দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখতে জোরদার চলছে মনিটরিং। মনিটরিং কর্মকাণ্ডটা কার্যত কতটা ফলপ্রসূ তা দেখার বিষয়। পদ্মা নদীর উৎপত্তি হিমালয়ের গঙ্গোত্রী হিমবাহ থেকে। গঙ্গোত্রী হিমবাহটি যদি বিষ মিশ্রিত জল দেয়, তাহলে কি গোয়ালন্দঘাটে বিষমুক্ত জল পাওয়া যাবে? নিশ্চয়ই না।
ধরে নেয়া যাক, আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে গোয়ালন্দঘাটে জল পরিশোধন করে জলকে বিষমুক্ত করা হলো, তাহলে এ প্রক্রিয়ায় কতদিন জল বিশুদ্ধ রাখা যাবে? এ বিষয়টাও ভেবে দেখা দরকার। বর্তমানে বাজার মনিটরিং দলের কার্যক্রমটা একটু দেখা যাক, বাজার মনিটরিং দল রাজশাহীর সাহেব বাজার, ঢাকার মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট, ময়মনসিংহের স্বদেশি বাজার, চট্টগ্রামের বদ্দহারহাটসহ দেশের জেলা ও বিভাগীয় খুচরা বাজারে জোরদার মনিটরিং চালাচ্ছে।
ভ্রাম্যমাণ বাজার মনিটরিং দলগুলো, ভারতীয় চ্যানেলে প্রচারিত ধারাবাহিক সিআইডির ক্রাইমবিষয়ক নাট্যধারায় স্টাইলে অভিযান চালায়। এদের অভিযানে জেল জরিমানা করা হচ্ছে। তারপরও দেখা যায় দলটি চলে যাওয়ার পর যেই লাউ সেই কদু এই প্রবাদের মতো হয়ে যায়। অর্থাৎ বাজারে পণ্যের মূল্য আবার অনিয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে।
তার কারণ কিন্তু একটাই উৎসমুখনওগাঁর আড়ৎ নিয়ন্ত্রণে আনতে না পারলে বাজারের পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রিত হবে না। সম্প্রতি বাজার মনিটরিং দলের অভিযানে দেখা গেছে- মালিকদেরকে জরিমানা করা হয়েছে। এর ফলে চালের দাম কিছুটা কমলেও আশানুরূপ ফল হয়নি। কারণ চালের বাজারের মূল উৎসমুখ এখন আর আগেকার দিনের মতো নওগাঁ বা দিনাজপুরের চালকল মালিকদের কাছে নেই। এ বাণিজ্যটা চলে গেছে এখন বহুজাতিক কোম্পানির মতো গড়ে ওঠা দেশীয় বিলিনারী কোম্পানির মালিকদের হাতে। প্রাণ গ্রুপ, স্কয়ার গ্রুপ এ ধরনের বড় বড় প্রতিষ্ঠান এখন চাল, আটা, সুজি, লবণ, দুধ তৈরি করে।
অর্থাৎ এরা খাদ্য পণ্যের বাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত। সারা বছর পাইকারি বাজারে যে পরিমাণ ধান চাল কেনাবেচা হয়, তা এ ধরনের গ্রুপ অব কোম্পানির মালিকরা ইচ্ছে করলে একদিনেই কিনে ফেলতে পারে। কারণ এদের এত পরিমাণের মূলধন রয়েছে। চালের বাজার উঠানামার ক্ষেত্রে নওগাঁর আড়ৎদারদের চাইতে বড় ভূমিকায় এখন এ কোম্পানিগুলো।
কাঁচা শাকসবজির ক্ষেত্রে উঠানামার বিষয়ে মধ্যস্বত্বভোগীর ভূমিকাটা বড় তবে দেশে এখন ডিপার্টমেন্টাল স্টোরের নামে যে দোকানগুলো গড়ে উঠেছে তাদেরও ভূমিকাটাও কিন্তু কম নয়। কারণ এরা একটু বেশি দাম দিয়ে মধ্যস্বত্বভোগীদের কাছ থেকে ভালো খাদ্য পণ্যগুলো কিনে নেয়। তারপর নিজেরা ফিক্সরেট বেঁধে দেয়। এখানে যে বিষয়টা হয় তা হলো- এ ডিপার্টমেন্টাল স্টোরগুলোর যারা ভোক্তা তারা অনেক ধনী। তাই তাদের বেশি দামে কিনতে কোনো সমস্যা হয় না।
অপরদিকে এর প্রভাবে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেট বা রাজশাহীর সাহেব বাজার কাঁচা শাকসবজির খুচরা বিক্রেতারা ওই মধ্যস্বত্বভোগীর (পাইকারের) কাছ থেকে বেশি দামে কিনে বিক্রি করে। ফলে দেখা যায় নিম্নবিত্ত মানুষেরও একটু বেশি দামে কাঁচা শাকসবজি কিনতে হয়। তবে এ বিষয়টি প্রতিদিনের দৃশ্য না যেদিন গ্রাম থেকে কম পরিমাণে কাঁচা শাকসবজি আসে ওইদিন এর প্রভাবটা বেশি পড়ে।
উপরোল্লিখিত বিষয়ের আলোকে বিশ্লেষণ করলে বোঝা যাবে যে, বাজার নিয়ন্ত্রণে কোথায় মনিটরিং বাড়ানো দরকার তা ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের একটু ভাবা উচিত। আজ থেকে ৪০-৫০ বছর আগে চালের বাজার অস্থিতিশীল হতো না। কারণ কৃষক পর্যায়ে চাল উৎপাদন করা হতো, পাইকারিরা কৃষকদের কাছ থেকে চাল কিনে এনে খুচরা বাজারে বিক্রেতার কাছে বিক্রি করতেন আর খুচরা বিক্রেতারা বিক্রি করতেন ভোক্তার কাছে।
তখনকার দিনে আজকের মতো এত শত সরকারি কর্মকর্তা এ বিষয়গুলো মনিটরিং করতেন না তারপর বাজার থাকত স্থিতিশীল। তবে খরা বা বন্যাজনিত কারণে ফসল উৎপাদন ব্যাহত হলে চালের দাম বেড়ে যেত। আবার অধিক ধান উৎপাদন হলে কম মূল্যে পাওয়া যেত চাল। আর ধান উৎপাদনের মৌসুমে চালের বাজার অনেক কম থাকত স্বাভাবিক বাজারের চেয়ে।
ওই সময় বাজার নিয়ন্ত্রণ হতো অনেকটা প্রকৃতির ওপর নির্ভর করে। আজ থেকে ৪০ বছর আগে এখনকার দিনের মতো পরিবহন সুবিধাও ছিল না তারপরও কৃত্রিম সংকট তৈরিটা হতো খুবই কম। বাংলাদেশের বর্তমান বাজার ব্যবস্থায় গড়ে উঠেছে সিন্ডিকেট। কেন এ সিন্ডিকেট গড়ে উঠল, আসলে মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বিশ্বজুড়ে বণিক পুঁজির প্রসার ঘটেছে। এ ধরনের পুঁজি মুনাফার জন্য সব কিছু করতে পারে।
এ পুঁজিওয়ালারা সাধারণত অধিক ভোক্তা যে সকল পণ্যগুলো ভোগ করে এ ধরনের বাজারে এরা পুঁজি বিনিয়োগ করে। বাংলাদেশের কৃষিতে উৎপাদিত পণ্যের ভোক্তার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, তাই এ বাজার থেকে মুনাফা লাভের উদ্দেশ্য বিভিন্ন গ্রুপ অব কোম্পানি গুলো বিনিয়োগ করছে কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রগুলোতে।
এদের বিনিয়োগের ফলে ক্ষুদ্র পুঁজিওয়ালাদের কৃষিপণ্যের যে ব্যবসা ছিল তা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারছে না। এরা নিজেদের ব্যবসা গুটিয়ে নিয়েছেন, এখন বড় বড় গ্রুপ অব কোম্পানির হাতে কৃষি পণ্যের বাজার। যেমন মাছ আর এখন কৃষক পর্যায়ে উৎপাদন হয় না। বিভিন্ন এলাকায় কোটিপতিরা মাছের খামার তৈরি করে মাছ উৎপাদন করছে। অপরদিকে এদেরই একটা অংশ মাছের খাবার বানায়। অনুরূপভাবে মুরগি, ডিম, গরু, ছাগল, হাঁস ইত্যাদি উৎপাদন হচ্ছে খাবার ব্যবস্থায়।
এ সমস্ত কৃষি ক্ষেত্রগুলোতে ক্ষুদ্র বা প্রান্তিক পর্যায়ের পুঁজিওয়ালাদের এখন আর অভিগম্যতার সুযোগ নেই। যার জন্য বৃহৎ পুঁজিওয়ালারা নিজেদের ইচ্ছামাফিক এখন কৃষিপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করছে। বরেন্দ্র অঞ্চলের বড় বড় কৃষি মাঠগুলো প্রান্তিক ও মাঝারি পর্যায়ের কৃষকদের কাছ থেকে লিজ নিয়ে নিচ্ছেন বড় বড় কোম্পানির মালিকরা।
তারাই এখন এখানে উৎপাদন করছে কৃষির বিভিন্ন খাদ্যজাত পণ্য। তাদের হিসাবে উৎপাদিত পণ্যের দাম তারা নির্ধারণ করেন। তাই হঠাৎ হঠাৎ পণ্যের মূল্য উঠানামা করে কারণ তারা এ কলকাঠি নাড়েন নিজেদের ইচ্ছায়। বাংলাদেশের বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হলে বিজনেস সেগমেন্টেশন দরকার।
কারা কোন ব্যবসা করতে পারবে বা কোন কোন পণ্য উৎপাদন করতে পারবে তা নির্ধারণ করে দেয়া উচিত সরকারের। সকল কাজের কাজী একজন হওয়াটা ঠিক না। ধান চাল অর্থাৎ যারা খাদ্যপণ্য উৎপাদন করবে তাদের একটা তালিকা নির্ধারণ করে দেয়া। এই তালিকাভুক্তরা অন্য ব্যবসায় বা উৎপাদনে জড়িত থাকতে পারবে না। ওষুধ, বস্ত্র, জুতাসহ অন্যান্য পণ্যের ক্ষেত্রে এটা নির্ধারণ করা উচিত।
তাই সরকারের উচিত বিষয়গুলো ভেবে বাজার মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা জোরদার করার পাশাপাশি বিজনেস সেগমেন্টেশনের একটি পরিকল্পনা তৈরি করা এবং তা অচিরেই বাস্তবায়ন করা। লেখক: কলাম লেখক
নয়া শতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ