ঢাকা, শুক্রবার, ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১, ১৬ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বঙ্গবন্ধু টানেল: যোগাযোগের নতুন দিগন্ত

প্রকাশনার সময়: ২৮ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৪৩

বর্তমান সরকারের আমলে যোগাযোগ ব্যবস্থায় এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন রাশিয়া যুদ্ধের কবলে পড়ে সারা বিশ্বে যখন অর্থনৈতিক মন্দা তখন বাংলাদেশে উদ্বোধন হয়েছে পদ্মা সেতু ও মেট্রোরেল। পদ্মা সেতু এবং মেট্রোরেলের পর খুলতে যাচ্ছে বাংলাদেশের উন্নয়নের আরেকটি স্বপ্ন দুয়ার ‘বঙ্গবন্ধু টানেল।’

কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত দেশের প্রথম এ টানেলটি আগামী ২৮ অক্টোবর উদ্বোধন হবে। উদ্বোধনের পরদিনই যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। এর মাধ্যমে কক্সবাজারের সঙ্গে যোগাযোগব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আসবে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। টানেলের প্রকল্প সূত্র জানায়, সার্বিক নিরাপত্তার জন্য সেখানে ১০০টিরও বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে। সেই সঙ্গে টানেলে কোনভাবেই ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশি গতিতে গাড়ি চলতে পারবে না বলেও নির্দেশনা দেয়া হয়। টানেলের প্রকল্প পরিচালক মো. হারুনুর রশিদ জানান, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের কাজ প্রায় শেষ। বর্তমানে যান্ত্রিক ও বৈদ্যুতিক কাজ চলছে। ২৮ অক্টোবর এটি উদ্বোধন করা হবে। পরদিনই যান চলাচলের জন্য উন্মুক্ত করে দেয়া হবে। তিনি আরও জানান, টানেলে ১০০টিরও বেশি সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো হয়েছে; যা মনিটরিং রুম থেকে পর্যবেক্ষণ করা হবে। সেই সঙ্গে গাড়ির গতিবেগ কোনভাবেই ঘণ্টায় ৬০ কিলোমিটারের বেশি হতে পারবে না। টানেলের মধ্যে জনসাধারণের জন্য নির্দেশনা ব্যবস্থা থাকবে এবং সেখানে আটটি রেডিও চ্যানেলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নির্দেশনাগুলো চলতে থাকবে।

চট্টগ্রামের পতেঙ্গা-দক্ষিণ চট্টগ্রামের আনোয়ারা উপজেলার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনকারী কর্ণফুলী নদীর তলদেশে এই টানেল নির্মাণ কাজ ইতোমধ্যে প্রায় সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে শেষ মুহূর্তের কাজ। সব ঠিক থাকলে আগামী ফেব্রুয়ারিতে এই টানেলে যানবাহন চলাচল শুরু করবে বলে প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা আশা প্রকাশ করেছেন। ইতোমধ্যে টানেলের পূর্তকাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে নিরাপত্তা বলয় তৈরি, বৈদ্যুতিক সংযোগসহ খুঁটিনাটি কাজ। সবকিছু ঠিক থাকলে ফেব্রুয়ারি থেকেই টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে বলে আশা করা হচ্ছে। কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ বলেন, টানেলের দুটি টিউব (পূর্তকাজ) তথা সিভিল ওয়ার্ক শতভাগ সম্পন্ন। টানেল দিয়ে কোন ধরনের গাড়ি চলবে তা নির্ধারণ করবে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কমিটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি শুধু বলতে পারি, পায়ে হেঁটে কোনো মানুষ টানেল পার হতে পারবে না। কেননা টানেলে দাঁড়ানো যাবে না। গ্যাস সিলিন্ডারসহ বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ বহনকারী কোনো গাড়ি এই টানেল দিয়ে চলতে দেয়া হবে না। ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম এই টানেল নির্মিত হচ্ছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায়। নদীর তলদেশে হওয়ায় যে কোনো সময় পানি জমতে পারে আশঙ্কায় টানেলের মধ্যে বসানো হচ্ছে ৫২টি সেচ পাম্প। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। টানেলের দুই প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক ও ৭৭২ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার। টানেল দিয়ে কোন ধরনের গাড়ি চলবে এবং টোল কত হবে, তার একটি প্রস্তাবিত তালিকা করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত টোল হার ২০ ডিসেম্বর অনুমোদন দিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।

টানেল দিয়ে চলতে প্রাইভেটকার, জিপগাড়ি ও পিকআপকে ২০০ টাকা করে দিতে হবে। মাইক্রোবাসকে ২৫০, ৩১ কিংবা এর চেয়ে কম আসনের বাসকে ৩০০, ৩২ কিংবা তার চেয়ে বেশি আসনের বাসকে ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। পাশাপাশি পাঁচ টনের ট্রাককে ৪০০, পাঁচ থেকে আট টনের ট্রাককে ৫০০, আট থেকে ১১ টনের ট্রাককে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। টানেলের ভিতর দিয়ে মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার গাড়ি চলাচল করতে পারবে না। টানেলের নিরাপত্তা তথা দুর্ঘটনা এড়াতে এসব ছোট যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হবে না।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, টানেল চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন একধাপ এগিয়ে যাবে। টানেলকে ঘিরে রাজধানীর সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরীর এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। ইতোমধ্যে আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে সংযোগ সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠছে ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প-কারখানা। টানেল ঘিরে পর্যটন ও শিল্পায়নসহ অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র আড়াই মিনিট। সময় বেঁচে যাওয়ায় অর্থনীতিতে গতি আসবে। টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে চার হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এই ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তবে ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়বে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে। টানেল নির্মাণের আগে ২০১৩ সালে করা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, টানেল চালুর পর এর ভিতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সেই হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে, যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে টানেলের নির্মাণ কাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। তবে সংযোগ সড়কসহ টানেলের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। নদীর নিচে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ মিটার ব্যাসের দুটি টিউব। এর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলে টিউব দুটি থাকলেও সংযোগ পথ আছে তিনটি। এর মধ্যে একটি বিকল্প পথ হিসেবে প্রথম দুটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে। দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রথম সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৪ মিটার। দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩৪ মিটার। শেষটির দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৭৪ মিটার। প্রতিটির ব্যাস গড়ে সাড়ে চার মিটার।

কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। নদীর মাঝ পয়েন্টে এই গভীরতা প্রায় ১৫০ ফুট। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার। চট্টগ্রামে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে টানেলটি নদীর তলদেশ হয়ে চলে গেছে আনোয়ারার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থানে। চট্টগ্রাম চেম্বার সভাপতি মাহবুবুল আলম এক সাক্ষাৎকারে বলেন, “বঙ্গবন্ধু টানেল নির্মাণ করা হয়েছে ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ আদলে। টানেলের মাধ্যমে বন্দর নগরী চট্টগ্রামের বিস্তৃতি ঘটবে। ব্যবসা ও শিল্পের সমৃদ্ধি ঘটবে। মজবুত হবে আমাদের অর্থনীতির ভিত।” তিনি বলেন, একটি দেশের উন্নয়নের চিত্র পরিমাপ করা হয় যোগাযোগ অবকাঠামো দিয়ে। কর্ণফুলী নদীর এই টানেল ও শহরের এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের মাধ্যমে চট্টগ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থায় আমূল পরিবর্তন আসবে। পাশাপাশি টানেলের কারণে চট্টগ্রামের ব্যবসা বিকাশে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করবে।

বঙ্গবন্ধু টানেলের মুখ লাগোয়া কালাবিবির দিঘি এলাকায় বেশ কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান তাদের শাখা খুলেছে। বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক আনোয়ারা শাখার এসএমই ইনচার্জ এস এম মঈন উদ্দীন আজাদ বলেন, কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মিত বঙ্গবন্ধু টানেলের মাধ্যমে বৃহত্তর চট্টগ্রামের ব্যবসা-বাণিজ্যে আমূল পরিবর্তন আসবে। জিডিপিতে যা সরাসরি অবদান রাখবে। এখানে নতুন নতুন শিল্প গড়ে উঠছে। এতে অসংখ্য কর্মসংস্থান তৈরি হবে। বাড়বে অর্থের আদান-প্রদান। যে কারণে ব্যবসায়ীদের গ্লোবালাইজ ও আন্তর্জাতিক মানের সেবা দিতে বেঙ্গল ব্যাংক এরই মধ্যে নতুন শাখা চালু ছাড়াও ব্যবসাবান্ধব বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। টানেল ঘিরে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ী মহলেও উচ্ছ্বাস বাড়ছে। বঙ্গবন্ধু টানেলকে বাংলাদেশের সমৃদ্ধির চিহ্ন হিসেবে উল্লেখ করেছেন জুনিয়র চেম্বার চট্টগ্রামের সাবেক সভাপতি ব্যবসায়ী মো. গিয়াস উদ্দিন। তিনি বলেন, নিজেদের টাকায় পদ্মা সেতু নির্মাণ করে প্রধানমন্ত্রী পুরো বিশ্বকে দেখিয়ে দিয়েছেন। বাংলাদেশের সক্ষমতার প্রমাণ দিয়েছেন। এখন কর্ণফুলী নদীর তলদেশে বঙ্গবন্ধু টানেল বাংলাদেশের সমৃদ্ধির চিহ্ন হয়ে থাকবে। এ টানেল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে যোগ করবে নতুন মাত্রা। দক্ষিণ চট্টগ্রাম সরাসরি শিল্পায়নে যুক্ত হবে। আর্থ-সামাজিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে। টানেলটি চালু হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতিতে এর বিশাল প্রভাব পড়বে। এটি চট্টগ্রামের দক্ষিণ ও উত্তরাঞ্চলকে সংযুক্ত করবে, যা এ অঞ্চলের মানুষের জন্য অর্থনৈতিক সুযোগ সৃষ্টি করবে। এ ছাড়া, এটি কর্ণফুলীর উভয় পাশে যানজট ও যাতায়াতের সময় কমিয়ে আনবে এবং কক্সবাজারের মহেশখালী ও মাতারবাড়ীতে গভীর সমুদ্র বন্দর এবং অর্থনৈতিক অঞ্চল তৈরি সম্পন্ন হওয়ার পর আরও বড় ভূমিকা পালন করবে। সর্বোপরি দেশের যোগাযোগের পাশাপাশি অর্থনীতিতে আনবে আশাব্যঞ্জক পরিবর্তন।

লেখক: কবি ও প্রাবন্ধিক

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ