নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সবাই সোচ্চার। এমনকি জাতিসংঘ থেকেও নারীদের ওপর যৌন নিপীড়নের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তোলার কথা বলা হয়েছে বারবার। তবু কেন দেশে দেশে নারী নির্যাতন হচ্ছে? নারী নির্যাতন একটি দুঃখজনক বাস্তবতা। যুগে যুগে নারীরা তাই অনিরাপদই থেকে গেছে। নারীর প্রতি অপরাধ কঠোর হাতে দমনের বিকল্প নেই।
ভাবতাম আমাদের দেশের নারীরা বুঝি অনেক বেশি নির্যাতিত। সম্প্রতি ভারতের দিনাজপুর, শিলিগুড়ি এবং কলকাতার কয়েকটি অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এখানকার নারীদের কষ্টের কথা কবিতা তাদের বক্তৃতায় খুঁজে পেলাম। তাদের কাছ থেকে যে বইগুলো উপহার হিসেবে পেয়েছি তা ঘেঁটে দেখলাম এখানকার নারীরা আমাদের দেশের চেয়েও বেশি অনিরাপদ। কৌশলে তারা তাদের লেখনীতে তা প্রকাশ করেছে।
নারী নির্যাতনকে অগ্রহণযোগ্য উল্লেখ করার সুযোগ নেই। নারী নির্যাতনের কোনো ব্যাখ্যা থাকতে পারে না এবং এটি কোনোক্রমেই সহনীয় নয়। বিশ্বের কমপক্ষে এক তৃতীয়াংশ নারী তার জীবনের কোনো না কোনো সময়ে শারীরিক নির্যাতন কিংবা যৌন নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। এটা আমার কথা নয় জাতিসংঘের একটা পরিসংখ্যান। এ ছাড়া গর্ভাবস্থায় ভ্রূণের লিঙ্গ শনাক্তকরণের পর বহু মেয়ে পৃথিবীর আলো দেখার আগেই নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হচ্ছেন। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, বিশ্বের মোট নারীর শতকরা ৭০ ভাগ কমবেশি নির্যাতনের শিকার হয়। এ পরিসংখ্যান থেকেই বিশ্বব্যাপী নারী নির্যাতন যে কত অমানবিক অবস্থায় পৌঁছেছে তা অনুধাবন করা যায়। তবে নারী নির্যাতনের ধরন এক এক সমাজে এক এক রকম এবং কোথাও কোথাও নারীদের হত্যা করার মাধ্যমে নির্যাতনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, যেসব নারী হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়, তাদের শতকরা ৪০ ভাগ নিহত হয় তাদের স্বামীদের হাতে। নারী নির্যাতনের ঘটনা শুধু যে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে হয়, তাই নয় বরং পশ্চিমা দেশগুলোতেও ব্যাপক মাত্রায় নারী নির্যাতন চোখে পড়ে। মার্কিন ফেডারেল পুলিশ বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের শতকরা ৭০ ভাগ পুরুষ তাদের স্ত্রীদের ওপর নির্যাতন চালায়। এর মধ্যে কিছু নারীর ওপর এত বেশি শারীরিক অত্যাচার চালানো হয় যে, তাদেরকে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়। জাতিসংঘের হিসাবে যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর ২০ থেকে ৪০ লাখ নারী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়।
জার্মানিতে সড়ক দুর্ঘটনাসহ অন্যান্য দুর্ঘটনায় যত মানুষ হতাহত হয়, তার চেয়ে বেশি সংখ্যক নারী স্বামীদের হাতে আহত কিংবা নিহত হয়। সৌদি, দুবাই, ফ্রান্সেও ওই একই চিত্র। সভ্য ধনী রাষ্ট্রগুলোতেও নারীরা নিরাপদ নয়। এ পরিসংখ্যানটি আরও ভয়াবহ মনে হবে তখন, যখন জানা যাবে, যে সব নারী নির্যাতনের শিকার হন তাদের তিনজনের মধ্যে মাত্র একজন পুলিশকে ফোন করে থাকেন।এসব কারণেই পুরুষ শাসিত এ সমাজে নির্যাতনের পরিসংখ্যান এত লম্বা যে তা নির্ণয় করা দুরূহ ব্যাপার।
বছরে যত না নারী নির্যাতন হয় তার শতকরা দু’ভাগও আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। যেগুলো আদালতে বিচারাধীন থাকে তারও সাজা হয় ক’জনের? এসব অপরাধের ঘটনায় আদালতে মামলা হয় সবচেয়ে কম; মামলা হলে বিচার প্রক্রিয়া শেষে অপরাধীর দণ্ড কার্যকর হওয়ার দৃষ্টান্ত আরও কম। অনেক ধর্ষণের ঘটনায় ধর্ষণের শিকার নারী ও তার পরিবার সামাজিক সম্মানহানির আশঙ্কায় তা প্রকাশ করে না। এ কারণেই দেশে নারী নির্যাতন বাড়ছেই।
নারী নির্যাতনের সব ঘটনার খবরই সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। ইদানিং লক্ষ্য করা যায়, নারী নির্যাতনের মূল হাতিয়ার হিসেবে একটি ছেলে ও একটি মেয়ের অনৈতিক সম্পর্ক একটি ক্যামেরায় ধারণ করে ফেসবুক, টুইটার কিংবা অন্য কোনো সামাজিক মাধ্যমে দেশ-বিদেশ ছড়িয়ে দেয়। মোবাইল ও ইন্টারনেটের যুগে তা মুহূর্তেই ছড়িয়ে যায় দেশ-দেশান্তর। ব্যাপারটি অত্যন্ত বেদনাদায়ক এবং গর্হিত বিষয়। এই মেয়ে, তার পরিবার এবং আত্মীয়দের অবস্থা কি আমরা ভেবে দেখেছি? তথাপি এ বিষয়ে কথা বলার যেন কেউ নেই। কিন্তু গত পাঁচ বছরে ‘গোপন ক্যামেরার মাধ্যমে যৌন হয়রানি’র বিষয়টি এমন অবস্থায় পৌঁছেছে যে, বিষয়টি সচেতন মহলকে উদ্বিগ্ন করে তুলেছে। সাধারণত স্কুল-কলেজের মেয়েরাই এর শিকার বেশি হয়। উঠতি বয়সের মেয়েরা তারা হয় কোনো প্রতিশোধের শিকার নতুবা প্রেমিকের প্রতারণার মূল্য গোনে। পরকীয়া প্রেমে ফাঁসা নারীও এর শিকার হন।
অভিযোগ আছে অজ্ঞাত কারণে ধর্ষিতাকে সহযোগিতার বদলে তারা নানাভাবে ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে থাকে। শুধু পুলিশ নয় সমাজপতি, গ্রাম্যমোড়লরাও এসব নির্যাতনের ঘটনার পর তা মিমাংসা করে দিতে ব্যস্ত হয়ে ওঠেন। এ অবস্থায় সমাজে এ ধরনের অপরাধ ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকবে এবং তা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। আমরা চাই নারীর ওপর এ নির্যাতন বন্ধ হোক। নারীরা মায়ের, স্ত্রীর মর্যাদা ফিরে পাক। আমি কাউকে অনুরোধ করব না যে, ভেবে দেখুন।
কাউকে বলব না যে, সচেতন হোন। নারীরা অনেক ভুলত্রুটি করেন। তাই বলে পেটাতে হবে কেন? একজন স্বামী হিসেবে আপনিও তো স্ত্রীর কাছে দোষ করতে পারেন- তাই বলে কি তিনি (স্ত্রী) আপনাকে পেটাতে আসছেন? সংসার করছেন- পরস্পরকে ভালো করে বুঝে সংসার করেন। স্বামী-স্ত্রীতে মতের মিল না হলে আলোচনা করেন, প্রয়োজন হলে দুপক্ষের মুরব্বিদের নিয়ে বসে এর সমাধান করেন। তারপরেও সমাধান না হলে কি আর করা, বউ পেটানো প্রথাকে বিলুপ্ত করে দিয়ে সমঝোতার মাধ্যমে দুজন আলাদা হয়ে যান।
নারীর ক্ষমতায়ন বাড়লেও নারী উন্নয়ন আজও পদে পদে বাধা। আধুনিক পৃথিবীর ইতিহাসে নারী যে অগ্রযাত্রার সূচনা করেছিল সেই ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে তারই শত বছর পার হলো। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, সেই ১০২ বছর আগে কিংবা তারও প্রায় ৭০ বছর আগে নারীরা যে জন্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন, এখনো এই অধুনা সভ্যযুগে আমরা মোটামুটি একই দাবি জানাতে রাস্তায় নামতে বাধ্য হই। নারীরা এখনো সমান শ্রমে সমান মজুরি পায় না, পারিবারিক জীবনে আইনি বৈষম্যের শিকার, পারিবারিক নির্যাতনের জন্য পায় না আইনি সুরক্ষা, কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানির হাত থেকে নিস্তার পাওয়া এখনো দাবির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়ে গেছে। যদিও নারীর সমঅধিকার আজকে একটি স্বীকৃত নীতি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে।
বাস্তবে তার চিত্র অনেকটাই ভিন্ন। এ অবস্থা থেকে আমাদের নারী সমাজকে উঠিয়ে আনতে হবে। নারীকে পরিচিত করে তুলতে হবে নিজ পরিচয়ে। পরিতাপের বিষয় এ দেশের শতবর্ষী নারীও স্বামীর সংসারে পরাধীনতার শৃঙ্খল কিছুতেই ভেদ করতে পারে না; পারে না নিজের স্বাধীনতাটুকু আদায় করে নিতে। সংসারের বৃদ্ধ মাকে চলতে হয় শ্বশুর-শাশুড়ি কিংবা স্বামীর অধীনে কখনো বা সন্তানের অধীন হয়ে। জীবনের পুরোটা বছর পার করলেও তার ওই সংসারে গুরুত্ব খুব কমই পায়। আর এটাই যুগ যুগ ধরে চলছে আমাদের সমাজ সংসারে। আমাদের অবহেলিত বঞ্চিত নারীদের আলো দেখাতে হবে, ওদের এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে দূর বহুদূর।
এদেশে নারী ও শিশুদের প্রতি সহিংসতার অপরাধগুলোকে বিশেষভাবে তদন্ত ও বিচারের জন্য নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন রয়েছে। এ আইনে যৌতুকের জন্য সাধারণ বা গুরুতর আহতকরণসহ ধর্ষণ, ধর্ষণের প্রচেষ্টা, যৌন হয়রানি, হত্যা, অপহরণ, দহনকারী পদার্থ দিয়ে আহত করা ইত্যাদি প্রায় ১২ প্রকার অপরাধের দ্রুত তদন্ত ও বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন, ভিকটিমের জবানবন্দি ম্যাজিস্ট্রেট কর্তৃক লিপিবদ্ধকরণ ইত্যাদি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ আইনের অপরাধকে জামিনের অযোগ্যও ঘোষণা করা হয়। আইন আছে; আছে আদালত তবু নারী নির্যাতন থেমে নেই।
এ প্রসঙ্গে সহকারী একটি দৈনিকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- নারীর মর্যাদা প্রতিষ্ঠায় বাংলাদেশের সংবিধানে নারী ও পুরুষের সমঅধিকারের বিধান রয়েছে। নারীর অধিকার রক্ষায় ও নারী নির্যাতন প্রতিরোধে প্রণীত হয়েছে একের পর এক আইন। তবু বেড়ে চলেছে নারী নির্যাতন। কিন্তু নির্যাতন প্রতিরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া যাচ্ছে না। নির্যাতনের হার ক্রমেই বেড়ে চলেছে। আইন থাকা সত্ত্বেও ক্রমবর্ধমান হারে নারী নির্যাতন বৃদ্ধির কারণ হতে পারে প্রণীত আইনগুলোর বাস্তবায়নে সীমাবদ্ধতা ও আইনের প্রয়োগ-পদ্ধতিতে কোনো ত্রুটি। যৌতুকের দাবি ও যৌতুকের জন্য নির্যাতনের মাত্রা আশঙ্কাজনকভাবে বাড়তে থাকায় ১৯৮০ সালে প্রণীত হয় যৌতুক নিরোধ আইন। পাশাপাশি নারী নির্যাতন প্রতিরোধে ২০০০ সালে প্রণীত হয়েছে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন (সংশোধনী ২০০৩)।
এ আইন দুটি উদ্দেশ্য পূরণে কতখানি সক্ষম হয়েছে, এর মাধ্যমে নারী ও শিশুরাই বা কতটুকু প্রতিকার পেয়েছে, নির্যাতন প্রতিরোধে আইন দুটির প্রয়োগে প্রতিবন্ধকতা এবং এর উত্তরণের সম্ভাব্য উপায় কী হতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। এসব নানা কারণেই গ্রামগঞ্জে নারী নির্যাতন চলছে তো চলছেই। নারী নির্যাতন আগে ছিল অশিক্ষিতের কাজ এখন তা ভদ্র সমাজে ঢুকে গেছে। নারীর প্রতি এসব অপরাধ কঠোর হাতে দমন ও আইন প্রয়োগব্যবস্থাকে অধিকতর গতিশীল, দক্ষ ও কার্যকর করে তোলার বিকল্প নেই; সেই সঙ্গে নারীর প্রতি প্রয়োজন বিশেষ মনোযোগ।
- লেখক: সাংবাদিক ও সমাজ গবেষক, মহাসচিব- কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ
নয়াশতাব্দী/আরজে
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ