ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সমাজে ধর্ম ও রাজনীতির প্রভাব

প্রকাশনার সময়: ০৪ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৭:৩৪

বাংলাদেশের সমাজে সম্প্রতিকালে ধর্ম ও রাজনীতির ব্যাপক প্রভাব বিস্তার ঘটেছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হয়ে যাওয়া বিশ্বকাপ ক্রিকেট দল সমর্থনের বিষয়টিতেও ছিল ধর্ম ও রাজনীতির বিষয়টি। তবে প্রতিটি খেলায় ধর্ম ছিল ওতপ্রোতভাবে জড়িত। বিশেষভাবে নজর দিলে দেখা যায় প্রতিটি কাজকর্মে ধর্ম জড়িয়ে আছে। বাংলাদেশের অলিতে গলিতে চায়ের আড্ডায় রাজনীতি আলোচনার মুখ্য বিষয়। এটা যে শুধু সামনে নির্বাচন হচ্ছে তারই জন্য হচ্ছে, অন্য সময়ও এই আলোচনায় সবাই মুখর।

অথচ দেশের রাজনীতির সঠিক গণতান্ত্রিক ধারাটি আসছে না। অফিস আদালতেও আলোচনার মূল বিষয় ধর্ম আর রাজনীতি। সব ধরনের ক্রীড়াতে ঢুকছে ধর্মীয় বিষয়টা। খেলাধুলায় ধর্ম এ বিষয়টা কতটা ক্রীড়া নৈপুণ্যতা বাড়ায়। সম্প্রতি শেষ হওয়া ক্রিকেট খেলাটির সমর্থকদের সংখ্যা নিরূপণের বিষয়টিতেও রয়েছে ধর্ম। ক্রিকেট নৈপুণ্যতা বা পারদর্শিতা এখানে কাজ করে নাই। সমর্থক গোষ্ঠী সৃষ্টির মূল নিয়ামক হল ধর্ম। টি-টোয়েন্টি খেলা দেখার সময় জনৈক দর্শক বলে উঠলেন আজ মালোরা হেরে যাবে। দর্শকটি হয়তো ভারতকে সমর্থন করে না। ভারতকে সমর্থন না করাটা স্বাভাবিক। ভারতের খেলার যে কলাকৌশল তা অনেকের পছন্দ নাও হতে পারে, তাই ভারতকে সমর্থন করবে না এটাই স্বাভাবিক। তার জন্য ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্মটা টেনে আনাটা কতটা যৌক্তিক? যারা এ কাজটি করে থাকেন তারা আসলেই কি সুস্থ মস্তিস্কের অধিকারীর পরিচয় বহন করে? সেই বিষয়টি নিয়ে ভাবা উচিত। অপরদিকে যারা হিন্দুধর্ম পালন করেন তারা খেলার বিষয়টি দেখেন ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গির গণ্ডি থেকে। দেশের মানুষের মনোজগতকে ঘিরে ফেলছে ধর্মান্ধতা।

বর্তমানে কিছু মানুষ ধর্মান্ধতার কারণে সাইকো রোগীতে পরিণত হয়ে গেছেন। রাজনীতি সমাজিক প্রথা, সকল আলাপচারিতার আড্ডা সব ক্ষেত্রে তারা ধর্মকে টেনে আনেন। মূলত এরা ধর্ম সম্পর্কিত বিষয়ে কিছুই জানেন না। বিভিন্ন সময় তর্কে এ ধর্মীয় সাইকোরা কিছু কথা বলেন যা উন্মাদনা সৃষ্টির সহায়ক হিসেবে কাজ করে? তখন তাদের কাছে ব্যক্ত কথাগুলোর উৎস বা তথ্য সূত্র কী জানতে চাইলে তারা যে উত্তরটা দেন তা আরও বিপজ্জনক। ইসলাম ধর্ম পালনকারীরা বলেন এটা হুজুর (মৌলভী) বলেছেন। অপরদিকে হিন্দুধর্ম পালনকারীরা শিখেছেন ব্রাহ্মণের কাছ থেকে। হিন্দু মুসলিমসহ সকল ধর্মেরই পবিত্র গ্রন্থ আছে। এ গ্রন্থ বর্ণিত বিষয়গুলো বাংলাদেশের এই ধরনের ধর্মান্ধরা কতটা জানেন? শীতের মৌসুম শুরু হয়েছে, এখন গ্রামে গ্রামে বা শহরের মহল্লায় মহল্লায় বসবে ওয়াজ মাহফিল। কথিত হুজুররা নিজস্ব স্টাইলে কিছু ধর্মীয় বয়ান করবে যার যৌক্তিতা শ্রোতাগণ যাচাই করবে না। অন্ধের মতো তাদের দেয়া প্রদত্ত উপদেশ বিশ্বাস করে পালন করবে। যার ফলে সৃষ্টি হবে এক ধরনের সামাজিক অচলনায়তা। হুজুরের প্রদত্ত বয়ান শ্রোতাদের মনোজগতকে আচ্ছন্ন করে ফেলে। তাই তাদের মাঝে দেখা দেয় এক ধরনের মনোবৈকল্যতা। এটা সমাজের জন্য খুবই বিপজ্জনক। ওই দিন এক আড্ডায় নীরব শ্রোতা হয়ে শুনলাম, একজন বিজ্ঞের মতো হয়ে বলছেন, আমেরিকা কিছুই করতে পারবে না বর্তমান সরকারকে, অন্য একজন বললেন, কেন? তিনি পাণ্ডিত্যের গাম্ভীর্যতা নিয়ে বললেন, ভারত ও চীন সরকারের পাশে রয়েছে, অপর একজন বলে উঠলেন, হ্যারে ভাই, এ বিধর্মীয় দুই রাষ্ট্রই বাংলাদেশটারে শেষ করে দিচ্ছে। তিনি ধার্মিকতার সুরে আরও বললেন, এভাবেই তো ইসলামের ক্ষতি করছে মুসলমানরাই।

এ ধরনের রাজনৈতিক আলোচনায় যারা ধর্মের অনুপ্রবেশ ঘটায় তারা এক ধরনের সাইকো। সম্প্রতিকালে সকল কথাবার্তা আড্ডা আলোচনায় একটি বিষয় পরিলক্ষিত হয়, প্রাসঙ্গিক আর অপ্রাসঙ্গিক যাই হোক না কেন সকল বিষয়ে ধর্মীয় উদাহরণ টেনে আনা হয়। এসব যারা করেন তারা সত্যিকারই ধর্ম অজ্ঞ। সারা দেশে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটেছে কিন্তু বিকাশ হয়নি ধর্মীয় জ্ঞানের। এই যে ধর্মীয় শিক্ষার প্রসার ঘটেছে তা কি ধর্মের জন্য, না কি কোনো বিশেষ গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য? রাজনীতিতে দেশের প্রতিটি মানুষই নিজেকে বিজ্ঞ বলে মনে হয়। কথাবার্তা, আচার-আচরণে তারা নিজের বিজ্ঞতার পরিচয় দেন। বিষয়টি একজন নিরক্ষর মানুষ থেকে শুরু করে পিএইচডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত মানুষের মাঝে দেখা যায়। রাজনীতির চুলচেরা বিশ্লেষণে সবাই পটু। দেশের গণতন্ত্রহীনতার কথা এখন সবার মুখে মুখে। তবে গণতন্ত্র উদ্ধারের চর্চায়ও ফুটে ওঠে ধর্ম চর্চা।

কতিপয় মানুষ আছেন মধ্যবিত্ত পর্যায়ের, যারা ভারতীয় রাজনীতিকে সহ্য করতে পারেন না। অথচ তারা কেউই জানে না ভারতের গণতন্ত্র অনুশীলনের প্রক্রিয়াটার ধরন। ভারতের সরকার পদ্ধতিটা কি তাও এই মানুষগুলো ভালোভাবে বলতে পারবেন না। ভারতের আইন সভা কয় কক্ষবিশিষ্ট, আইন সভার সদস্য কিভাবে নির্বাচিত হয় সেই বিষয়ে এদের কোনো জ্ঞান নেই। এ বিষয়গুলো নিয়ে আলাপ করলে দেখা যায় মূলত এরা কিছুই জানেন না। তবে এ বিষয়ে তর্ক জুড়ে দিলে তারা বিধর্মী শব্দগুলো উচ্চারণ করে ধর্মীয় প্রলেপে তর্কটা ঢেকে ফেলে, এখানেই তর্কের পরিসমাপ্তি ঘটায়। ভারতের রাষ্ট্রপতির নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে তার ক্ষমতা, দায়িত্ব সম্পর্কে কোনো জ্ঞান নেই। আবার এরাই বলবে আমেরিকা গণতন্ত্রের সর্বোৎকৃষ্ট দেশ।

তখন এদেশের কাছে আমেরিকার গণতন্ত্র অনুশীলনের প্রক্রিয়াটা জানতে চাইলে এর কোনো সদুত্তর দেবে না। শুধু বলবে আমেরিকায় ভালো গণতন্ত্র। আমেরিকা যদিও গণতান্ত্রিক দেশ, নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি যিনি, সেই ব্যক্তিটা মূলত একনায়ক। আমেরিকায় বহুদলীয় গণতন্ত্র অনুপস্থিত। আমেরিকায় কথিত জনমত জরিপের নামে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে দুজন ব্যক্তিকে রেখে বাকিদের বাদ দেয়া হয়। আসলে এটা প্রকৃত গণতন্ত্র নয়। অনেকেই সুইজারল্যান্ডকে শান্তির দেশ বলে আখ্যা দেন। তারা বলেন, ওই দেশে কোনো চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই নেই, স্বর্গের মতো দেশ।

অথচ সারা পৃথিবীর টাকা পাচারকারী চোরদের ডাইবদার হলো সুইজারল্যান্ড। দেশের মানুষকে ধর্ম ও রাজনীতির যে বিষয়গুলো চর্চা করানো হয় এতে এরা স্থুলবুদ্ধি সম্পন্ন হয়ে পড়ে, সূক্ষ্ম দৃষ্টিতে দেখে বিচার করার বিবেক এরা হারিয়ে ফেলে। যার জন্য বাংলাদেশের রাজনীতিতে গণতন্ত্রের কোনো উৎকর্ষতার বিকাশ হচ্ছে না।

বাংলাদেশে ধর্ম ও রাজনীতিকে নাকি আধুনিকায়ন করা হচ্ছে, অর্থাৎ প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে প্রকাশ ঘটানো প্রক্রিয়া। আসলে কি তাই হচ্ছে, নাকি ব্যক্তির আদর্শ লালনের বিষয়টি নিম্ন থেকে উচ্চ স্তরের শিক্ষণের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। যেমন তৃণমূলেও নেতার তোষামোদ করাটা কর্মীর দায়িত্ব। নেতাকে অনুকরণ এ প্রক্রিয়াটা স্তর স্তর বেয়ে উচ্চ স্তরে পৌঁছে যায়। অপরদিকে ধর্মের ক্ষেত্রে ছোট হুজুরে রীতিনীতি অনুকরণ তা আবার স্তরে স্তরে বড় হুজুর পর্যন্ত পৌঁছানো।

এর ফলে ধর্ম বা রাজনীতি কোনটারই উৎকর্ষতা বাড়ে না। এ ধরনের চর্চার ফলে বেড়ে যায় ধর্মান্ধতা অপরদিকে রাজনীতির ক্ষেত্রে বাড়ে রাজনৈতিক অজ্ঞতা। রাজনীতির অজ্ঞতার কারণে রাজনৈতিক অঙ্গন হয়ে ওঠে সংঘাতময় আর ধর্মান্ধতার কারণে বাড়ছে মৌলবাদ। আর রাজনীতির অজ্ঞতার কারণে রাজনীতিতে স্থান করে নিচ্ছে মৌলবাদ। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা সঠিক করতে হলে ফিরে যেতে হবে ১৯৭২ সালের সংবিধানে। তাহলে দেশে রাজনৈতিক অজ্ঞতা ও মৌলবাদ নির্মূল করা সম্ভব হবে। লেখক: কলামিস্ট

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ