সনাতন ধর্মাবলম্বীদের কাছে সরস্বতী হচ্ছেন বিদ্যার দেবী। সরস্বতী সৃষ্টিদেবতা ব্রহ্মার সহধর্মিণী এবং বিষ্ণুপত্নী লক্ষ্মী ও মহেশ্বরজায়া পার্বতীর সঙ্গে একযোগে ত্রিদেবী নামে পরিচিতা। সরস্বতী প্রাচীনতম হিন্দু ধর্মগ্রন্থ বেদসমূহের প্রসূতি। সরস্বতী শব্দটি ‘সার’ এবং ‘স্ব’ দুটি শব্দের সমন্বয়ে গঠিত। সেই অনুসারে সরস্বতী শব্দের অর্থ যিনি কারও মধ্যে সারজ্ঞান প্রকাশ করেন।
আবার সরস্বতী শব্দটি সংস্কৃত ‘সুরস বতি’ শব্দ থেকে এসেছে যার অর্থ হচ্ছে জলের আধার। সরস্বতী সাক্ষাৎ দেবী মূর্তি এবং নদী-দুরূপেই প্রকটিত। ঋগবেদে বর্ণিত করা হয়েছে— অম্বিতমে নদীতমে সরস্বতী। /অপ্রশস্তা ইব স্মসি প্রশস্তিমন্ব নস্কৃধি।/অর্থাৎ “মাতৃগণের মধ্যে শ্রেষ্ট, নদীগণের মধ্যে শ্রেষ্ট, দেবীগণের মধ্যে শ্রেষ্ট হে সরস্বতী, আমরা অসমৃদ্ধের ন্যায় রয়েছি, আমাদের সমৃদ্ধশালী কর।” সরস্বতী দেবী জ্ঞান, সংগীত, কলা এবং বিদ্যার দেবী।
ঋগ্বেদে বাগ্দেবী ত্রয়ীমূর্তি— ভূ: ভুব: স্ব:, জ্ঞানময়ীরূপে সর্বত্রব্যাপিনী। বিশ্বভুবন প্রকাশ তারই জ্যোতিতে। হূদয়ে সে আলোকবর্তিকা যখন প্রজ্বলিত হয়, তখন জমাট বাধা অজ্ঞানতারূপ অন্ধকার যায় দূর হয়ে। অন্তরে, বাইরে সর্বত্র তখন জ্বলতে থাকে জ্ঞানের পুণ্য জ্যোতি। এ জ্যোতিজ্ঞানই ব্রহ্মজ্ঞান, এই জ্যোতিই সরস্বতী। আলোকময়ী, তাই তিনি সর্বশুক্লা। তিন গুণের মধ্যে তিনি সত্ত্বগুণময়ী, অনন্ত জ্ঞানময় ঈশ্বরের বাক্শক্তির প্রতীক বাগ্দেবী।
সরস্বতী বিধৌত ব্রহ্মাবর্ত ভূমি বেদ-বেদাঙ্গ-বেদান্ত আশ্রয় করে সাধনা করত আশ্রমবাসী ঋষিগণ। সেই ভাবটি নিয়েই দেবী ‘পুস্তক হস্তে’, গ্রন্থ রচনার সহায়ক লেখনীটিও তার সঙ্গে। মার্ক্লেয় পুরাণে শ্রীশ্রীচণ্ডী উত্তরলীলায় শুম্ভ নিশুম্ভ নামক অসুরদ্বয়কে বধ করার সময় দেবীর যে মূর্তির কল্পনা করা হয়েছিল তা ছিল মহাসরস্বতী।
স্কন্দ পুরাণে প্রভাসখণ্ডে দেবী সরস্বতীর নদীরূপে অবতরণের কাহিনী বর্ণিত আছে। বায়ু পুরাণ অনুযায়ী কল্পান্তে সমুদয় জগৎ রুদ্র কর্তৃক সংহূত পুনর্বার প্রজাসৃষ্টির জন্য প্রজাপতি ব্রহ্মা নিজ অন্তর থেকেই দেবী সরস্বতীকে সৃষ্টি করেন। সরস্বতীকে আশ্রয় করেই ব্রহ্মার প্রজাসৃষ্টি সূচনা। গরুড় পুরাণে সরস্বতী শক্তি অষ্টবিধা। শ্রদ্ধা, ঋদ্ধি, কলা, মেধা, তুষ্টি, পুষ্টি, প্রভা ও স্মৃতি। তন্ত্রে এ অষ্টশক্তি যথাক্রমে যোগ, সত্য, বিমল, জ্ঞান, বুদ্ধি, স্মৃতি, মেধা ও প্রজ্ঞা। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভূজা সরস্বতী পূজিত হন। ইনি অক্ষমালা, কমণ্ডলু, বীণা ও বেদপুস্তকধারিণী।
বাংলা তথা পূর্বভারতে সরস্বতী দ্বিভূজা ও রাজহংসের পৃষ্ঠে আসীনা। রাজহংস কেন সরস্বতীর বাহন? কেননা জলে, স্থলে, অন্তরীক্ষে সর্বত্রই হাঁসের সমান গতি, যেমন জ্ঞানময় পরমাত্মা সর্বব্যাপী-স্থলে, অনলে, অনিলে সর্বত্র তার সমান প্রকাশ। সরস্বতী দেবী হিন্দুদের দেবী হওয়া সত্ত্বেও বৌদ্ধ ও জৈনদের কাছেও পুজো পেয়েছেন। গান্ধারে পাওয়া বীণাবাদিনী সরস্বতীর মূর্তি থেকে বা সারনাথে সংরক্ষিত মূর্তিতে এর প্রমাণ মেলে। অনেক বৌদ্ধ উপাসনালয়ে পাথরের ছোট ছোটো মূর্তি আছে তাতে সরস্বতী বীণা বাজাচ্ছেন, অবিকল সরস্বতীমূর্তি। মথুরায় জৈনদের প্রাচীন কীর্তির আবিষ্কৃত নিদর্শনে সরস্বতীর যে মূর্তি পাওয়া গেছে সেখানে দেবী জানু উঁচু করে একটি চৌকো পীঠের ওপর বসে আছেন, এক হাতে বই। শ্বেতাম্বরদের মধ্যে সরস্বতী পুজোর অনুমোদন ছিল। জৈনদের চব্বিশজন শাসনদেবীর মধ্যে সরস্বতী একজন এবং ষোলজন বিদ্যাদেবীর মধ্যে অন্যতমা হলেন সরস্বতী। ঋগ্বেদের যুগে গঙ্গা যমুনা ছিল অপ্রধান নদী, সরস্বতী নদীই ছিল সর্বপ্রধান ও সর্বাপেক্ষা প্রয়োজনীয়। এর তীরে ছিল প্রসিদ্ধ তীর্থভূমি।
সরস্বতী ও দৃষদ্বতীর মধ্যস্থান দেবনির্মিত স্থান হিসেবে বিবেচ্য হত। ব্রাহ্মণ ও মহাভারতে উল্লেখিত সারস্বত যজ্ঞ এই নদীর তীরে অনুষ্ঠিত হত। মহাভারত রচনা হওয়ার আগেই রাজপুতানার মরুভূমিতে সরস্বতী নদী অদৃশ্য হয়ে গেলেও কয়েকটি স্রোতধারা অবশিষ্ট ছিল। এ স্রোতধারা হলো চমসোদ্ভেদ, শিবোদ্ভেদ ও নাগোদ্ভেদ। অমূল্যচরণ বিদ্যাভূষণের মতে, বৈদিক সরস্বতীর লুপ্তাবশেষ আজও কচ্ছ ও দ্বারকার কাছে সমুদ্রের খাড়িতে গিয়ে মিলিত হয়েছে। সরস্বতী নদীর বিনাশ ঘটেছিল অবশ্যই বৈদিক যুগের শেষভাগে, একমতে খ্রিষ্টের দেড় হাজার বছরেরও আগে। মহাভারতে আছে যে নিষাদদের চোখের আড়ালে থাকার জন্য বিনাশণ নামক স্থানে মরুভূমিতে অদৃশ্য হয়েছে। নদীর স্থানীয় নামই এই ঐতিহ্য বহন করছে। আবার অনেকে বলেন, সিন্ধুনদই সরস্বতী। সরস্বতী ও সিন্ধু দুটি শব্দের অর্থই নদী। সরস্বতী বৈদিক দেবী হলেও সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি আধুনিককালে প্রচলিত হয়েছে।
প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকরা সরস্বতীসদৃশা দেবী বাগেশ্বরীর পূজা করতেন বলে জানা যায়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে পাঠশালায় প্রতি মাসের শুক্লা পঞ্চমী তিথিতে ধোয়া চৌকির ওপর তালপাতার দোয়াত-কলম রেখে পূজা করার প্রথা ছিল। শ্রীপঞ্চমী তিথিতে ছাত্ররা বাড়িতে বাংলা বা সংস্কৃত গ্রন্থ, শ্লেট, দোয়াত ও কলমে সরস্বতী পূজা করত। আধুনিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরস্বতী পূজার প্রচলন হয় বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সম্পন্ন করা হয় সাধারণ পূজার আচারাদি মেনে। তবে এ পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর প্রয়োজন হয়, যেমন অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত-কলম ও যবের শিষ, বাসন্তী রঙের গাঁদা ফুল।
লোকাচার অনুসারে ছাত্রছাত্রীরা পূজার আগে কুল ভক্ষণ করে না। পূজার দিন লেখাপড়া নিষেধ। ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণ অনুযায়ী গোলোকে শ্রীকৃষ্ণের কণ্ঠদেশ থেকে দেবী সরস্বতী উদ্ভূতা হয়েছিলেন। চৈতন্য ভাগবত (আদিলীলা ২/৯-১৪) তে বর্ণনা করা হয়েছে- পূর্বে ব্রহ্মা জন্মিলেন নাভিপদ্ধ হৈতে।/তথাপিও শক্তি নাই কিছুই দেখিতে। /তবে যবে সর্ববারে লইলা শরণ, তবে প্রভু কৃপায় দিলেন দরশন। /তবে কৃষ্ণ কৃপায় স্ফুরিত সরস্বতী। /তবে সে জানিলা সর্ব অবতার স্থিতি। এক সময় শ্রীব্রহ্মা সৃষ্টিকার্যের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন। শান্তভাবে ধ্যানস্থ আছেন। কী করবেন, কী করা উচিত চিন্তা করছেন। এমন সময় তার শরীর এক দেবী মূর্তির আবির্ভাব হলেন। তিনি সরস্বতী।
লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক, সুনামগঞ্জ।
নয়া শতাব্দী/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ