ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বোধের কি বিস্ময়কর অধঃপতন আমাদের!

প্রকাশনার সময়: ০২ ডিসেম্বর ২০২৩, ০৭:২৬

জেন্ডার বৈষম্যকে প্রাধান্য দিয়ে এক অধিকারকর্মীকে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় রীতিমতো প্রত্যাখ্যান করেছে। অথচ গেল আগস্টে ওই মানুষটির কথা মন দিয়ে শুনেছেন দেশের প্রধান নির্বাহী। প্রধানমন্ত্রীর গণভবনে যে মানুষটি প্রবেশাধিকার রাখেন সেই মানুষটিই কিনা নর্থসাউথ প্রেমিজে প্রবেশ করতে পারেননি। বোধের কী বিস্ময়কর অধঃপাত আমাদের!

নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ে দুই দিনব্যাপী জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি)-এর ৫ নম্বর লক্ষ্যমাত্রা-জেন্ডার সমতা অর্জন এবং মেয়ে ও নারীদের ক্ষমতায়নের বিষয়টিকে সামনে রেখে একটি কার্নিভ্যালের আয়োজন করা হয়। কার্নিভ্যালের একটি সেশনে হো চি মিন ইসলাম নামের একজন ট্রান্সজেন্ডার নারীকে বক্তা হিসেবে রাখা হয়েছিল। গত ২৪ নভেম্বর, শুক্রবার একটি সেশনে হো চি মিন ইসলামের আলোচনা করার কথা ছিল। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের একটি চরম গোঁড়া ও মৌলবাদী গোষ্ঠীর আপত্তি আমলে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ হো চি মিন ইসলামের সেশনটি বাতিল করে দেয়।

বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের মধ্যে কেন এমনতর মনস্তাত্ত্বিক দৈন্যতা থাকবে। ধর্মীয় কট্টরপন্থার দোহাই দিয়ে মানুষের প্রতি অসহনশীল ও অসম্মানজনক আচরণ কেন করবে শিক্ষার্থীরা? কেন তারা জঘন্য লিঙ্গবৈষম্য আত্মস্থ করবে? এর পুরো দায়ভার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকেই বহন করতে হবে।

গত আগস্টে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর হো চি মিন ইসলাম তার সোশ্যাল হ্যান্ডেলে জানিয়েছিলেন...

‘আপনারা সকলেই জানেন যে, একজন ট্রান্সজেন্ডার নার্স এবং একজন অধিকারকর্মী হিসেবে ছোট থেকেই আমি লড়ে যাচ্ছি এবং আমার বোনদের অধিকার রক্ষার জন্যও আমি সচেষ্ট! এ কাজ করতে করতে বারবার নানাভাবে আমি বিপদের সামনে পড়েছি এমনকি আমার ওপরে প্রাণঘাতী হামলাও হয়েছে। তবু সকলের আশীর্বাদ ও ভালোবাসাকে সম্বল করে আমি কোনোদিন দেশ থেকে পালিয়ে গিয়ে বিদেশে শরণার্থী হিসেবে থাকব এটা চাইনি এবং আজও চাই না! আমার স্থির বিশ্বাস, বাংলাদেশ যেমন পুরুষ এবং মহিলাদের, তেমনি ট্রান্সজেন্ডার, হিজড়া নাগরিকদেরও! কিন্তু বারবার ব্যক্তিগত এবং সামাজিক স্তরে আমাদের নানা রকমের হেনস্তা ও বঞ্চনার শিকার হতেই হয়! এ বিষয় নিয়েই আজ আমি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপচারিতার সুযোগ পাই!

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দীর্ঘ ৩০ মিনিটের অধিক তার মূল্যবান সময় দেন আমায়। আমাদের অসুবিধার কথা মনোযোগ দিয়ে শোনেন এবং দৃঢ়ভাবে জানান যে, বাংলাদেশের সংবিধান আমাদের সমান অধিকার দেয় এবং তার সরকার এ বিষয়ে সবসময়ই পাশে আছে এবং থাকবে। একই সঙ্গে তিনি এটিও বলেন যে, যারা আমাদের অধিকারের বিরোধিতা করছেন তারা সঠিকটা না জেনে, ভুল জেনে এটি করছেন। তিনি জানান যে, পারিবারিক সম্পত্তির ক্ষেত্রেও নারী স্বভাবের ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের নারী হিসেবে এবং পুরুষ স্বভাবের ট্রান্সজেন্ডার মানুষদের পুরুষ হিসেবেই সম্পত্তির অধিকার থাকবে।’

এমন আলাপচারিতার বয়স ৯০ দিনও গড়ায়নি। এরই মধ্যে এমন একজন সংগ্রামী মানুষকে নর্থসাউথ বিশ্ববিদ্যালয় যারপরনাই অপমান করেছে। আমরা এর তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানাই। আশা করি ওই বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ তাদের মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ভুল স্বীকার করে হো চি মিন ইসলামের কাছে দুঃখ প্রকাশ ও ক্ষমা প্রার্থনা করবে।

বিশ্ববিদ্যালয় হবে সর্বমানুষের সর্বমতের। জাতি, ধর্ম, গোত্র, নারী, পুরুষ, ট্রান্সজেন্ডার বা গায়ের রঙ ভেদে যেখানে ন্যূনতম বৈষম্য করা হবে না। নৈতিক মানে মহত্তম, মানবিক বোধসম্পন্ন ও বিজ্ঞানমনস্ক জাতি তৈরি করাই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধানতম প্রতীতি।

কিন্তু দেশের শীর্ষ এই বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রায় শুরু থেকে লাইনচ্যুত হয়ে আছে। অগণন দুর্নীতি ও নেপোটিজমের অভিযোগ রয়েছে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে। সবচেয়ে ভয়াল ব্যাপার হলো, দেশে মুক্তচিন্তকরা খুন হন, খুনিরা আসে নর্থসাউথ থেকে। হলি আর্টিজানে হামলা হয় সেই নিবরাস ইসলামরাও এনএসইউ’র ছাত্র। এমনকি সেখানকার শিক্ষকদের বিরুদ্ধেও সুনির্দিষ্ট অভিযোগ রয়েছে শিক্ষার্থীদের এক্সট্রিমিজমে উদ্বুদ্ধ করার। দেশ-বিদেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাবমূর্তি ফেরাতে সভা সেমিনার করে সবার সহায়তা কামনা করে। ইস্যু ভুলে গেলেই আবার যেই লাউ সেই কদু। থোড় বড়ি খাড়া, খাড়া বড়ি থোড়। আদতে এনএসইউ’র মূলেই গলদ। সেই গলদ দূর করতে পারে যথার্থ আইনের শাসন ও কূপমণ্ডুকদের বিরুদ্ধে কঠোর আইনের প্রয়োগ। এ রাষ্ট্র যতদিন না এক্সট্রিমিজম অবলুপ্ত করে ধর্মের উদারপন্থা প্রমোট করছে, ততদিন পর্যন্ত আসলে প্রেমময় মানুষ হিসেবে আমাদের কারোরই মুক্তি নেই।

ধর্মীয় মৌলবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, কূপমণ্ডুকতা এবং ভিন্নমতের প্রতি ঘৃণাচর্চার বাজে স্বভাব তিরোহিত করে উদারনৈতিক ও পরমতসহিষ্ণু জাতি গঠন করা না গেলে হো চি মিন ইসলামের প্রতি যে ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটেছে; এর পুনরাবৃত্তি হতেই থাকবে।

শীতকালজুড়ে বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী মাঠের জলসা এবং জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়ায় ক্রমাগত দেশজ সংস্কৃতির প্রতি ঘৃণা, উগ্রবাদ ও নারীবিদ্বেষ ছড়ানো হচ্ছে। গলা চড়িয়ে কথা বলার সুযোগ পাচ্ছে হার্ডকোর মিসোজিনিস্টরা। এদের অবিলম্বে থামানো না গেলে কারও কোনো কথাই কাজে আসবে না। বাংলাদেশ নামক ছায়াবৃক্ষ বাঁচাতে হলে সবার আগে দরকার সকল আগাছা বিষবৃক্ষের অপনোদন। রাষ্ট্রের যারা নিয়ন্তা থাকেন তাদের উচিত যথার্থ কাজটি সময়মতো করা। দড়ি ছিঁড়ে দিয়ে উন্মত্ত গরু খোঁজার কোনো মানে হয় না।

আমরা লড়াকু হো চি মিন ইসলামের প্রতি সহমর্মিতা প্রকাশ করছি। অধিকার সচেতন তার ফিলানথ্রোপিক কার্যধারার প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানাচ্ছি।

পাশাপাশি দাবি করছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা যেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘শান্তিনিকেতন’-এ থাকা এই আপ্তবাক্যগুলো রপ্ত করেন। ‘মানুষের মধ্যে দ্বিজত্ব আছে; মানুষ একবার জন্মায় গর্ভের মধ্যে, আবার জন্মায় মুক্ত পৃথিবীতে। তেমনি আরেক দিক দিয়ে মানুষের এক জন্ম আপনাকে নিয়ে, আরেক জন্ম সকলকে নিয়ে।

পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয়ে তবে মানুষের জন্মের সমাপ্তি, তেমনি স্বার্থের আবরণ থেকে মুক্ত হয়ে মঙ্গলের মধ্যে উত্তীর্ণ হওয়া মনুষ্যত্বের সমাপ্তি।’- লেখক: সাংবাদিক

নয়াশতাব্দী/আরজে

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ