ঢাকা, রোববার, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বইমেলা বাঙালির প্রাণের মেলা

প্রকাশনার সময়: ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ০৮:০৫

বাঙালির প্রাণের মেলা অমর একুশে গ্রন্থমেলা, যাকে সাধারণ মানুষ জানে ও চেনে বইমেলা হিসেবে। আমাদের আবেগিত মনের অনুভূতি আদান-প্রদানের মেলা অমর একুশে বইমেলা। আবহমান কাল থেকেই আমাদের দেশে হরেক রকমের মেলার আয়োজন হয়ে আসছে, তন্মধ্যে অমর একুশে বইমেলা হলো সর্বোকৃষ্ট মেলা, বাংলা একাডেমি আয়োজিত একুশে বইমেলা যেখানে জ্ঞানের বিনিময় ঘটে বইয়ের মাধ্যমে। বইপড়া ব্যতীত জ্ঞানার্জনের সঠিক পথ নেই।

তাই জ্ঞানার্জনের ক্ষেত্রে বইয়ের ভূমিকা অপরিসীম। যে মেলা বইপ্রেমী মানুষের প্রাণে দোলা দেয়। কোনো এক অদৃশ্য শক্তিবলে লাখো মানুষকে টেনে আনে একাডেমির বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণে। কবি, লেখক, পাঠক ও প্রকাশকদের এক মিলনমেলা। বইমেলা আমাদের অন্তরে যে বন্ধন তৈরি করে তা ভাঙে না কখনো। দেশের প্রতি মানুষের প্রতি ভালোবাসা সৃষ্টি করে।

অনুপ্রেরণা জোগায়। স্মৃতিবাহী একুশের সঙ্গে স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা ও তরুণ প্রজন্মকে সঠিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বাঙালি জাতীয়তাবোধকে আরও বেশি করে মনে রাখার জন্য আজকের একুশের বইমেলা।

বইমেলা মানুষের চিন্তার পরিমাপক। এর মাধ্যমে মানুষের রুচি ও আদর্শের উন্নতি ঘটে। তাই বইমেলার উন্নয়নে আমাদের আন্তরিক হতে হবে। বই পড়ে মানুষ জ্ঞান অর্জন করে হয় উদার মহীয়ান। আর মহীয়ান মানুষই জাতিকে করে উন্নত। তাই শিক্ষা সংস্কৃতির প্রসারে বইমেলার অবদানকে স্বাগত জানাই।

বই হচ্ছে মানুষের সেই বন্ধু যার জাগতিক কোনো শরীর নেই কিন্তু সে ধারণ করতে পারে সমগ্র মহাবিশ্বকে। যার পরতে পরতে লুকায়িত আছে এক অনন্ত অসীম ঐশ্বর্য। যে সেই অপার ঐশ্বর্যে ডুব দিয়েছে একাগ্র সাধনায়, সে পেয়েছে বইয়ের নিজস্ব সত্তার আসল অকৃত্রিম ভান্ডার, সে হয়ে উঠেছে বইয়ের অবিচ্ছেদ্য প্রেমিক। বইমেলা বইয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ বাড়ায়। মেলা শুরু হলে বই কেনার প্রতি বিশেষ তাগিদ অনুভব করি আমরা।

তাছাড়া দূর-দূরান্ত থেকে বহু প্রকাশক আসেন বইমেলায়। আসে নানা ধরনের বই। অচেনা অজানা অনেক বইয়ের সন্ধান মেলে। ইচ্ছে অনুযায়ী সেগুলো কেনার সাধ্য হয় অনেকের। অন্তত মেলার সুবাদে কিছু বইয়ের সঙ্গে ক্ষণিকের জন্য হলেও পরিচয় মেলে।

ব্যক্তি জাগতিক রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে এ প্রজন্মের মানুষের কথা বলার সুযোগ নেই কিন্তু তার চিন্তা, তার দর্শনের সঙ্গে আলাপ করার সুযোগ রয়েছে, ব্যক্তি বিভূতিভূষণ, বার্ট্রান্ড রাসেল, লালন ফকির, হুমায়ুন আজাদ, কাজী নজরুল ইসলাম, এমন সবার সঙ্গে সবার দর্শনের সঙ্গে আমাদের কথা বলার একমাত্র পথ হচ্ছে বই। তাদের রচিত বই তাদের চিন্তা, দর্শন তৎকালীন সময়ের সমাজ, জীবন সব বিষয় সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে, যা আমরা কেবল তাদের রচিত বইয়ের মাধ্যমেই পেতে পারি। সেজন্য বইয়ের গুরুত্ব আমার কাছে সর্বোচ্চ ও সর্বাধিক।

বইমেলা যে কোনো জাতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায়। বইয়ের সঙ্গে মানুষের সম্পর্ক যত নিবিড় ও ঘনিষ্টতর হবে, সেই মানুষ তত উন্নত চিত্তের অধিকারী হবে। বিশ্বের যত জ্ঞানী-গুণী, বিজ্ঞানী, দার্শনিক, বিপ্লবী এবং স্মরণীয়-বরণীয় ব্যক্তির জন্ম হয়েছে, প্রত্যেকের জীবনেই বইয়ের সঙ্গে ছিল ঘনিষ্ট সম্পর্ক। বিশ্বের ইতিহাসে তাকালে দেখা যায়, বিপ্লবী নেতা চে’গুয়েভারা সব সময় বন্দুকের সঙ্গে পাবলো নেরুদার ‘কান্তো জেনারেল’ বইটি রাখতেন; বিশ্বখ্যাত আলেকজেন্ডার দিনের একটি নির্দিষ্ট সময় বই পড়ে অতিবাহিত করতেন। বাংলা একাডেমি প্রতি ফেব্রুয়ারি মাসে আয়োজন করে অমর একুশে বইমেলার। ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ২১ তারিখ বাংলা ভাষার জন্য আত্মোৎসর্গের যে বীরত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে, সেই স্মৃতিকে অম্লান রাখতেই এ মাসে আয়োজিত এ বইমেলার নামকরণ করা হয় অমর একুশে বইমেলা।

অমর একুশে বইমেলার পথিকৃৎ হিসেবে যার কথা স্মরণ করিয়ে দেয়, তিনি হলেন মুক্তধারা ও পুঁথিঘর প্রকাশনীর স্বত্ব্বাধিকারী মান্যবর প্রয়াত চিত্তরঞ্জন সাহা। যিনি সর্বপ্রথম আনুমানিক ১৯৭২ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন বর্ধমান হাউস প্রাঙ্গণের বটতলায় মাটিতে চট বিছিয়ে নিজের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রকাশিত ৩০-৩২টির মতো বই বিক্রি শুরু করার মধ্য দিয়ে বইমেলার গোড়াপত্তন করেন। এরপর থেকে তিনি একাই ১৯৭২ থেকে ১৯৭৬ সাল পর্যন্ত বইমেলা চালিয়ে যান।

তিনি ১৯৭৫ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণে বই বিক্রির অনুমতি লাভ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণের মাধ্যমে নতুনমাত্রা লাভ করতে সক্ষম হন। ১৯৭৬ সালের দিকে অন্যান্যরাও অনুপ্রাণিত হয়ে তার সঙ্গে যোগ দিতে শুরু করেন। এরপর ১৯৭৮ সালে সরকার একে পূর্ণাঙ্গ বইমেলা হিসেবে স্বীকৃতি দান করেন। ১৯৭৯ সালে বইমেলার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয় চিত্তরঞ্জন সাহার প্রতিষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ পুস্তক বিক্রেতা ও প্রকাশক সমিতি’।

১৯৮৪ সালে গ্রন্থমেলার জন্য সরকারিভাবে আইন পাস করে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে একুশে ফেব্রুয়ারিতে শহিদ হওয়া সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ আরও অনেক শহিদদের স্মরণে নামকরণ করা হয় ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’। সেই সময় থেকে আজ পর্যন্ত মহাসমারোহে চলেছে গ্রন্থমেলার পথচলা। শুরু থেকে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসকে কেন্দ্র করেই বইমেলার বিস্তৃত ছিল, ২০১৪ সাল থেকে অমর একুশে গ্রন্থমেলা সম্প্রসারণ করে বাংলা একাডেমি প্রাঙ্গণসহ সোহরাওয়ার্দী উদ্যান পর্যন্ত সম্প্রসারিত হয়েছে। বর্তমানে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রকাশনা সংস্থা তাদের নিজস্ব বই ও প্রকাশনা নিয়ে অংশগ্রহণ করে থাকে; তন্মধ্যে ভারত, রাশিয়া ও জাপানসহ আরও অন্যান্য দেশের অংশগ্রহণ লক্ষ্য করা যায়।

বইমেলাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন প্রকাশক একে অন্যের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের সুযোগ পান। বই প্রকাশ সংক্রান্ত বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলোচনারও অবকাশ পান। এছাড়া পাঠকদের চাহিদা সরাসরি লক্ষ করে নতুন নতুন বই প্রকাশের ক্ষেত্রে তারা তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারেন।

বইমেলায় নানা ধরনের প্রকাশক স্টল খোলেন। এক এক প্রতিষ্ঠান এক একধরনের বই পছন্দ করে। ফলে ক্রেতারা তাদের অভিরুচি অনুযায়ী স্টল নির্বাচন করে বই কিনতে পারে। এছাড়া মেলা প্রাঙ্গণের সীমানায় অসংখ্য ধরনের বই পাওয়া যায় বলে ক্রেতাদের পক্ষে অল্প আয়াসে নিজ নিজ চাহিদা অনুযায়ী বই সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। বইমেলার সুরুচিসম্মত ও মনোরম পরিবেশ ক্রেতাদের সৌন্দর্য পিপাসাকে উদ্বুদ্ধ করার মাধ্যমে বই কেনার ব্যাপারে উৎসাহ জোগায়। এছাড়া বইমেলায় বইয়ের মূল্যের দিক থেকে ক্রেতাদের কিছুটা কমিশন দেয়া যেতে পারে।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ