ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

সংবিধান জ্ঞান ছাড়া রাজনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়

প্রকাশনার সময়: ০৫ নভেম্বর ২০২৩, ১৩:৪৩

আধুনিক মানব সভ্যতার অন্যতম অবদান সাংবিধানিকতা। সমসাময়িক বিশ্বে প্রায় সব দেশেই সংবিধান রয়েছে। এটি রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন, রাষ্ট্রের আইনগত ভিত্তি বা রাষ্ট্র পরিচালনার দলিল। একটি জাতির আইনগত, সামাজিক এবং রাজনৈতিক অধিকারগুলো এই দলিলে লিপিবদ্ধ করা হয় যা ওই দেশের আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার, রাজনৈতিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত করে। অধিকাংশ সংবিধানে নাগরিকদের মৌলিক অধিকার এবং রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ সন্নিবেশিত থাকে। এ কারণে সংবিধানকে বলা হয় একটি দেশের আয়না ( Mirror of a Country)। বর্তমান আফ্রিকার সংবিধানের রূপকার আলবেই শ্যানস এর ভাষায় সংবিধান একটি জাতির আত্মজীবনীস্বরুপ ( Autobiography of a nation)। রাষ্ট্রের তিনটি সর্বোচ্চ অঙ্গ নির্বাহী বিভাগ, আইন বিভাগ এবং বিচার বিভাগের মতো মৌলিক রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সম্পর্কগুলো সংবিধানে লিপিবদ্ধ করা হয় বিধায় বৃটিশ রাজনীতি বিশেষজ্ঞ এবং ইতিহাসবিদ স্যামুলয়েল এফ ফাইনার সংবিধানকে বলেছেন ক্ষমতা সম্পর্কের আত্মজীবনী (Autobiography of Power Relationship)।

অন্যদিকে ডোলাল্ড এস লাটয বলেছেন, “The Constitution marries with Power.” বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক শামীমা সুলতানা সীমা বনাম বাংলাদেশ [৫৭ ডিএলআর (২০০৫) ২০১ ] মামলায় বলেছেন- সংবিধানের শক্তি হলো এর অন্তর্নিহিত ক্ষমতা। এটি তার আত্মা এবং এই সংবিধানই সকল ক্ষমতার উৎস।

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আইন সংবিধান । মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারণ করে জনগণের সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর জাতীয় সংসদে সংবিধান গৃহীত হয় এবং ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। সংবিধান প্রণয়ের উদ্দেশ্যে গঠিত গণপরিষদের সংবিধান প্রণয়ন কমিটি ৭৪টি বৈঠকে মিলিত হয়ে ৩০০ ঘণ্টার সময় ব্যয় করে সংবিধান রচনা করেছিল যা সময় হিসেবে লেগেছিল ৯ মাস। নাতিদীর্ঘ সময়ে রচিত এই সংবিধান কেবল সাদার উপর কালো অক্ষরে লিখিত কোনো দলিল নয়, নয় কোনো বিদেশি শক্তির চাপিয়ে দেওয়া মতাদর্শ। বাংলাদেশের সংবিধান হলো লাখো শহীদের রক্ত, সম্ভ্রমহারা মা-বোনের ত্যাগ এবং লক্ষ কোটি রণাঙ্গনের বীর আর মুক্তিকামী মানুষের আবেগ, অনুভূতি এবং আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক। এই সংবিধান হলো আমাদের প্রেরণার বাতিঘর, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার এক দৃঢ় প্রত্যয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর সংসদে সংবিধান গ্রহণের সময় স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করেছিলেন, এই সংবিধান লিখিত হয়েছে শহীদদের রক্তের বিনিময়ে এবং এই সংবিধান জনগণের আশা আকাঙ্ক্ষার মূর্ত প্রতীক হয়ে থাকবে।

প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিরা সংবিধান কর্তৃক প্রদত্ত ক্ষমতা প্রয়োগ করে রাষ্ট্র পরিচালনা করে থাকেন। সেজন্যই আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলের মুখপাত্ররা প্রায় সময় সংবিধানের রেফারেন্স দিয়ে থাকেন। কেবল রাজনীতিবিদ নন, রাষ্ট্রের সচেতন মহল থেকে শুরু করে সাধারণ নাগরিকরা ও সংবিধানের দোহাই দিয়ে নিজেদের অধিকারের পক্ষে সরব থাকেন। এতে জাতি হিসেবে আমাদের সংবিধান নিষ্ঠতার দিকে ইঙ্গিত করে। কিন্তু যে সংবিধানের রেফারেন্স দিয়ে আমরা আমাদের অধিকারকে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করি তাকে আমরা কতটুকুই বা জানি, আদৌ কি আমরা সেই সংবিধানকে চোখে দেখেছি? এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া আইনের ছাত্র-শিক্ষক ছাড়া অন্য ডিসিপ্লিনের জন্য কিছুটা কঠিন।

আইনের জগতে একটি বহুল প্রচলিত ম্যাক্সিম হলো ল্যাটিন ভাষায় Ignorantia juris non excusat. অর্থাৎ আইন না জানা কোনো অজুহাত হতে পারে না। সংসদ বা অথরিটি তথা সরকার যে আইন করবে, তা জনগণের জানা থাকতে হবে এবং সে অনুযায়ী চলার দায়িত্ব জনতার। এবং সে আইনটা যদি হয় সংবিধান, তাহলে তো শিক্ষিত থেকে শুরু করে সাধারণ জনতা সবারই জানার কথা। কিন্তু পরিতাপের বিষয় হলো সাধারণ জনগণ তো দূরের কথা আমাদের দেশের শিক্ষিত সমাজ তথা ছাত্ররাও সংবিধান সম্পর্কে জানে না। বাংলাদেশের সংবিধান সম্পর্কে তারা কতটুকু জানে, আদৌ সংবিধান চোখে দেখেছে কিনা বা সংবিধান দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর লাইব্রেরিতে অন্যান্য রেফারেন্স বইয়ের সাথে সংগ্রহে আছে কিনা প্রভৃতি বিষয়ে জানার জন্য আমি জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ গবেষণা এবং সম্প্রসারণ প্রকল্পের অধীন ২০২২-২০২৩ অর্থ বছরে একটা প্রস্তাবনা জমা দিই এবং তা অনুমোদন হয়। গত ৫ জুন জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত দ্বিতীয় আন্তর্জাতিক কনফারেন্সে গবেষণার রেজাল্ট উপস্থাপন করি।

গবেষণা সহায়তার অপ্রতুলতা, সময়ের স্বল্পতা এবং এতদসংক্রান্ত তথ্য উপাত্তের ঘাটতির কারণে আমি প্রাথমিকভাবে ময়মনসিংহ জেলার নিম্ন মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর এবং মাদ্রাসা লেবেলের দাখিল থেকে কামিলের ছাত্র-ছাত্রীদের উপর গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করি। গবেষণায় ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার ১৭২টি স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় ও মাদ্রাসার মোট ১০২৭৯ জন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। গবেষণায় দেখা যায়, নিম্ন মাধ্যমিক থেকে স্নাতকোত্তর লেবেলের ৫৬ শতাংশ শিক্ষার্থী ই জানে না সংবিধান কি। তার মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক লেবেলে ৭৩%, উচ্চ মাধ্যমিক লেবেলে ৩৭%, দাখিল লেবেলে ৮৮% এবং আলিম লেবেলে ৬২%। তবে স্নাতক লেবেলে না জানার সংখ্যা কিছুটা কম যা শতকরা হিসেবে ১৯ ভাগ। ছাত্র ছাত্রীদের প্রশ্ন করা হয়, বাংলাদেশে যে একটি সংবিধান আছে তা আপনারা জানেন কিনা? উত্তরে মোট ছাত্র ছাত্রীর ২৭ শতাংশই না বোধক উত্তর দিয়েছেন। এদের মধ্যে নিম্ন মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক যথাক্রমে ৪৮% এবং ৩৩%, দাখিল এবং আলিম যথাক্রমে ৬১% এবং ৩৮%। স্নাতকে মাত্র ৩ শতাংশ না বোধক উত্তর দিয়েছেন।

প্রশ্নমালায় একটি প্রশ্ন ছিল, আপনারা কি সংবিধান দেখেছেন? মাত্র ১৬ শতাংশের বেশি কিছু ছাত্র-ছাত্রী বলেছেন তারা সংবিধান দেখেছেন। কিন্তু যখনই তাদের সংবিধানের কভার পেজের রং লিখতে বলা হলো তখন তা ১১ শতাংশে নেমে আসে। অনেক ছাত্র ছাত্রী বিসিএস বা চাকরির পরীক্ষায় সংবিধান বিষয়ক প্রশ্ন আসায় সংবিধান সম্পর্কে কিছুটা ওয়াকিবহাল। এদের আবার অধিকাংশই পকেট সংবিধান ব্যবহার করেন। সে হিসেবে সংবিধান দেখেছেন এমন নিম্ন মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক ছাত্র-ছাত্রীদের হার যথাক্রমে ১.২০% ও ১.৮৮%, দাখিল এবং আলিম লেবেলে হার যথাক্রমে ০.৬% ও ০.৯৭%। স্নাতক লেবেলে মাত্র ৩৪% শিক্ষার্থী সংবিধান দেখেছেন। কৌতূলবশত জানতে চেয়েছিলাম কারো বাসায় কোনো সংবিধানের কপি আছে কিনা বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংবিধান দিবস পালন বা এই বিষয়ে কোনো ওয়ার্কশপ সেমিনার হয় কিনা। উত্তরে ১০০% ছাত্র-ছাত্রীই না বোধক উত্তর দিয়েছেন। এর পাশাপাশি স্নাতক লেবেলের ছাত্র-ছাত্রীদের আইন বিভাগ, শাসন বিভাগ, বিচার বিভাগ, রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি, মৌলিক অধিকারসহ সংবিধান থেকে কিছু মৌলিক প্রশ্ন করা হয় যার ৩৬% ই তারা জানে না।

জেলার ১৭২ টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, লাইব্রেরিয়ানের সাথে কথা বলে জানার চেষ্টা করেছি তাদের প্রতিষ্ঠানে কোনো সংবিধানের কপি আছে কিনা। নিম্ন মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক লেবেলের ১০৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৪টি প্রতিষ্ঠানে (বিদ্যাময়ী সরকারি বালিকা বিদ্যালয় এবং নটরডেম কলেজ ময়মনসিংহে অরিজিনাল কপি) সংবিধানের কপি পাওয়া গেছে যা শতকরা হিসেবে মাত্র ৩.৭৪%। দাখিল-আলিম-মাদ্রাসা লেবেলের ৩০টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে একটি প্রতিষ্ঠান সংবিধান আছে মর্মে আশ্বস্ত করেছেন যা শতকরা হিসেবে মাত্র ৩.৩৩%। কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় লেবেলের ৩৫টি প্রতিষ্ঠানের মাত্র ৯টি প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরিতে সংবিধানের কপি দেখা গেছে।

গত বছর সংবিধানের ৫০ বছর পূর্তি উদযাপন করা হয়েছে। অথচ গবেষণায় দেখা যাচ্ছে সংবিধানকে ছাত্রদের মাঝেও সেভাবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া যায়নি। আশ্চর্যের বিষয় হলো ময়মনসিংহ জেলার প্রায় ৮৯ শতাংশ শিক্ষার্থী সংবিধানই দেখেনি! স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, বিশ্ববিদ্যালয় মিলিয়ে ৯২ শতাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সংবিধানই নেই। আমরা যখন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে তথ্য সংগ্রহে যাই, তখন শিক্ষক শিক্ষিকারা বলেছেন, তারা নিজেরাই সংবিধান দেখেননি এবং কৌতূহলবশত তারা আমাদের কাছ থেকে সংবিধান দেখতে চেয়েছেন।

সংবিধান সম্পর্কে সচেতন করার সময় এসেছে। একটি কার্যকর গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন দেশ গড়ে তোলার জন্য সংবিধান সম্পর্কে জানার বিকল্প নেই। অন্যান্য দিবসের মতো সংবিধান দিবসকে জাঁকজমকভাবে উদযাপন করা, পাঠ্যবইয়ে সাংবিধানিক বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা, শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও আইন মন্ত্রণালয় যৌথভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিনামূল্যে সংবিধান কপি বিতরণপূর্বক প্রত্যেকটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সংবিধান রাখা বাধ্যতামূলক করে এই ব্যাপারে ভূমিকা রাখতে পারে। এতে করে ক্লাসে পড়ানোর সময় সাংবিধানিক ইস্যু আসলে সংবিধান সরাসরি ছাত্র-ছাত্রীদের দেখানো যাবে। যা তাদেরকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আরও বেশি আকর্ষিত করে তুলবে। এছাড়াও বিভিন্ন এনজিও, বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের অধীন ল ক্লিনিক বা কনস্টিটিউশন ক্লিনিক প্রতিষ্ঠা করে আইনজ্ঞদের নিয়ে সংবিধান দিবসে বিভিন্ন সেমিনার, ওয়ার্কশপসহ নানাবিধ আয়োজনের মাধ্যমে সংবিধান সম্পর্কে ধারণা দিতে পারে। বলাবাহুল্য, সংবিধানের জ্ঞান ছাড়া আমাদের রাজনৈতিক মুক্তি সম্ভব নয়।

প্রভাষক : আইন ও বিচার বিভাগ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ ।

অনুলিখন: আলমগীর হোসেন

নয়া শতাব্দী/এসএ

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ