১৯৭১ সালে ৩০ লক্ষ শহিদের রক্ত দিয়ে লিখিত বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন বাংলাদেশ সংবিধানের ২৭ নং অনুচ্ছেদে স্পষ্ট উল্লেখ্য রয়েছে যে আইনের দৃষ্টিতে সবাই সমান। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়, আইন সবার জন্য সমান। হোক সে গরীব বা ধনী এবং অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন। সমাজ এবং রাষ্ট্রে অন্যায় করে পার পেয়ে যাওয়ার কোনো ধরনের সুযোগ নেই। স্বাধীন বিচার বিভাগ সংবিধানের আলোকে স্বাধীনভাবে বিচারকার্য করার মধ্য দিয়ে সংবিধানের বাস্তবিক প্রয়োগ করে যাচ্ছে সবার জন্য সমানভাবে। গতকাল স্বাধীন বিচার বিভাগের বিচারক কর্তৃক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের অতীতে করা সকল অপকর্মের যে সাজা দেওয়া হয়েছে তা স্পষ্টতই আইন মেনে করা হয়েছে। কেউ যে আইনের ঊর্ধ্বে নয় এবং বিচার বিভাগ যে সম্পূর্ণ স্বাধীন এই রায় তারই প্রমাণ বহন করছে।
প্রসঙ্গ যে, শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের করা মামলায় ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতের বিচারক বেগম শেখ মেরিনা সুলতানা গতকাল সোমবার বিকেলে রায় দেন। রায়ে গ্রামীণ টেলিকমের চেয়ারম্যান ও নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসসহ চারজনকে ছয় মাস করে কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একই সঙ্গে প্রত্যেককে ৩০ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাথে সাজাপ্রাপ্ত অপর তিনজন হলেন গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুর জাহান বেগম ও মো. শাহজাহান। রায় ঘোষণার সময় ড. ইউনূসসহ চারজনই আদালতে উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য, শ্রম আইন ২০০৬ ও শ্রম বিধিমালা ২০১৫ অনুযায়ী, গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক বা কর্মচারীদের শিক্ষানবিশকাল পার হলেও তাঁদের নিয়োগ স্থায়ী করা হয়নি। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক বা কর্মচারীদের মজুরিসহ বার্ষিক ছুটি, ছুটি নগদায়ন ও ছুটির বিপরীতে নগদ অর্থ দেওয়া হয়নি। গ্রামীণ টেলিকমে শ্রমিক অংশগ্রহণ তহবিল ও কল্যাণ তহবিল গঠন করা হয়নি এবং লভ্যাংশের ৫ শতাংশের সমপরিমাণ অর্থ শ্রমিক কল্যাণ ফাউন্ডেশন আইন অনুযায়ী গঠিত তহবিলে জমা দেওয়া হয়নি। গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক বা কর্মচারীদের বিভিন্নভাবে ঠকিয়ে অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছে এই ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ড. মুহাম্মদ ইউনূস এবং তার অনুসারীগণদের এসব কর্মকাণ্ড নিঃসন্দেহে অবৈধ এবং শ্রম আইনের পরিপন্থী। এসব কর্মকাণ্ড নিতান্তই বাংলাদেশের সংবিধান বিরোধী এবং শাস্তিযোগ্য অপরাধের শামিল। সেজন্যই বাংলাদেশ সংবিধান অনুযায়ী তাদের এমন সংবিধান বিরোধী কর্মকাণ্ডের উপযুক্ত সাজা বাংলাদেশের সংবিধান নিশ্চিত করেছে।
এদিকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী বিচারকার্য চলাকালীন বারবার গণমাধ্যমে বলে এসেছেন যে আদালত অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বিচারকার্য পরিচালনা করছে। আসলেই আদালত কতটা দ্রুততায় এই বিচারকার্য পরিচালনা করেছে এই মামলার ঘটনাক্রম থেকে তা প্রমাণিত হয়। ০৯/০৯/২০২১ তারিখে শ্রম আদালতে মামলা দায়ের হবার পর উক্ত মামলা বাতিলের দাবিতে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন দায়ের করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। উক্ত রিট পিটিশন খারিজ হবার প্রেক্ষিতে সুপ্রিম কোর্টে আপিল আবেদন করেন। সেটিও খারিজ হবার পর শ্রম আদালতে মামলার কার্যক্রম তথা চার্জ গঠন করা হয়। উক্ত চার্জ গঠনের বাতিল চেয়ে পুনরায় উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন এবং সেটি খারিজ হবার পর সুপ্রিম কোর্টে আপিল আবেদন করেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেটিও চূড়ান্তভাবে খারিজ হবার পর আবার ২২/০৮/২০২৩ তারিখে অর্থাৎ মামলা দায়েরের প্রায় দুই বছর পর শ্রম আদালতে মামলার সাক্ষ্যগ্রহণ কার্যক্রম শুরু হয়। উক্ত মামলা বাতিলের দাবিতে ড. মুহাম্মদ ইউনূস একাধিকবার উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আপিল দায়ের করেছেন।
যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ায় সেগুলো সুরাহা হবার পরেই মামলাটির নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম চালু হয়। সুতরাং যে অবিশ্বাস্য দ্রুততার কথা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী বলছেন তা যে নির্জলা মিথ্যা এটাই প্রমাণ করছে এই মামলার ঘটনাক্রম। তবে এখানেই শেষ নয়, এই মামলায় সর্বমোট ২১ কার্যদিবসের শুনানি অনুষ্ঠিত হয়। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের আইনজীবী মামলার বাদীকে সর্বমোট ৭ কার্যদিবস জেরা করেন যা নজিরবিহীন। এছাড়াও তিনি ৮ কার্যদিবসের মধ্যে যুক্তি তর্ক উপস্থাপন করেন। এতো দীর্ঘসময় যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের নজির শ্রম আইন সংক্রান্ত কোন মামলার অতীত কোনো ইতিহাসে তা কখনো দেখা যায়নি। সেক্ষেত্রে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ড. মুহাম্মদ ইউনূস-এর আইনজীবী আদালতে ন্যায্য সুযোগ নয় বরং প্রয়োজনের চেয়ে অধিক সুযোগ পেয়েছেন তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের জন্য। কিন্তু তিনি আসামিদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগসমূহ খণ্ডনে সম্পূর্ণরূপে ব্যর্থ হয়েছেন। যার ফলশ্রুতিতেই গতকাল ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে করা উক্ত মামলার এমন এক যুগান্তকারী রায় এসেছে। এই রায় নিঃসন্দেহে বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বাধীন বিচার বিভাগ কর্তৃক নজিরবিহীন রায়গুলোর মধ্যে অন্যতম একটি রায়।
এবার চলুন এই রায় কেন এতটা নজিরবিহীন তা জেনে নেওয়া যাক। কিছুদিন পূর্বে আন্তর্জাতিক অগ্রগতিতে শূন্য দারিদ্র্য, শূন্য বেকারত্ব এবং শূন্য নেট কার্বন নিঃসরণে ড. ইউনূসের কাজ সবার জন্য অনুকরণীয় এমন প্রশংসা করে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে অনেক নেতারা মানবাধিকারের লঙ্ঘন দাবি করে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিচারকার্য বন্ধের আহ্বান জানিয়ে আসছিলেন বিভিন্নভাবে। কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে তার হাতে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এমন সংবিধান বিরোধী কাজ সম্পর্কে বিশ্বের এই নেতারা একেবারেই অবগত নন। তাদের এবং আমাদের না জানা অনেকের অবগত হওয়ার স্বার্থে দৈনিক সমকাল, ২০০৮ সালের ২রা নভেম্বর সূত্রে জানা যায়, সাতক্ষীরার কলারোয়া উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের রেখা রানী বিশ্বাস (৪০) গ্রামীণ ব্যাংকের খোরদো শাখা থেকে ৩০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে ছিলেন।
ঋণ নেওয়ার মাস দুয়েক পরেই কপোতাক্ষের বেড়িবাঁধ ভেঙে ঘরবাড়িসহ মাঠের ফসল পানিতে নিমজ্জিত হওয়ায় অন্যদের সঙ্গে রেখা রানী বিশ্বাস স্বামী-সন্তান নিয়ে পাকুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নেন। কিন্তু ঋণের কিস্তির টাকা না দেওয়ায় গ্রামীণ ব্যাংকের কর্মীরা রাত ১০টা পর্যন্ত রেখা রানী বিশ্বাসের কাছে বসে থাকেন। তারা থানা পুলিশের ভয়ও দেখান। এক পর্যায়ে গ্রামীণ ব্যাংকের মাঠকর্মীকে রাণী বিশ্বাস প্রশ্ন করলেন, ঋণী সদস্য মারা গেলে তার কিস্তিকে দেয়? মাঠকর্মী বলেন, “তার ঋণ মাফ করে দেওয়া হয়”। পরের দিন পাকুড়িয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্রের পাশে কাঁঠাল গাছে রেখা রানী বিশ্বাসের ঝুলন্ত লাশ দেখা যায়। দারিদ্র্য দূরীকরণের নামে রেখা রাণীর আত্মহত্যা কী তাহলে মানবাধিকারের লঙ্ঘন নয়? এমন হাজার হাজার দরিদ্র মানুষের আত্মহত্যার কারণ হয়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের হাতে দারিদ্র্য দূরীকরণের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক।
শুধু তাই নয় এই গ্রামীণ ব্যাংকের উপর ভিত্তি করে ড. মুহাম্মদ ইউনূস দরিদ্র মানুষের সরলতাকে ব্যবহার করে হয়েছেন কোটি কোটি টাকার মালিক। পেয়েছেন শান্তিতে নোবেল। কিন্তু কোটি কোটি টাকার সম্পদের বিপরীতে এক টাকাও কর দেননি তিনি। এই কর ফাঁকি দেওয়া কী রাষ্ট্র দ্রোহিতা নয়? বিশ্বের কোন রাষ্ট্রে কর ফাঁকিবাজকে সাজা দেয় না? ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেলজয়ী হয়ে বিশ্বে পরিচিতি লাভ করে এই বিশ্ব নেতাদের ছায়ায় থেকে কর ফাঁকি দিয়ে গিয়েছেন বছরের পর বছর। সে একজন দেশীয় কর ফাঁকিবাজ। মানুষের চোখ ফাঁকি দিয়ে অবৈধ উপায়ে অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের মালিক হয়েছেন ঠিকই কিন্তু রাষ্ট্রীয় কোষাগারে তিনি তার হাজার হাজার কোটি টাকার সম্পদের কোনো কর দেননি। অথচ তিনি রাষ্ট্রের সকল সুযোগ সুবিধা ভোগ করেছেন এবং রাষ্ট্রের সম্পদ ব্যবহার করেই এতো সম্পদের মালিক হয়েছেন। ৫ বছরে তিনি প্রায় ১১০০ কোটি টাকার আয়কর ফাঁকি দিয়েছেন। পাশাপাশি দিয়েছেন ১২ কোটি ১৬ লক্ষ টাকার দানকর ফাঁকি যা একজন বিশ্ববরেণ্য অর্থনীতিবিদের থেকে কোনোভাবেই প্রত্যাশিত নয়।
সুতরাং শুধু শ্রমিক আইনের লঙ্ঘন করেই তিনি একজন অপরাধী হননি। সহায়সম্বলহীন দরিদ্র মানুষকে ঋণের নামে উচ্চ সুদের কষাঘাতে নিঃস্ব করে দিয়ে তাদের মৃত্যুর কারণ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত এই গ্রামীণ ব্যাংক। এই গ্রামীণ ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণ সহায়তার নামে গরীব মানুষকে ঠকিয়ে তিনি নিজে হয়েছেন অবৈধ হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক। আর এই হাজার হাজার কোটি কোটি টাকার কর ফাঁকি দেওয়ার মাধ্যমে ঠকিয়েছেন রাষ্ট্রকে। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের এই ধরনের সকল অপকর্মের ফলস্বরূপ এই রায় নিঃসন্দেহে একটি নজিরবিহীন এবং যুগান্তকারী রায়। আমরা আশা করি এই রায়ের পর আর কোনো নোবেলজয়ী কোন ব্যক্তিত্ব এবং তার মত অন্য কোন ব্যক্তিত্ব সহায়তার নামে ঋণ ভারে গরীব মানুষকে নিঃস্ব করে দেওয়ার, শ্রমিক আইন লঙ্ঘন করে শ্রমিক স্বার্থ বিরোধী কোনো কর্মকাণ্ড করার এবং কর ফাঁকি দেওয়ার মাধ্যমে রাষ্ট্র বিরোধী কাজ করার সাহস পাবে না।
বাংলাদেশের সংবিধানের আলোকে সকলেই আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। এই বিশ্বাস সকলের মাঝে তৈরি হবে এই রায়ের মাধ্যমে। কোনো ব্যক্তিই অন্যায় করে পার পাবে না, সে যতই ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হোক। ক্ষমতাবলে বা কারোও সমর্থন নিয়ে আইনের ঊর্ধ্বে গিয়ে অপকর্ম করে রেহাই পাওয়া যায় না এটাই প্রমাণিত হয়েছে যুগান্তকারী এ রায়ের মাধ্যমে। এছাড়াও উক্ত রায় বঙ্গবন্ধুকন্যা জননেত্রী শেখ হাসিনা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় আপোষহীন এবং স্বাধীন বিচার বিভাগ প্রতিষ্ঠায় তাঁর একান্ত প্রচেষ্টারই প্রমাণ বহন করছে। জননেত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে অন্যায় করে রেহাই পেয়ে যাওয়ার সুযোগ কেউ কখনো পায়নি এবং ভবিষ্যতেও পাবেনা।
লেখক : অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়া, উপাচার্য, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় (ববি) ও সাবেক চেয়ারম্যান, ট্যুরিজম অ্যান্ড হস্পিটালিটি ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
নয়া শতাব্দী/এমবি
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ