ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

হরতাল-অবরোধ: প্রশ্নের মুখে বিএনপির অর্জন

প্রকাশনার সময়: ২৯ নভেম্বর ২০২৩, ০৭:২২

গত ২৯ অক্টোবর থেকে ২২ নভেম্বর পর্যন্ত ২৫ দিনের মধ্যে ১৪ দিন দেশব্যাপী হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি পালন করেছে বিএনপি-জামায়াত জোট। সরকারের পদত্যাগের দাবিতে ডাকা এ হরতাল-অবরোধে এ পর্যন্ত দুই শতাধিক যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। দুটি ট্রেনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। প্রাণ ঝরেছে একাধিক। ভয়, আতঙ্কে দূরপাল্লার যাত্রীরা অতীব জরুরি প্রয়োজন না হলে খুব একটা ঘর থেকে বের হননি। ফলে দূরপাল্লার গাড়ি চলাচল করছে কম। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা বাধাগ্রস্ত করা গেছে। এতে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

কিন্তু বিনিময়ে বিএনপি-জামায়াত জোটের অর্জন কী হলো? তারা কি নির্বাচনি তফসিল ঘোষণা বন্ধ রাখতে পেরেছে? দেশ যে নির্বাচনমুখী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দল যে ধীরে ধীরে নির্বাচনে অংশ নিতে যাচ্ছে সেটা কি ঠেকানো গেছে?

এ সবগুলো প্রশ্নের জবাবই হচ্ছে না সূচক। অর্থাৎ বিএনপি-জামায়াত জোট যে উদ্দেশ্যে আন্দোলন করছে তার কোনোটারই ইতিবাচক কোনো ফলাফল নেই। সরকার যেমন পদত্যাগ করেনি, তেমনি নির্বাচন কমিশনও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা থেকে বিরত থাকেনি। বরং নির্বাচনি তফসিল ঘোষণার পর থেকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ, তাদের জোট শরিক, জাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টিসহ অন্যরা নির্বাচনি ট্রেনে চড়তে প্রস্তুতি অর্থাৎ দলীয় আগ্রহী প্রার্থীদের মধ্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে। একইভাবে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টিও সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণের লক্ষ্যে মনোনয়ন ফরম বিক্রি করেছে।

সাবেক কূটনীতিক শমসের মবিন চৌধুরী ও তৈমুর আলম খন্দকারের নেতৃত্বাধীন প্রয়াত নাজমুল হুদার সংগঠন তৃণমূল বিএনপিও নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। সর্বশেষ কল্যাণ পার্টির চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিমের নেতৃত্বে তিনটি সংগঠনের জোট যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বুধবার। জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে সৈয়দ ইবরাহিমের নেত্বাধীন জোট এই ঘোষণা দেয়। অথচ এই কল্যাণ পার্টি এতদিন বিএনপি জামায়াতের নেতৃত্বাধীন জোটে ছিল। ছিল আন্দোলন সংগ্রামেও।

এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য গণমাধ্যমে এসেছে তাতে বিএনপির মাঠ পর্যায়ে অনেক নেতা নির্বাচন অংশ নিবেন বলে আভাস পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ বিএনপি সরকার পতনের এক দফা আন্দোলনে থাকলেও তাদের দলের নেতাদের মধ্যে এ নিয়ে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দেখা দিয়েছে। তাই যারা দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত, কিংবা যাদের বয়স হয়ে গেছে, রাজনৈতিক জীবনের একেবারে শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে আছেন এমন অনেক নেতা নির্বাচনে অংশ নিলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৭ জানুয়ারি। ঘোষিত তফসিল অনুযায়ী নির্বাচনে অংশগ্রহণে আগ্রহীরা ৩০ নভেম্বরের মধ্যে মনোনয়নপত্র জমা দিতে পারবেন। তাই দেশের নির্বাচনি রাজনীতিতে আর কি কি ঘটতে যাচ্ছে- তার জন্য রাজনীতি নিয়ে আগ্রহীদেরকে আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।

দুই

সরকারবিরোধী চলমান এই আন্দোলনে বিএনপি-জামায়াত জোট বিশেষ করে বিএনপির কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যন্ত নেতাকর্মীরা কি দলীয় কর্মসূচি বাস্তবায়নে মাঠে আছেন? তারা কি ঝুঁকি নিয়ে রাজপথে থাকতে চাচ্ছেন? যদি সরকার পতন না হয়, নির্বাচন ঠেকানো না যায়- তাহলে নির্বাচন পরবর্তি সময়ে বিএনপির তৃণমূলের নেতাকর্মীদের কি হবে? এরকম আরও অনেক জটিল প্রশ্নের হিসাব মেলানোর চেষ্টা করছেন মাঠের কর্মীরা। কারণ ইতোমধ্যে বিভিন্ন মামলার কারণে বহু নেতাকর্মী জেল খাটছেন। সক্রিয় নেতাকর্মীদের কেউ কেউ নিজ গৃহে অবস্থান না করে আত্মগোপনে আছেন।

মাঠের নেতাকর্মীরা কেন-ই বা আত্মগোপনে যাবেন না? যেখানে তাদের কেন্দ্রীয় নেতাদের যারা গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন, তারা ব্যতীত বেশির ভাগ নেতাই আত্মগোপনে আছেন। এমন কি যিনি প্রতিদিন দলের মুখপাত্র হিসেবে হরতাল-অবরোধের কর্মসূচি ঘোষণা করছেন বিএনপির সেই সিনিয়র যুগ্ম-মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীও অদৃশ্য জায়গা থেকে ভার্চুয়াল ব্রিফিংয়ের মাধ্যমে প্রতিদিন কর্মসূচি ঘোষণা করছেন। অনেকটা নিষিদ্ধ ঘোষিত রাজনৈতিক সংগঠনের কার্যক্রমের মতো।

বিএনপি যে হরতাল-অবরোধের মতো কর্মসূচি দিচ্ছে সেখানে সাধারণ মানুষের কোনো সম্পৃক্ততা নেই বললেই চলে। কিন্তু এ ধরনের আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যেতে হলে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা সবচেয়ে বেশি জরুরি। এর কোনো বিকল্প নেই। সেই কাজটি বিএনপি গত ১৫ বছরেও করতে পারেনি। ফলে বিএনপির আন্দোলনের সঙ্গে সাধারণ মানুষের সম্পৃক্ততা ঘটেনি। শুধু দলীয় নেতাকর্মী দিয়ে সরকার পতনের আন্দোলনের লক্ষ্য অর্জন করা যে সম্ভব নয়- আমার ধারণা সেটা সম্ভবত আজ পর্যন্ত বিএনপি নেতৃত্ব বোঝে উঠতে পারেনি। বর্তমান বাস্তবতায় যে বিএনপি-জামায়াত জোটের হরতাল-অবরোধ একটা ভোঁতা অস্ত্রে পরিণত হয়েছে সেটাও বিএনপির নেতৃত্ব অনুধাবণ করতে পারছেন না বলে মনে হচ্ছে।

যদি তাই হতো তাহলে বিএনপি নেতৃত্ব নিশ্চয়ই আন্দোলনের বিকল্প কোন পন্থা বা পদ্ধতির কথা ভাবতো। একটা বিষয় খুবই পরিস্কার যে, আন্দোলনের ডাক দিয়ে কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আগের দিনে জ্বালা-পোড়াও করে জনমনে ভীতিকর একটা অবস্থা তৈরি করে হরতাল-অবরোধ সফল হয়ে গেছে- এই মনোবাসনা নিয়ে এসি রুমে বসে থাকলে আন্দোলন কখোনই সফল হবে না। আর সেই আন্দোলন যে মোটেই জনকল্যাণকর নয়, সেটাও নিশ্চিত। সেখান থেকে ইতিবাচক ফল আসবে না এটাও বলে দেয়া যায়।

দেশের মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। তারা এখন আর নিজের খেয়ে রাজনৈতিক নেতাদের স্বার্থসিদ্ধি বা ক্ষমতায় বসানোর বা ক্ষমতা থেকে নামানোর হাতিয়ার হিসেবে নিজেদেরকে ব্যবহার করতে চায় না। এ সহজ অঙ্কটা বিএনপি-জামায়াত জোট নেতাদেরকে বুঝতে হবে। জনগণকে পড়তে হবে। বর্তমান বাস্তবতায় নেতৃত্বকে আরও বিচক্ষণ হতে হবে। মানুষের যেভাবে কল্যাণ হয়, সাধারণ মানুষ যেভাবে চায় সেটা নিয়ে চিন্তা করতে হবে। তাহলে হয়তো সামনের দিনগুলোতে বিএনপির জন্য সম্ভাবনার জায়গা তৈরি হবে। না হলে, একাধিকবার দেশ শাসন করা বিএনপিকে আরও চড়া মূল্য দিতে হতে পারে।

মনে রাখতে হবে, ২০১৩-২০১৪-২০১৫ সালে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার বিরোধী আন্দোলনের নামে যে সহিংস রাজনীতির জন্ম দিয়েছিল সেটি তাদেরকে বিশেষ করে বিএনপিকে রাজনীতিতে অনেক অনেক পিছিয়ে দিয়েছে। এবারও যদি নির্বাচন প্রতিহতের নামে বিএনপি ও তার শরিকরা একই পথে হাঁটে সেটা যে খুব সুখকর কিছু হবে না তা সহজেই অনুমেয়। আশা করি বিএনপি নেতৃত্বের শুভ বুদ্ধির উদয় হবে।

লেখক-সাংবাদিক

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ