাধিকার অর্জন করে। ১৮৭৮ সালে সমগ্র সুন্দরবন এলাকাকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা দেয়া হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের সময় সুন্দরবনের ছয় হাজার ১৭ বর্গকিলোমিটার বাংলাদেশ অংশে পড়ে যা বাংলাদেশের আয়তনের চার দশমিক দুই এবং দেশের সমগ্র বনভূমির প্রায় ৪৪ শতাংশ।
কারণ এ বনে প্রচুর সুন্দরী গাছ দেখতে পাওয়া যায়। গাছপালা, প্রাণিকুল, সরীসৃপ, উভচর প্রাণী, মাছ ইত্যাদি মিলিয়ে সুন্দরবন আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সম্পদের এক বিশাল ভান্ডার। এ বনভূমির বৃক্ষরাজির মধ্যে রয়েছে দক্ষিণ পশ্চিম এলাকার লবণাক্ত পানির গেওয়া, গরান, কেওড়া, ওড়া, পশুর, ধুন্দুল, বাইন ইত্যাদি। দক্ষিণ অংশের অধিকাংশ এলাকা পরিমিত লবণাক্ত পানির বনে ঢাকা আর প্রধান উদ্ভিদ সুন্দরী। ঘনভাবে জন্মাতে দেখা যায় গোলপাতা। যার ছাউনি দিয়ে ঘর নির্মাণ করা যায়।
পশুর, হরিণঘাটা এবং বুড়িশ্বর নদী দিয়ে প্রবাহিত প্রচুর স্বাদুপানি লবণাক্ততা কিছুটা হ্রাস করে পার্শ্ববর্তী এলাকায় সহনীয় স্বাদুপানির বন এলাকা গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছে। সুন্দরবনের প্রাণিকুলের কথা আসলে প্রথমেই আসে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের কথা।
তবে শুধু রয়েল বেঙ্গল টাইগারই নয় বরং আরও অনেক প্রাণিকুলের আবাসস্থল এই সুন্দরবন। এ বনভূমিতে আছে প্রায় ৫০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী (উল্লেখযোগ্য চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, রেসাস বানর, বনবিড়াল, লিওপার্ড, সজারু, উদ এবং বন্য শুকুর), ৩২০ প্রজাতির আবাসিক ও পরিযায়ী পাখি (উল্লেখযোগ্য বক, সারস, কাঁদাখোচা, হাড়গিলা, লেনজা, গাঙচিল, জলকবুতর, টার্ন, চিল, ঈগল, শকুনসহ দেশি প্রজাতির পাখি), প্রায় ৫০ প্রজাতির সরীসৃপ (গুইসাপ, কচ্ছপ ও নানা প্রজাতির সাপ), আট প্রজাতির উভচর এবং প্রায় ৪০০ প্রজাতির মাছ। এ বিশাল বন ঘিরে বাংলাদেশের অর্থনীতি গড়ে উঠেছে। এ অর্থনীতির প্রথমেই রয়েছে চিংড়ি।
যা সাদা সোনা নামে পরিচিত। প্রায় ২০ প্রজাতির চিংড়ির মধ্যে বাগদা চিংড়ি ও হরিণা চিংড়ি বাণিজ্যিকভাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ। এ চিংড়ি চাষ এবং বাণিজ্যের সঙ্গে বহু মানুষের কর্মসংস্থান জড়িয়ে রয়েছে। তাছাড়া সুন্দরবনকে ঘিরে একটি বিশাল অংশ মাছ ধরার সঙ্গে জড়িত। এ মাছ ধরেই তাদের জীবন ও জীবিকা চলে। মাঝে মাঝে তারা বাঘের আক্রমণেরও শিকার হয়।
তারপরেও এ সুন্দরবনই তাদের বেঁচে থাকার অন্যতম উৎস। অর্থনৈতিকভাবে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ পেশার নাম মৌয়াল যারা এ বনের মধু সংগ্রহ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারা বন বিভাগের অনুমতি নিয়ে ফুলের মৌসুমে তিন-চার মাস বন থেকে মধু সংগ্রহ করে। এই মধু পরে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়।
আমাদের দেশের জন্য এ বন আশীর্বাদস্বরূপ। এ বনের দিকে সতর্ক দৃষ্টি না রাখলে তা আমাদের জন্য অভিশাপের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। কারণ নানা কারণে সুন্দরবন ধ্বংস হয়ে চলেছে। চোরাকারবারিদের দৌরাত্ম্যে প্রতিনিয়তই সুন্দরবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এসব অবিবেচক, লোভী ও অসাধু মানুষের জন্য দেশের কোটি কোটি মানুষের জন্য হুমকি তৈরি হচ্ছে।
একটি বন শুধু একটি বন নয় তার সম্পর্ক থাকে সেই জাতির সঙ্গে। চোরাকারবারিরা এ বন থেকে কাঠ কেটে পাচার করছে। শিকারিদের লোভের শিকার হচ্ছে রয়েল বেঙ্গল টাইগার, হরিণ, শুকুরসহ নানা প্রাণী। এতে বনের খাদ্য শৃঙ্খলের ওপর মারাত্মক ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে। বাঘ খাদ্যের খোঁজে লোকালয়ে প্রবেশ করে মানুষের হাতে মারা পড়ছে। অথচ এই বাঘের সংখ্যা কমতে কমতে আজ তা অস্তিত্ব হারানোর পথে। প্রাকৃতিক পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় সুন্দরবন মহাগুরুত্বর্পূণ। বড় বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ ঠেকাতে গেলে বনায়ন বৃদ্ধি করতে হবে। এমনিতেই আমাদের দেশে প্রয়োজনীয় বনভূমি নেই।
কোনো দেশের জন্য শতকরা ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা আবশ্যক। আমাদের তা নেই। যেটুকু আছে তাও যদি আমরা ধ্বংস করে ফেলি তাহলে তা হবে নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার মতো অবস্থা। পর্যটন শিল্পেও এ বন গুরুত্বপূর্ণ। প্রতি বছর প্রচুর দেশি বিদেশি পর্যটক এ বন দেখতে যায়। সেক্ষেত্রে এটি আমাদের অর্থনীতিতে সরাসরি ভূমিকা রেখে চলেছে।
সুন্দরবন রক্ষায় সরকারি মহলকে আরও কঠোর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হবে। সুন্দরবনের আশপাশে যারা বসবাস করে মূলত তারা এ বনের ওপর তাদের জীবন জীবিকা নির্ভর করে বেঁচে থাকে। তাদের যদি বিকল্প আয়ের পথ গড়ে তোলা যায় তাহলে তারা বনের কোনো ক্ষতিসাধন করবে না। সুন্দরবনের ভিতর অভয়াশ্রম গড়ে তুলতে হবে। বনের সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজনীয় লোকবল এবং সরঞ্জামাদি সরবরাহ করতে হবে। কারণ পাচারকারীরা শক্তিশালী এবং চতুর। তাই তাদের মোকাবিলা করার জন্য দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। যারা কর্মঠ, সৃজনশীল, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন, সাহসী এবং বন রক্ষায় দৃঢ় সংকল্প হয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ