বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারকে প্রথম শিল্প বিপ্লব হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। এই বিপ্লবে পানি আর বাষ্পের ব্যবহার করে উৎপাদন বৃদ্ধি করার প্রযুক্তি মানুষের হাতে আসে। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লব হলো বিদ্যুৎ ব্যবহার করে গণ-উৎপাদন। তৃতীয় শিল্প বিপ্লব ইলেকট্রনিকস আর ইনফরমেশন টেকনোলজির বিস্তার। আর বর্তমানে চলছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব কিংবা তথ্য প্রযুক্তির বিপ্লবের যুগ। রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলা ও দূরদর্শী নেতৃত্বের অভাবে আমরা খানিকটা পিঁছিয়ে পড়লেও বর্তমান সে পিঁছিয়ে পরা পুষিয়ে নিতে চলছে সর্বমহলে তোড়জোড়। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি, এনজিও কিংবা প্রাইভেট ফার্মগুলো এ বিপ্লব মোকাবেলায় নিজেদের প্রস্তুত করছেন। আর এ প্রস্তুতিকে সাফল্যমন্ডিত করতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের উপর জোর দেওয়া অত্যন্ত জরুরি।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লব কী? মানব সভ্যতার ইতিহাসে এখন পর্যন্ত তিনটি শিল্পবিপ্লব পাল্টে দিয়েছে সারা বিশ্বের গতিপথ। প্রথম শিল্পবিপ্লবটি হয়েছিল ১৭৮৪ সালে বাষ্পীয় ইঞ্জিন আবিষ্কারের মাধ্যমে। এরপর ১৮৭০ সালে বিদ্যুৎ ও ১৯৬৯ সালে ইন্টারনেটের আবিষ্কার শিল্পবিপ্লবের গতিকে বাড়িয়ে দেয় কয়েক গুণ। তবে আগের তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যেতে পারে ডিজিটাল বিপ্লব। এ নিয়েই এখন সারা দুনিয়ায় তোলপাড় চলছে। এটিকে এখন বলা হচ্ছে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব।
ওয়াল্ড ইকোনমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফে) এর প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী প্রধান ক্লাউস শোয়াব চতুর্থ শিল্পবিপ্লব নিয়ে নিজের লেখা একটি প্রবন্ধে বলেছেন, ‘আমরা চাই বা না চাই, এত দিন পর্যন্ত আমাদের জীবনধারা, কাজকর্ম, চিন্তাচেতনা যেভাবে চলেছে সেটা বদলে যেতে শুরু করেছে। এখন আমরা এক প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। দ্বিতীয় ও তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের ভিত্তির ওপর শুরু হওয়া ডিজিটাল এ বিপ্লবের ফলে সবকিছুর পরিবর্তন হচ্ছে গাণিতিক হারে, যা আগে কখনো হয়নি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, বিশ্বের প্রতিটি দেশের প্রতিটি খাতে এ পরিবর্তন প্রভাব ফেলেছে, যার ফলে পাল্টে যাচ্ছে উৎপাদন প্রক্রিয়া, ব্যবস্থাপনা, এমনকি রাষ্ট্র চালানোর প্রক্রিয়া।
১. কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও মেশিন লার্নিং
২. উন্নত মানের রোবোটিক্স ও অটোমেশন
৩. ইন্টারনেট অফ থিংস
৪. ব্লকচেইন প্রযুক্তি
৫. থ্রি-ডি প্রিন্টিং
৬. কোয়ান্টাম কম্পিউটিং
৭. উন্নত মানের জিন প্রযুক্তি
৮. নতুন ধরনের শক্তি ইত্যাদি বিষয়গুলো চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের সূচনা করেছে বলে মনে করা হচ্ছে ।ডিজিটাল বিপ্লবের এই শক্তির চিত্রটি বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত ‘ডিজিটাল ডিভিডেন্ডস’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনেও উঠে এসেছে। এতে বলা হয়েছে, ইন্টারনেটের মাধ্যমে এখন এক দিনে বিশ্বে ২০ হাজার ৭০০ কোটি ই-মেইল পাঠানো হয়, গুগলে ৪২০ কোটি বিভিন্ন বিষয় খোঁজা হয়। এক যুগ আগেও তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এ পরিবর্তনগুলো ছিল অকল্পনীয়।
অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম কী?
শিক্ষাব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন যোগ করেছে ছড়িয়ে পড়া মহামারি করোনাভাইরাস। স্কুল বন্ধ। স্কুলে গিয়ে পড়ার বদলে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় অনলাইন শ্রেণিকক্ষের পড়ায় অংশ নিচ্ছে বিশ্বের লাখো শিক্ষার্থী। অনলাইনে ক্লাস করাচ্ছেন শিক্ষকেরা। যুগ যুগ ধরে চলে আসা ক্লাসে বসে পড়ার প্রাচীন ব্যবস্থায় এসেছে পরিবর্তন। বিশ্বের অনেক স্থানেই এখন স্কুল বা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনা নতুন মাত্রা পেয়েছে ডেস্কটপ, ল্যাপটপ আর স্মার্টফোনের পর্দায়।
তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে অনলাইন নির্ভর পরিচালিত পাঠক্রমকেই বলা হয় অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম। অনলাইন পাঠ বা শিক্ষা কার্যক্রম বাস্তবায়নের একটি উপকরণ হলো অনলাইন ক্লাস। অনলাইন ক্লাস বলতে বোঝায় জুম, গুগল ক্লাসরুম, গুগল মিট, ওয়েবএক্সের মতো অ্যাপস ব্যবহার করে সরাসরি ক্লাস পরিচালনা। এই অ্যাপসগুলো ব্যবহার করে ক্লাস প্রদান ও গ্রহণ উভয়ই সম্ভব।
অনলাইন পাঠক্রম ছাড়াও বিভিন্ন পদ্ধতিতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হতে পারে। যার মধ্যে রয়েছে শিক্ষা উপকরণকে পাওয়ার পয়েন্ট স্লাইড, ভিডিও রেকর্ডিং, অডিও রেকর্ডিং, হ্যান্ডআউট, গবেষণা প্রবন্ধ/বইয়ের অধ্যায় হিসেবে ই-মেইল বা ফেসবুক ক্লোজ অফিশিয়াল গ্রুপে বা ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া ও নির্দিষ্ট রুটিন মানা, মেসেঞ্জার রুম সুবিধা নিয়ে শিক্ষকের সঙ্গে প্রশ্নোত্তর পর্ব, ক্লাসে ছয় থেকে সাতটি গ্রুপ করে দিয়ে নিজেদের মধ্যে পড়াশোনা নিয়ে আলোচনা করা, নির্দিষ্ট টপিক ধরে ধরে কিছুদিন পরপর গ্রুপ প্রতিবেদন বা বাড়ির কাজ দেওয়া, গুগল লিংকের মাধ্যমে সারপ্রাইজ টেস্ট নেওয়া ইত্যাদি।
অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম ও বিশ্ব পরিস্থিতি
অনলাইন শিক্ষা ধারণাটি অতি প্রাচীন না হলেও অতি সাম্প্রতিকও নয়। পাশ্চাত্যের অনেক দেশের অনেক নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় এ কার্যক্রম করোনার উদ্ভুত ও অগ্রযাত্রার আগেই শুরু করেছে। ২০০০ সালের প্রথম দশক থেকেই ক্যাম্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়সহ যুক্তরাজ্যের বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয় গতানুগতিক শিক্ষার পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে। তারা দেখলেন ভৌগলিকভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের জন্য বা যারা ট্রাফিক সমস্যায় জর্জরিত তাদের জন্য অনলাইন কার্যক্রম ফলপ্রসূ প্রমাণিত হয়েছে। যাদের পর্যাপ্ত পরিমাণ ভৌতিক অবকাঠামো নেই বা যাদের সুশিক্ষিত ও নিবেদিত শিক্ষকমণ্ডলী নেই, তারাও এ পদ্ধতির উপকারভোগী হতে পারেন।
এর সুবিধা হচ্ছে, একটি স্মার্টফোনের মাধ্যমে যেকোনো স্থান থেকে শিক্ষাগ্রহণ করা যায়। ই-লার্নিং এর ৮০ শতাংশের বেশি পাঠ কার্যক্রম ইন্টারনেট নির্ভর। তাই কোথায়ও গিয়ে পড়াশোনা করতে হয় না। ঘরে বসেই তা সম্ভব।
এছাড়া আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) ও মেশিন লার্নিং ব্যবহার করে এখন অনলাইনে শিক্ষাকে আরও ‘কমিউনিকেটিভ’ করা যাচ্ছে। বিস্তারিত বললে, একজন শিক্ষার্থীর যতটা প্রয়োজন, এ অবস্থায় ঠিক ততটাই তাকে শিক্ষাদান করা সম্ভব। এর ফলে একজন শিক্ষার্থী নিজের গতিতে শিখতে পারবে, যা কিনা তার জন্য অধিকতর ফলপ্রসূ হবে। প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থায় ৫০-৬০ জনের ক্লাসে প্রতি ছাত্রকে ধরে ধরে শিক্ষকের দেখিয়ে দেওয়া সম্ভব হয় না।
কিন্তু আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স আর মেশিন লার্নিং শিক্ষার্থী ভেদে যথোপযুক্ত শিক্ষা নিশ্চিত করতে পারে। নিত্যনতুন প্রযুক্তি ব্যবহার করে পৃথিবী-বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় এবং ইনস্টিটিউটগুলোও এখন অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে ডিগ্রি প্রদান করছে। বাংলাদেশ থেকেও অংশ নিয়ে অনেকেই দক্ষতানির্ভর সনদও অর্জন করছেন।
বাংলাদেশসহ গোটা বিশ্বে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম জনপ্রিয়তা পায় কভিট-১৯ এর ভয়াল আক্রমনের ফলে। এর আগে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল রাষ্ট্রগুলো অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের সাথে তেমন পরিচিত ছিলো না।
কোভিড-১৯-এর কারণে সারা বিশ্বে বর্তমানে প্রায় ৪৬ কোটি ৩০ লাখ শিশুর স্কুল বন্ধ। তাই এমতাবস্থায় শিক্ষার্থীদের শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের কোন বিকল্প নেই। তবে শুধুমাত্র করোনাকালে শিক্ষা-কার্যক্রমের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে অনলাইন শিক্ষা জরুরি বিষয়টি কিন্তু শুধু তা নয়।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অভূতপূর্ব সম্প্রসারণে পৃথিবী আজ আক্ষরিক অর্থেই আমাদের হাতের মুঠোয়। তাই বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে শিক্ষার আলোয় বৈশ্বিক নাগরিক হিসেবে নিজেকে তৈরী করতে হলেও অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রম নিশ্চিত করতে যথাযথ প্রস্তুতি অনেক আগে থেকেই আমাদের নেওয়া উচিত ছিল বলে আমি মনে করি।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত থাকা কেন জরুরি?
মানব সভ্যতার ইতিহাস এক অভাবনীয় পরিবর্তন এনেছে এখন পর্যন্ত তিনটি বিপ্লব। যারা তখন বিপ্লবের সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে যেতে পেরেছে তারাই পরবর্তী বিশ্বে নেতৃত্ব দিয়েছে। আর যারা পারে নি তারা উন্নয়নের মহাসড়ক থেকে ছিটকে পড়েছে। আধুনিক বিশ্ব থেকে পিছিয়ে পড়েছে। তবে ধারণা করা হচ্ছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পূর্বেকার তিনটি বিপ্লবকে ছাড়িয়ে যাবে।
এটিকে বিশেষজ্ঞগণ তৃতীয় শিল্পবিপ্লবের এক্সটেনশন হিসেবেও মানতে নারাজ। কারণ গতি বলেন, স্কোপ বলেন কিংবা প্রভাব বলেন, কোনোটাই তৃতীয়টির ধারেকাছে নেই। একেবারে অন্য রকম। বলা যায় এ পরিবর্তন হচ্ছে জ্যামিতিক হারে। আর এই পরিবর্তন প্রভাবিত করে চলেছে আমাদের জীবনকে, বলা যায় জীবনের ৩৬০ ডিগ্রিকেই।
পরিবর্তিত ব্যবস্থাকে বর্ণনা করতে গিয়ে হাভাস মিডিয়ার সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট টম গুডউইন বলেন, বিশ্বের সবচেয়ে বড় ট্যাক্সি কোম্পানি উবারের নিজের কোনো ট্যাক্সি নেই, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মিডিয়া ফেসবুক কোনো কনটেন্ট তৈরি করে না, পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পাইকার আলীবাবার কোনো গুদাম নেই এবং বিশ্বের সবচেয়ে বড় আবাসন প্রভাইডার এয়ারবিএনবির নিজেদের কোনো রিয়েল এস্টেট নেই।
আর এসব কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের প্রতিষ্ঠাতা ক্লাউস সোয়াব প্রযুক্তির এই পরিবর্তনকে দেখছেন চতুর্থ শিল্প বিপ্লব হিসেবে।
তাই পৃথিবীর এ পরিবর্তীত অবস্থার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে কিংবা উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রায় টিকে থাকতে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুত থাকার কোন বিকল্প নেই। যেহেতু চতুর্থ শিল্প বিপ্লব পূর্বের তিনটি বিপ্লবকে ছাপিয়ে যাবে সেহেতু যারা এই বিপ্লবে অংশগ্রহণ করতে পারবে তারাই পরবর্তী বিশ্বকে নেতৃত্ব দিবে আর বাকিদের হয়ত তাদের দাসত্ব করতে হবে।
২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকেই বাংলাদেশে এই নতুন বিপ্লবে অংশগ্রহনের তোড়জোড় শুরু করে দেয়। তারই ধারাবাহিকতায়, ‘আর্কিটেক্ট অব ডিজিটাল বাংলাদেশ’ সজীব ওয়াজেদ জয়ের নির্দেশণায়, দেশজুড়ে চতুর্থ প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্কের বিস্তার, দ্বিতীয় সাবমেরিন ক্যাবল এবং ছয়টি টেরেস্ট্রিয়াল ক্যাবলের সংযোগের মাধ্যমে আমাদের ইন্টারনেট যোগাযোগ বহুমুখীকরণ। দুই হাজার ৬০০ ইউনিয়নে পৌঁছে যাচ্ছে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল। ফলে ২০০৮ সালের আট লাখ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা এখন বেড়ে আট কোটি ছাড়িয়েছে।
এরই মধ্যে ১৮ হাজার ১৩২টি সরকারি দপ্তরকে একটি ‘সরকারি ইন্টারনেট’-এর আওতায় আনা হয়েছে। যশোরের ‘শেখ হাসিনা সফটওয়্যার টেকনোলজি পার্কসহ দেশের সর্বত্র ২৮টি হাইটেক ও সফটওয়্যার পার্ক নির্মাণ। দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যাতে ক্রমান্বয়ে রোবটিকস, বিগ ডাটা অ্যানালিটিকস কিংবা ক্লাউড কম্পিউটিংয়ের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে পারে সে জন্য বানানো হচ্ছে ১২৯টি বিশেষায়িত ল্যাব। এসবকিছুই যেন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের প্রস্তুতির জানান দিচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের সম্ভাবনা
কভিট-১৯ এর পূর্বে বাংলাদেশ অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার সাথে পরিচিত ছিলো না বললেই চলে। প্রথম দিকে শিক্ষার্থীরা অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থায় অনাগ্রহ দেখালেও ক্রমেই এ হার বাড়তে থাকে। এক কথায় বলতেগেলে শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা এখন এই পদ্ধতিতে অব্যস্থ হয়েগেছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা মোতাবেক শুরু থেকে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়।
অনলাইন ক্লাসের একটি সুবিধা হলো এ পদ্ধতিতে ক্লাসগুলো অনলাইনে সংরক্ষিত থেকে যায়। শিক্ষার্থীরা তাদের সুবিধামতো সময়ে এই ক্লাসগুলো দেখে নিতে পারে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে ১২৯ টি ল্যাব স্থাপন করার কারণে ‘ ই-লার্নিং’ পদ্ধতির সম্ভাবনা রয়েছে।
এ সম্ভাবনাগুলো কাজে লাগিয়ে করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরেও যদি অফ লাইনের পাশাপাশি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নেওয়া যায় তাহলে বাংলাদেশে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের চ্যালেঞ্জ সমূহ
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার প্রধান চ্যালেঞ্জ দারিদ্র্যতা, প্রয়োজনীয় উপকরণ, নেট স্পিড, প্রশিক্ষিত প্রশিক্ষক। অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়কেই অনলাইন ডিভাইস যেমন ল্যাপটপ, স্মার্টফোন কিংবা পিসি থাকতে হবে। এই ডিভাইসে কানেক্ট থাকার জন্য চাই উচ্চ গতি সম্পূর্ণ ইন্টারনেট সংযোগ। অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল স্থাপনের কারণে বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতি বৃদ্ধি পেলেও প্রত্যন্ত অঞ্চলে মোবাইল নেটের অবস্থা নাজেহাল। এছাড়াও এই ইন্টারনেট সংযোগের জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন রয়েছে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যমতে, বর্তমানে দেশে দারিদ্র্য হার ২০.৫ এবং হত দারিদ্র্যের হার ১০.৫। সানেম, সিপিডিসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা বলছে করোনায় এ হার ৩৫ থেকে ৪২ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আয় কমেছে ৪০ শতাংশ জনগণের, নতুন করে দারিদ্র্য হয়েছে প্রায় ২ কোটি ৪৫ লক্ষ জনগণ। তাই এমতাবস্থায় এই দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর জন্য এই ডিভাইস ক্রয় এবং ইন্টারনেটে কানেক্ট থাকা বড় চ্যালেঞ্জ।
অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনার জন্য দক্ষ প্রশিক্ষক বা শিক্ষকের প্রয়োজন রয়েছে। শহর অঞ্চলের শিক্ষকগণ অনলাইন ব্যবস্থায় পারদর্শী হলেও গ্রাম অঞ্চলের শিক্ষকগন এই পদ্ধতিতে ততটা পারদর্শী নয়।
পরিসংখ্যান বলছে, বাংলাদেশের ৭৫ শতাংশ জনগণ গ্রামে বসবাস করে। তাই এই গ্রামীন জনগোষ্ঠীকেও অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের আওতায় নিয়ে আসা বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ।
এছাড়া এক টানা দীর্ঘসময় খালি চোখে কম্পিউটার কিংবা ফোনের স্কিনের দিকে তাকিয়ে থাকার ফলে চোখে সমস্যা, ঘাড়ে কিংবা মেরুদনণ্ডে ব্যাথাসহ নানাবিধ স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা রয়েছে।
অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় করণীয়
প্রথমত বিটিসিএল উদ্যোগ গ্রহণ করে মোবাইল অপারেটরদের সাথে সমঝোতা করে দেশের সর্বত্রই ৩জি+ জেনারেশন কিংবা চলমান ৪জি নেটওয়ার্ক নিশ্চিত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের জন্য তুলনামূলক কম মূল্যে কিংবা সরকার ভর্তুকি দিয়ে সম্ভব হলে বিনামূল্যে ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে হবে। তৃতীয়ত যাদের অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার উপযোগী ডিভাইস নেই তাদের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ডিভাইসের ব্যবস্থা করতে হবে। চতুর্থত শিক্ষকদের অনলাইন শিক্ষা ব্যবস্থার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করতে হবে। পঞ্চমত প্রতিটি প্রতিষ্ঠানের প্রযুক্তি ও ভৌত অবকাঠামো উন্নয়ন করে সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে। যাতে করে অনলাইনে ক্লাস ও পরীক্ষা গ্রহণ করা সংশ্লিষ্ট সকলের জন্য সহজসাধ্য হয়।লেখক: জাফর ইকবাল,
লেখক, সাংবাদিক ও বিতার্কিক
তথ্য সূত্র: তথ্য মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইট, বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো, গুগল, উইকিপিডিয়া, বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত বিভিন্ন তথ্য প্রযুক্তি বিশ্লেষকদের লেখা।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ