সম্প্রতি ভুল চিকিৎসায় বেশ কয়েকটি মৃত্যুর ঘটনায় সারা দেশের মানুষকে ভাবিয়ে তুলেছে। গত ৩১ ডিসেম্বর রাজধানী বাড্ডার সাতারকুল এলাকার ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালে আয়ানকে নিয়ে যায় তার পরিবার। পাঁচ বছর বয়সি আয়ানকে অ্যানেস্থেসিয়া দেয়ার পর আর জ্ঞান ফেরেনি তার। পরে তাকে গুলশানের ইউনাইটেড হাসপাতালে নিয়ে লাইফ সাপোর্টে রাখা হয়।
গত ৭ জানুয়ারি সেখানেই মৃত্যু হয় শিশুটির। শিশু আয়ানের মৃত্যুর পর জানা যায়, সাতারকুলে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল সরকারি অনুমোদন ছাড়াই সব ধরনের চিকিৎসা কার্যক্রম চালিয়ে আসছিল।
শিশু আয়ান আহমেদের মৃত্যুর ঘটনায় হাইকোর্টে ৯ জানুয়ারি রিট দায়ের করা হয়। রিটে শিশু আয়ানের চিকিৎসার দায়িত্বে থাকা চিকিৎসকদের সনদ বাতিল ও ইউনাইটেড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশনা চাওয়া হয়। ইউনাইটেড হাসপাতালে শিশুটির মৃত্যুর ঘটনায় সারা দেশে আলোচনা ও সমালোচনার ঝড় ওঠে।
যার ফলে ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ অ্যান্ড হাসপাতালের সব ধরনের কার্যক্রম বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এ ছাড়া সারা দেশে লাইসেন্স ও অনুমোদনহীন হাসপাতালের তালিকা তৈরি করে তিন মাসের মধ্যে তা জমা দিতে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকে নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। কিন্তু আমাদের প্রশ্ন হলো- শুধু অনুমোদনহীন হাসপাতালের তালিকা হাইকোর্টে জমা দিলেই কি সব কাজ শেষ?
মহামান্য হাইকোর্ট যে রায় দিয়েছেন তা বাস্তবায়নের কোনো লক্ষণ এখনো নেই। তাহলে এর পরবর্তী অবস্থা কী হবে? ইউনাইটেড হাসপাতালের বিরুদ্ধে অনেক অভিযোগ বেশ আগে থেকেই। কিন্তু দিনের পর দিন অনিয়ম করার পরেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাহলে এর শেষ কোথায়?
এর আগে করোনার সময়ে ক্লিনিকগুলোর অবস্থা দেখে স্পষ্ট হয়েছে যে, দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার চিত্র কেমন? মানুষ পারতপক্ষে একান্ত সংকটে না পড়লে ডাক্তারের কাছে যেতে চায় না। অনেক টেস্টের হাঙ্গামা, সিরিয়াল সংকট, তারপর ডাক্তার রোগীর কথা শুনতে অপারগতা প্রকাশ করে। বরং অনেক ওষুধ লিখে দেয় যা কেনা আসলে সাধ্যাতীত ব্যাপার। এ তো গেল এক ঘটনা।
আরেক সংকট হলো- বড় হাসপাতালে কোনো উপায়ান্তর না থাকলে রোগী যায় কিন্তু সেখানে তার চিকিৎসা মেলে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায় ডাক্তার নেই বা ব্যস্ত। ডাক্তারের জন্য অপেক্ষার মধ্যেই একাধিক দালালের খপ্পরে পড়ে রোগী বা রোগীর স্বজনরা। রোগীকে সুচিকিৎসার কথা বলে নেয়া হয় ক্লিনিকে। কিন্তু সেই ক্লিনিকে নিয়ে গেলে দেখা যায়, ভুল চিকিৎসার কারণে রোগীর মৃত্যু ঘটে। তারপরের ঘটনা বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে এসেছে ও আসছে।
বিশ্বে প্রত্যেকটি দেশে স্বাস্থ্য হচ্ছে সেবা। একেকজন চিকিৎসক সেখানে সেবাকে ব্রত হিসেবে নেন। আমাদের দেশে দু-একজন ছাড়া সবই বাণিজ্যিক। ডাক্তার-নার্সদের এ বাণিজ্যিক মানসিকতার কারণে আমাদের চিকিৎসা ব্যবস্থাও সিন্ডিকেটের করায়ত্তে। সারা দেশে সরকারের কোনো নিবন্ধন ছাড়াই ব্যাঙের ছাতার মতো গড়ে উঠছে ক্লিনিক-বেসরকারি হাসপাতাল। প্রশ্ন হলো- সেখানে ডাক্তার, নার্স না গেলে তা কোনোমতেই চলত না। সুতরাং সহজেই অনুমেয় আমাদের চিকিৎসা বিভাগের চিত্রটা কী? সারা দেশে নিবন্ধনকৃত বেসরকারি হাসপাতাল-ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টার ও ব্লাডব্যাংকের সংখ্যা প্রায় ৩৫ হাজারের মতো। এর মধ্যে অনেক প্রতিষ্ঠান একাধিকবার নিবন্ধন করেছে। অনেকে নিবন্ধন নম্বর নিলেও প্রতিষ্ঠান আলোর মুখ দেখেনি। অথচ চিকিৎসা কার্যক্রম চালাচ্ছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) ডা. আবু হোসেন মো. মঈনুল আহসান বলেছেন, ‘সারা দেশে নিবন্ধনের বাইরে কতটি হাসপাতাল ও ক্লিনিক রয়েছে এ মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। লাইসেন্সের জন্য আবেদনের আগমুহূর্ত পর্যন্ত আমরা জানতে পারি না সেটি বৈধ না অবৈধভাবে চলছে। আবার বৈধতা যাচাইয়ে অধিদপ্তরের নিজস্ব জনবল (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) বা তেমন কিছু নেই। এই কি আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থা।
চিকিৎসা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৮২ সালের মেডিকেল অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস অ্যান্ড ল্যাবরেটরিস অর্ডিন্যান্স অনুযায়ী, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমোদন ছাড়া কোনো হাসপাতাল, ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টার চালানোর সুযোগ নেই। কিন্তু বৈধ-অবৈধ অনেক হাসপাতালে প্রায়ই ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যু হচ্ছে।
গত একযুগ ধরে হাসপাতাল ও অবৈধ ক্লিনিক নিয়ে এত লেখালেখি। এত দিন পর স্বাস্থ্য অধিদপ্তর জানিয়েছে, অবৈধ হাসপাতালের কোনো তথ্য নেই তাদের কাছে। তাদের কথায় এমনটাই প্রমাণিত হয় যে, যুগ যুগ ধরে স্বাস্থ্যসেবায় অনিয়ম চলছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কিংবা সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী দেশের অবৈধ হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর দিকে কি কোনোই নজর দেননি? সুন্নতে খতনা করাতে শিশু আয়নাকে হাসপাতালে আনায় টনক নড়েছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের।
বেসরকারি সব হাসপাতাল ও ক্লিনিক নিয়ে অভিযোগের পাহাড় রয়েছে। অনভিজ্ঞ চিকিৎসক, দাইয়ের মাধ্যমে প্রসব, বিল পরিশোধের অনাদায়ে লাশ আটকে রাখাসহ ভুল চিকিৎসায় রোগীর মৃত্যুর অভিযোগ পর্যন্ত রয়েছে এসব ক্লিনিকের বিরুদ্ধে। এসব হাসপাতালে সাধারণ জনগণকে সেবার নামে হেনস্তা করার অভিযোগ অনেক পুরোনো। চিকিৎসাসেবার নাম করে এগুলো খোলা হলেও এসব বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকগুলোর বিরুদ্ধে অভিযোগ অন্তহীন। মুনাফা লুটে রাতারাতি টাকাওয়ালা হওয়াটাই এদের লক্ষ্য। এই যদি হয় চিকিৎসা বিভাগের চিত্র, তাহলে আগে ক্লিনিক ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোর চিকিৎসা করা প্রয়োজন।
দেশের মধ্যে আইনকানুন থাকতে এত বড় একটা অব্যবস্থা টিকে থাকতে পারে না। সেদিক থেকে ইউনাইটেড হাসপাতাল অনেক এগিয়ে। পুঁজির অসম বিকাশের কারণে মানুষের চিকিৎসার চেয়ে বড় হয়ে উঠেছে লোক দেখানো বিষয় আসা। যে জায়গাটি দখল করেছে ইউনাইটেড হাসপাতাল। এখানে এলেই যেন সবার স্বস্তি। জলের মতো টাকা খরচ হয় এখানে। চিকিৎসার মান সে হারে কেমন তা বারবার গণমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। তারপরও এখানে যাওয়াটাই সম্মানের ব্যাপার। কিন্তু আয়ানের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে যেন সবার চোখ চড়কগাছ হয়ে গেছে।
ভুল চিকিৎসায় অসংখ্য মৃত্যুর ঘটনা সামনে রেখে সারা দেশে অবৈধভাবে পরিচালিত সব বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার বন্ধ হচ্ছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রীর নির্দেশে এ লক্ষ্যে কাজ শুরু করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেন বলেছেন, ‘আমরা এবার স্বাস্থ্যসেবাকে গ্রাম পর্যায়ে পৌঁছে দিতে কাজ করব। ঢাকা মেডিকেলে যে মানের ডাক্তার চিকিৎসা দিচ্ছে, সে মানের ডাক্তার জেলা-উপজেলা হাসপাতালে পাঠানো গেলে তো কাজটি সহজ হয়ে যায়। আর ডাক্তারদের সুযোগ-সুবিধা ভালো করলে তারাও নিশ্চয়ই জেলা-উপজেলা পর্যায়ে কাজ করতে আগ্রহী হবেন।
সব মিলিয়ে আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে দেশের মানুষের স্বাস্থ্যসেবার মানোন্নয়নে কাজ করা এবং সেটা আমরা করব।’ স্বাস্থ্যমন্ত্রীর এ উদ্যোগকে স্বাগত জানাই। রাজধানীর ইউনাইটেড মেডিকেল কলেজ হাসপাতালসহ সম্প্রতি দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলায় বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিকে ভুল চিকিৎসায় রোগী মৃত্যুর ঘটনায় উদ্বিগ্ন সবাই। আর এসব ঘটনাকে সামনে রেখেই সারা দেশে শুরু হয়েছে অভিযান। এতে যেসব প্রতিষ্ঠানের কাগজপত্র সঠিক পাওয়া যাচ্ছে না সেগুলোকেই সিলগালা করে দেয়া হচ্ছে। পাশাপাশি অনেক প্রতিষ্ঠানকে করা হচ্ছে জরিমানা।
বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার রোগী বিদেশে যায়। ভারতে যায় বড় একটা অংশ। কারণ শুধুমাত্র চিকিৎসায় আস্থার সংকট। এ সংকট দূরীকরণে সরকারের বর্তমান পদক্ষেপ প্রশংসনীয়। সরকারের এ পদক্ষেপের বাস্তবায়ন ঘটুক। খোল-নলচে বদলে যাক চিকিৎসা ব্যবস্থার। আয়ান হত্যার বিচারের মধ্য দিয়ে চিকিৎসা জগতের সব অন্ধকার দূর হোক। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রতি আস্থা ফিরুক মানুষের। আলোর ছোঁয়ায় কাটুক আঁধার।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
নয়াশতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ