ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বায়ুদূষণ: সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনের পথে অন্তরায়

প্রকাশনার সময়: ০৩ ডিসেম্বর ২০২৩, ১২:০৮

বাংলাদেশে বিগত কয়েক দশকে বায়ু দূষণের মাত্রা ভয়াবহভাবে বেড়েছে। গত ২২ নভেম্বর ২০২৩ সকাল ৯টা ১৪ মিনিটে বায়ুদূষণে বিশ্বের ১১০টি শহরের তালিকায় ঢাকার অবস্থান ছিল সবার শীর্ষে। বায়ুর মান পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্সের (আইকিউএয়ার) হিসেবে এ সময় রাজধানীর স্কোর ছিল ২৪৫ এবং বাতাসের এ মান অস্বাস্থ্যকর ও ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারতের দিল্লি। এই শহরের দূষণ স্কোরও ২৪৫ অর্থাৎ সেখানকার বায়ুর মানও খুবই অস্বাস্থ্যকর। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে ভারতের কলকাতা শহর। এ শহরের দূষণমাত্রার স্কোর ২১৬ অর্থাৎ সেখানকার বাতাসও খুবই অস্বাস্থ্যকর।

স্কোর শূন্য থেকে ৫০-এর মধ্যে থাকলে বায়ুর মান ভালো বলে বিবেচিত হয়। ৫১ থেকে ১০০ হলে মাঝারি বা সহনীয় ধরা হয় এবং ১০১ থেকে ১৫০ স্কোর সংবেদনশীল গোষ্ঠীর জন্য অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়। ১৫১ থেকে ২০০ পর্যন্ত অস্বাস্থ্যকর হিসেবে বিবেচিত হয়, স্কোর ২০১ থেকে ৩০০ হলে খুবই অস্বাস্থ্যকর এবং ৩০১-এর বেশি হলে তা দুর্যোগপূর্ণ বলে বিবেচনা করা হয়। দক্ষিণ এশিয়ার অনেক দেশ ক্রমবর্ধমান বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বের অন্যতম দূষিত অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। ফলে এ অঞ্চলের বিভিন্ন দেশে জনপ্রতি পাঁচ বছরেরও বেশি আয়ু কমতে পারে বলে সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়েছে। যদিও বায়ু দূষণে দেশের মানুষের গড় আয়ু কমছে প্রায় সাত বছর। সম্প্রতি প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বায়ুর ক্রমবর্ধমান দূষণের কারণে স্বাস্থ্যের ওপর যে বিপজ্জনক প্রভাব পড়ছে সে বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ের এনার্জি পলিসি ইনস্টিটিউট (এপিক) তাদের সর্বশেষ এয়ার কোয়ালিটি লাইফ ইনডেক্সে জানিয়েছে, সবচেয়ে বেশি দূষণ দেখা গেছে বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে।

এর আগে ২০২০ সালের মার্চে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক গবেষণা সংস্থা আইকিউএয়ারের বায়ু দূষণে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম উঠে আসে। সংস্থাটি ২০২০ সালের বিশ্বের বায়ুর মানের ওপর ভিত্তি করে ওই তালিকা প্রস্তুত করে এবং এর বৈশ্বিক বায়ুর গুণাগুণ প্রতিবেদন ২০২০ বলছে, বাংলাদেশের বায়ুর মান বিশ্বে সবচেয়ে খারাপ, যেখানে ২০২০ সালে রাজধানী ঢাকা দ্বিতীয় সর্বাধিক বায়ু দূষিত শহর এবং দক্ষিণ এশিয়ায় সবচেয়ে বেশি বিশ্বের দূষিত অঞ্চল বাংলাদেশ প্রথম, ভারত দ্বিতীয় এবং পাকিস্তান তৃতীয়। এ ছাড়া বিশ্বের ৫০টি সবচেয়ে দূষিত শহরের মধ্যে ৪২টি এ অঞ্চলে। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, বাংলাদেশ ২০১৮ সাল থেকে সবচেয়ে খারাপ দূষিত দেশের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে এবং এ ফলাফল অনুসারে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে পরিস্থিতি মোটেও উন্নতি হয়নি, এটা অত্যন্ত উদ্বেগজনক চিত্র।

অন্যদিকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক হেলথ ইফেক্টস ইনস্টিটিউট এবং ইনস্টিটিউট ফর হেলথ মেট্রিক্স অ্যান্ড ইভালুয়েশন ২০২০ সালে উল্লেখ করেছিল, বায়ুর দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়া বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত অঞ্চল। বাংলাদেশে পরিস্থিতি বিশেষ করে ভয়াবহ, বায়ু দূষণের কারণে তখন ১.৭৩ লাখ মৃত্যু হয়েছে এবং সমগ্র জনসংখ্যা এমন এলাকায় বসবাস করছে যেখানে বায়ুর গুণমান একেবারেই নিরাপদ বলে গন্য করা হয় না। প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়েছে, বায়ুদূষণ বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের পরে দ্বিতীয় প্রধান স্বাস্থ্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এবং আমাদের আয়ু আরও প্রায় ১.৩ বছরের সর্বোচ্চ প্রত্যাশিত লাভ দেখতে পেত যদি বায়ু দূষণের মাত্রা বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশিকা মেনে চলত।

বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত শহরের তালিকায় ঢাকার আধিপত্যের একটি বড় কারণ হলো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বাণিজ্যিক ও নির্মাণ কার্যক্রমের বৃদ্ধি। শহরের বায়ু দূষণের দুটি প্রধান উৎস শিল্প বর্জ্য এবং যানবাহনের নির্গমন। ঢাকার আশপাশে প্রায় ২২৯৫টি ইটের ভাটা রয়েছে যা বাতাসে সূক্ষ্ম কণা নির্গত করে। বায়ু দূষণের জন্য চলমান বিভিন্ন প্রকল্পকে সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় যা শহরের বেশিরভাগ উল্লেখযোগ্য অংশে যানজটের সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া, ধূমপান, এয়ার কন্ডিশনার থেকে জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ান, কয়লা চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রে খোলাখুলিভাবে পোড়ান, পৌরসভা ও কৃষি বর্জ্য পোড়ান, নাইট্রোজেন অক্সাইড নির্গত করে যা মহানগরের বায়ুর গুণমানকে ‘অস্বাস্থ্যকর’ করে যা একটি নীরব ঘাতক হিসেবে কাজ করে এবং গুরুতরভাবে স্বাস্থ্যঝুঁকি বিবেচনা করা হয়। উচ্চ মাত্রার বায়ু দূষণের সংস্পর্শে বিভিন্ন ধরনের প্রতিকূল স্বাস্থ্যের ফলাফল হতে পারে। এটি শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ, হূদরোগ এবং ফুসফুসের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। বায়ু দূষণকারী স্বল্প এবং দীর্ঘমেয়াদি গুণাগুণ উভয়ই স্বাস্থ্যের ঝুঁকির সঙ্গে জড়িত। আরও গুরুতর প্রভাবে এগুলো সুস্থ ব্যক্তিদের অসুস্থ করে তোলে এবং এক্ষেত্রে শিশু, বয়স্ক এবং দরিদ্র মানুষ বেশি সংবেদনশীল। বায়ুদূষণ স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর, অত্যধিক অকাল মৃত্যুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত এবং সূক্ষ্ম ২.৫ পিএম কণা যা ফুসফুসের পথের গভীরে প্রবেশ করে।

২০১৯ সালের ২৬ নভেম্বর হাইকোর্ট সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে রাজধানীর বায়ুদূষণ কমাতে ঢাকা ও এর আশেপাশের এলাকার সব অবৈধ ইটভাটা বন্ধ করতে নির্দেশ দেন। আদালত রাজধানী ঢাকায় বায়ু দূষণের কারণ চিহ্নিত করে একটি নির্দেশিকা প্রণয়নের জন্য সরকারকে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশ দিয়েছিল এবং আইনগত ব্যবস্থা নিতে পরিবেশ অধিদপ্তরকে সপ্তাহে দুবার মোবাইল কোর্ট পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছিল। ঢাকায় বায়ু দূষণের ওপর বিশ্বব্যাংক ও পরিবেশ অধিদপ্তরের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের এক নম্বর কারণ হলো ইটভাটা এবং নরওয়ের একজন বিশেষজ্ঞও একটি গবেষণায় উল্লেখ করেছেন রাজধানী শহরের বায়ু দূষণের ৫২% কারণ ইটভাটা। ইটভাটা আসলে পরিবেশ সম্পর্কিত আইন এবং এর যথাযথ সচেতনতা সম্পর্কে আমাদের গুরুতর উদাসীনতা রয়েছে। শহর বা শহরের রাস্তা পরিষ্কার এবং নদীকে দূষণমুক্ত করতেও আমাদের নেতিবাচক মনোভাব রয়েছে।

অবশ্য ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলছে, পরিবেশ অধিদপ্তর দুর্নীতিতে নিমজ্জিত। পরিবেশ ছাড়পত্র দেয়া ও নবায়ন দুর্নীতির বড় ক্ষেত্র। এ ছাড়া পরিবেশ দূষণকারী প্রতিষ্ঠানের মালিকদের সঙ্গে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের যোগসাজশ রয়েছে। এক্ষেত্রে পরিবেশগত ছাড়পত্র পেতে ৬৬ শতাংশ শিল্পকারখানাকে নিয়মবহির্ভূতভাবে অতিরিক্ত টাকা দিতে হয়। শ্রেণিভেদে এ অর্থের পরিমাণ ৩৬ হাজার থেকে ১ লাখ ৯ হাজার টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা স্থাপনের আইনি বিধান না থাকলেও ৭২ শতাংশ কারখানার অবস্থান আবাসিক এলাকায়। গবেষণায় আরও দেখা যায়, কমলা-খ ও লাল শ্রেণিভুক্ত কারখানার পরিবেশ ছাড়পত্রের সময় পরিবেশ ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা (ইএমপি) জমা দেয়া বাধ্যতামূলক। কিন্তু ৫৭ শতাংশ কারখানা ইএমপি ছাড়াই পরিবেশ ছাড়পত্র পেয়েছে। পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে ছাড়পত্র পেতে সব কারখানাকে স্থানীয় কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিপত্র (এনওসি) দিতে হয়। কিন্তু ১৭ শতাংশ কারখানা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের এনওসি ছাড়াই ছাড়পত্র পেয়েছে। গবেষণার ফলাফলে দেখা যায়, কর্মীদের একাংশের অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে বড় অঙ্কের নিয়মবহির্ভূত আর্থিক লেনদেন ও তা প্রতিরোধে কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতিতে পরিবেশ অধিদপ্তরে দুর্নীতির প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ হয়েছে। প্রতি জেলায় এক বা একাধিক পরিবেশ আদালত থাকার কথা থাকলেও সারা দেশে মাত্র তিনটি পরিবেশ আদালত রয়েছে। অধিদপ্তরের অনুমোদিত পদের ৫৯ শতাংশে জনবল নেই। অধিদপ্তরের কাছে পরিবেশ দূষণকারী শিল্পপ্রতিষ্ঠানের কোনো তালিকা নেই।

টিআইবি বলছে, আইনগত দুর্বলতার কারণে পরিবেশ অধিদপ্তর তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারছে না। যতটুকু আইনি সক্ষমতা রয়েছে, তাও কাজে লাগানো হচ্ছে না। সুশাসনের প্রতিটি সূচকে ঘাটতিতে প্রতিষ্ঠানটি দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়েছে। অধিদপ্তরের দুর্নীতির কারণে আবাসিক এলাকায় শিল্পকারখানা গড়ে উঠেছে। তাছাড়া, পরিবেশ দূষণ নিয়ন্ত্রণে যে মৌলিক ভূমিকা, তা পালনে পরিবেশ অধিদপ্তর ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে এবং এক্ষেত্রে শর্ষের মধ্যে ভূত দেখা যাচ্ছে। পরিবেশ অধিদপ্তরের কারণে উল্টো পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। প্রতিষ্ঠানটিকে ঢেলে সাজিয়ে দুর্নীতি-অনিয়মে জড়িত ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে জবাবদিহির আওতায় আনা দরকার।

জাতিসংঘের মতে, প্রতি ১০ জনের মধ্যে নয়জন বিশ্বব্যাপী অপরিষ্কার বাতাসে নিঃশ্বাস নেয় এবং বায়ু দূষণের কারণে প্রধানত নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে প্রতি বছর আনুমানিক ৭০ লাখ অকাল মৃত্যু ঘটে। বায়ুদূষণ হূদরোগ, স্ট্রোক, ফুসফুসের ক্যান্সার এবং অন্যান্য শ্বাসযন্ত্রের রোগে অবদান রাখে; এটি অর্থনীতি, খাদ্য নিরাপত্তা এবং পরিবেশের জন্য হুমকিস্বরূপ এবং বায়ু দূষণকে বিশ্বের নীরব ঘাতক হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আসলে আমাদের দেশে আমরা পরিবেশসংক্রান্ত বিষয়গুলোর প্রতি গুরুতর অবহেলা দেখাই। বায়ুর মান উন্নয়নে সরকার বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেও মনে হচ্ছে পদক্ষেপগুলো যথেষ্ট এবং টেকসই নয়। ধূমপানের ফলে মানুষের ফুসফুসে নানা ধরনের জটিল রোগ বাসা বাঁধে। বায়ু দূষণও ধূমপানের চেয়ে কোনো অংশে মানুষের কম ক্ষতি করে না। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় বলা হয়েছে, বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বব্যাপী মানুষের গড় আয়ু দুই বছর চার মাস কমেছে এবং বাংলাদেশে প্রায় সাত বছর। সুতরাং দেখাই যাচ্ছে বায়ু দূষণ সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের পথে বড় অন্তরায়। বায়ুদূষণ শুধুমাত্র একটি পরিবেশগত সমস্যা নয়; এটি জনস্বাস্থ্যের দুর্দশার একটি প্রধান উৎস, সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনের পথে বড় অন্তরায় এবং এ পর্যায়ে কর্তৃপক্ষের উচিত এটিকে জরুরি নীরব ঘাতক হিসেবে বিবেচনা করা এবং টেকসই পদক্ষেপ নেয়া।

লেখক: ব্যাংকার ও কলাম লেখক

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ