ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কেমন হতে যাচ্ছে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন

প্রকাশনার সময়: ০৫ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৮:০১

গণতন্ত্রের মূল বিষয় নির্বাচন। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের ভাষায় যা হলো ‘গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা’। এটি ক্ষমতার পালাবদলের একটি সাংবিধানিক প্রক্রিয়া। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচন হতে হয় অবাধ, সুষ্ঠু ও স্বচ্ছ। অংশগ্রহণমূলক এবং সবার কাছে গ্রহণযোগ্য। যে নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও জবরদখল হয়, শাসকগোষ্ঠী তাদের প্রতিদ্বন্দ্বীকে নানা কৌশলের মাধ্যমে নির্বাচনে অযোগ্য করে দেন, জালিয়াতি, ভোট কারচুপি ও জাল ভোটের মাধ্যমে ব্যালট বাক্স ভর্তি করা হয় এবং এর মাধ্যমে ক্ষমতাসীনদের বিজয় নিশ্চিত করা হয়, সেই নির্বাচনের প্রতি মানুষের কোনো আস্থা থাকে না, ভোটাররা ভোট কেন্দ্রমুখী হতে চায় না, ভোট প্রদানের জন্য উৎসাহিত হয় না। সরকারও আক্ষরিক অর্থে সাংবিধানিক বৈধতা পায় না।

যেনতেন টাইপের এমন নির্বাচন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় কাঙ্ক্ষিত নয়, হওয়া উচিতও নয়। গণতান্ত্রিক দেশে নির্বাচন হয় সব দলের, সব লোকের নির্ভয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে, নির্বাচনি পরিবেশ থাকে উৎসবমুখর আমেজে, জনগণ তার ভোটাধিকার ক্ষমতা নিজের পছন্দ অনুযায়ী প্রয়োগ করতে পারে, নির্বাচনের ফলাফল স্বচ্ছ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হয়, মানুষ কথা বলতে পারে, নির্ভয়ে নির্দ্বিধায় সত্য প্রকাশ করতে পারে, জনগণের মর্যাদা ও অধিকার সুরক্ষিত থাকে, প্রশাসন নিরপেক্ষ থাকে, জনকল্যাণে ভূমিকা রাখে।

১৯৬৫ সালে লেখক পান্নালাল দাশগুপ্তের কাছে কবি, সাহিত্যিক অন্নদাশঙ্কর রায় একটি চিঠি লিখেছিলেন। সেই চিঠিতে তিনি লিখেছিলেন, ‘গণতন্ত্রে যে দুটি জিনিস একান্ত আবশ্যক, যে দুটি না হলে ওটা গণতন্ত্রই নয়- সে দুটির একটি হচ্ছে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন, অপরটি নির্বিবাদে ক্ষমতা হস্তান্তর।’ আজ থেকে ৫৮ বছর আগে অন্নদাশঙ্কর রায় এ কথা লিখেছিলেন দুবছর পরে অনুষ্ঠিত ভারতে চতুর্থ লোকসভার সাধারণ নির্বাচনের কথা ভেবে।

ভারতের বয়স তখন সবে মাত্র ১৮ বছর। সেই নবীন রাষ্ট্রের গণতন্ত্র নিয়ে তার মনে কী শঙ্কা জেগেছিল, তা আমার জানা নাই। তবে তার এই উক্তির আশঙ্কা বাংলাদেশের ক্ষেত্রে অনেকটা মিলে যায়। কারণ সর্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে বাংলাদেশ এখনো সত্যিকারের গণতান্ত্রিক দেশ হয়ে উঠতে পারেনি। এখানে বহুবার জনগণের মৌলিক অধিকারগুলো কেড়ে নেয়া হয়েছে। দেশটি একাধিকবার সামরিক বাহিনীর হস্তগত হয়েছে। বেসামরিক রাজনীতিকরাও গণতন্ত্রের লেবাসে মানবতাকে ভূলুণ্ঠিত করেছেন। নিজেদের মতো করে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা বিনির্মাণ করতে গিয়ে গণতন্ত্রের বারোটা বাজিয়েছেন। রাজনীতিকে বাণিজ্যিক পণ্যে রূপ দিয়েছেন। ক্ষমতার রাজনীতি করতে গিয়ে নির্বাচন ব্যবস্থাকে প্রহসনে পরিণত করেছেন। আদর্শিক গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক সংস্কৃতির চর্চা না করে রাজনীতির মাঠকে সহিংস করে গড়ে তুলেছেন।

১৯৩৭ সাল থেকে এ উপমহাদেশের মানুষ নির্বাচন ব্যবস্থার সঙ্গে পরিচিত। ১৯৩৭, ১৯৪৬ ও ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলো তখনকার মানদণ্ডে সুষ্ঠু ও প্রশ্নবিহীন ছিল। ১৯৭০-এর সাধারণ নির্বাচনও সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলকভাবে সম্পন্ন হয়। নির্বাচন নিয়ে সংকট ও ঝামেলা তৈরি হয় মুক্তিযুদ্ধের পর। দেশে ১৯৯০ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত জাতীয় ও স্থানীয় সব নির্বাচনই ছিল প্রশ্নবিদ্ধ। ফলে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের তথা পূর্ণ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবিতে দেশে তুমুল গণ-আন্দোলন হয় এবং সে আন্দোলনের প্রধান ফসল ছিল ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক’ সরকার। যার অধীনে ১৯৯১ সালে এবং পরবর্তীতে সাংবিধানিকভাবে স্বীকৃত ও প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ১৯৯৬, ২০০১ ও ২০০৮ সালে এ তিনটিসহ মোট চারটি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় যা ছিল দেশ-বিদেশে সর্বাধিক প্রশংসিত, গ্রহণযোগ্য। অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা রহিত করায় দেশে দলীয় সরকারের অধীনে আবার জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে থাকে। এতে নির্বাচন ব্যবস্থা পুনরায় প্রশ্নবিদ্ধ ও বিতর্কিত হয়ে ওঠে।

বিশেষ করে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন সেই বিতর্ক প্রবল জোরালো করে তোলে। কারণ উক্ত দুটি নির্বাচন কোনোভাবেই আদর্শিক নির্বাচন ছিল না। এ প্রেক্ষাপটে বিএনপিসহ সমমনা বিরোধী দলগুলো নির্দলীয় নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি তোলে এবং এ মর্মে দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করে যে, আগামীতে দলীয় সরকার বিশেষ করে বর্তমান সরকারের অধীনে তারা কোনো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে না এবং দেশে কোনো নির্বাচন হতেও দেবে না। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ অবশ্য বলতে থাকে নির্বাচন সংবিধান মোতাবেক দলীয় সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হবে। সেটাই হতে চলেছে।

অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন অনুষ্ঠান একটা দেশের গণতন্ত্র চর্চার পথকে কণ্টকমুক্ত করে। গণতান্ত্রিক নিয়ম-নীতি, প্রথা পদ্ধতির চর্চা ও প্রতিপালন দৃষ্টিনন্দন করে গড়ে ওঠে। রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথেষ্ট শক্তিশালী ও হূষ্টপুষ্ট করে তোলে। সরকারকে গণতান্ত্রিক ও জনবান্ধব হতে বাধ্য করে। দুঃখজনক হলেও সত্য, বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীনে যতগুলো নির্বাচন হয়েছে কোনটিই সুষ্ঠু হয়নি এবং কোনো নির্বাচনে জনরায়ের সঠিক প্রতিফলন ঘটেনি।

সুষ্ঠু নির্বাচন হয়নি বলে দেশে গণতন্ত্র তার আদর্শিক ধারায় বিকশিত হতে পারেনি। ক্ষমতাসীন সরকারগুলোও গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা করেনি। ‘জোর যার মুল্লুক তার’-নীতিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে তারা গণতন্ত্রের সৌন্দর্য ও স্বকীয়তা নষ্ট করেছে। নির্বাচন ব্যবস্থার ভিতটা নড়বড়ে করে দিয়েছে। যার কারণে এখানকার গণতন্ত্র পথহারা পথিকের মতো।

১৫ নভেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেন। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী আগামী ৭ জানুয়ারি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। মাঠের বিরোধী দল বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল এ নির্বাচন বয়কট করার ও প্রতিরোধ করার ঘোষণা দিয়েছে। এতে নির্বাচন নিয়ে জনমনে অনিশ্চয়তা ও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। সফল ও সার্থক নির্বাচনের জন্য দরকার সব দলের ও সব মতের লোকের অংশগ্রহণ। দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিসহ ছোটখাটো কয়েকটি দল এবং কিছু কিংস পার্টি অংশ নিচ্ছে। ৩০ নভেম্বর মনোনয়নপত্র দাখিলের শেষ তারিখ ছিল।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানিয়েছে উক্ত দিন সারা দেশে মোট ৩০০টি আসনের বিপরীতে ২৭৪১টি মনোনয়নপত্র জমা পড়েছে এবং ৩০টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। কমিশনের সচিব জানিয়েছেন, মনোনয়নপত্র জমা দেয়ার সময়সীমা আর বাড়ানো হবে না। অর্থাৎ দেশের অন্যতম বৃহত্তম বিরোধী দল বিএনপিসহ সমমনা অনেক বিরোধী দলকে নির্বাচনের বাহিরে রেখে দেশে আবারো একটি একতরফা নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এর মানে সত্যিকার অর্থে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন বলতে যা বোঝায়, তা এবারও হচ্ছে না। এমন একতরফা নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য কতটা শুভকর তা জানি না। বিশেষজ্ঞরা বলছেন এ নির্বাচন জনগণের কল্যাণ বয়ে আনবে না। এ নির্বাচনে জনগণের সুষ্ঠু মতামতের প্রতিফলনও ঘটবে না এবং জনগণের ভোটাধিকারও প্রতিষ্ঠা পাবে না।

বিএনপিসহ সমমনা রাজনৈতিক দলগুলোকে সুকৌশলে নির্বাচনের বাহিরে ঠেলে দিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও ভোটার উপস্থিতি বাড়াতে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ একটি নতুন কৌশলের আশ্রয় নিয়েছে। দলটি এবার সিদ্ধান্ত নিয়েই দলের মনোনীত প্রার্থীর বিরুদ্ধে দলীয় লোকদের বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে দাঁড়ানোর সুযোগ করে দিয়েছে। দলের হাইকমান্ড দলীয় মনোনীত প্রার্থীদেরকে বিদ্রোহী বা স্বতন্ত্র প্রার্থীদের বিষয়ে নমনীয় থাকার নির্দেশও দিয়েছে।

এটা করার কারণ দলীয় কোনো প্রার্থী যাতে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে না পারে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এ ঘটনা এবারই প্রথম। অথচ অতীতে দলীয় সিদ্ধান্তের বাহিরে গিয়ে দলের প্রার্থীর বিরুদ্ধে কেউ প্রার্থী হলে সেটাকে দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। এবার বোধহয় সরকারের বিবেক কিছুটা কাজ করেছে যার কারণে তারা আর ভোটারবিহীন নির্বাচনের তকমা গায়ে জড়াতে চাচ্ছে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তাছাড়া অবাধ, সুষ্ঠু, অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন করার বিষয়ে আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার চাপ এবং আমেরিকার স্যাংশন বা নিষেধাজ্ঞা আরোপের হুমকিও এমন বৈরী সিদ্ধান্ত নেয়ার পিছনে কাজ করেছে বলে বিশেষজ্ঞরা বলছেন।

গণতান্ত্রিক দেশগুলোতে ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনকালে ক্ষমতাসীন সরকার অন্তর্বর্তী সরকার হিসেবে কাজ করে। রুটিন মোতাবেক সরকারের কাজের ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। নির্বাচন পরিচালনায় নির্বাচন কমিশনই মুখ্য ভূমিকা পালন করে। নির্বাচনে যাতে সব দল অংশগ্রহণ করতে পারে এবং লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বজায় থাকে কমিশন সেই পরিবেশ নিশ্চিত করে। তাছাড়া ভোটাররা যাতে তাদের ভোট নিজেদের পছন্দের ব্যক্তিকে স্বাধীনভাবে দিতে পারে কমিশন সেই পরিবেশও সুরক্ষিত করে। উন্নত রাষ্ট্রগুলোসহ প্রতিবেশী অনেক রাষ্ট্র বিশেষ করে ভারত, নেপাল, মালদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা প্রভৃতি রাষ্ট্রের নির্বাচন কমিশন নির্বাচনকালে এমন সক্ষমতা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা রক্ষা করে চলে।

কিন্তু আমাদের নির্বাচন কমিশন ঠুটো জগন্নাথের মতো। তারা সরকারের রক্তচক্ষুকে কোনভাবে উপেক্ষা করতে পারে না। বিশেষ করে দলীয় সরকারের অধীনে তারা তাদের সক্ষমতা, দক্ষতা ও নিরপেক্ষতা হারিয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করে। তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী কাজ করে। তবে দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে তাদের সক্ষমতা, দক্ষতা, নিরপেক্ষতা শতভাগ নিশ্চিত থাকে। এ কারণেই দল নিরপেক্ষ সরকারের প্রতি জনগণের এত আগ্রহ। কারণ দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড বজায় থাকে। নির্বাচন হয় উৎসবমুখর ও আনন্দঘন পরিবেশে। মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিকে নির্বাচনের বাহিরে রেখে দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কতটা গ্রহণযোগ্য হবে, এ নির্বাচন কী আদৌ জনগণের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠা করতে পারবে- তা সময়ই বলে দেবে।

লেখক: প্রফেসর, রাজনীতি ও উন্নয়ন বিভাগ, ইউনিভার্সিটি অব ডেভেলপমেন্ট অল্টারনেটিভ (ইউডা)

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ