ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কর্মক্ষম দুটি হাত দায় নয়, আশীর্বাদ

প্রকাশনার সময়: ০৩ অক্টোবর ২০২৩, ১২:৪৬

জনসংখ্যা একটি দেশের প্রয়োজনীয় জনশক্তি জোগায়। আবার এ জনসংখ্যাই বিশাল আকার ধারণ করে সঞ্চয় ও বিনিয়োগ হ্রাসের মাধ্যমে উন্নয়ন ব্যাহত করতে পারে।

কথায় আছে, মুখ দিয়েছেন যিনি আহার দেবেন তিনি। আহার তবু এখনো জুটছে। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ন ও নানাবিধ কারণে আবাদি জমি দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদন সংকট না হলেও অদূর ভবিষ্যতে খাদ্য সংকট দেখা দেবে নিশ্চিত। তাই শুধু সন্তান উৎপাদন নয় সন্তানের দুটি হাতকে কর্মক্ষম করে মেশিনে রূপান্তরিত করতে হবে।

জনসংখ্যা যেকোনো দেশের উন্নয়ন, অগ্রগতি ও ঐশ্বর্যের প্রধান নিয়ামক শক্তি। এ জনসংখ্যাকে কাম্য জনসংখ্যায় পরিণত করতে পরিকল্পিত পরিবার খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। পরিকল্পিত জনসংখ্যা, খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসহ অন্যান্য মৌলিক অধিকার পূরণের পাশাপাশি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বাংলাদেশের আয়তন, অবস্থান, জনসংখ্যা, প্রাকৃতিক সম্পদ, পরিবেশ ও আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে পরিকল্পিত পরিবার গঠনের বিকল্প নেই।

জনসংখ্যা দায় নয় এটি সম্পদ। জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞদের ভাষায় বাংলাদেশের জন্য এখন ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যা থেকে ‘লভ্যাংশ’ পাওয়ার সময়। জনমিতির পরিভাষায় ডিভিডেন্ড বলতে বোঝায় ১৫ থেকে ৫৯ বছর বয়সি মানুষের আধিক্য। এ বয়সসীমার মানুষই সবচেয়ে কমর্ক্ষম, যারা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারেন। সেখানে বাংলাদেশে ৬৫ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে। এ সময়কে জনসংখ্যার বোনাসকাল বলে। আর এ সময়টাতে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী সবচেয়ে কম থাকে। আর সবচেয়ে বেশি থাকে কর্মক্ষম জনসংখ্যা।

এ বয়সসীমার মানুষই সবচেয়ে কর্মক্ষম, যারা জাতীয় অর্থনীতিতে অবদান রাখতে পারেন। কিন্তু এ কর্মশক্তির দক্ষতা বাড়িয়ে দেশ ও বিদেশের শ্রমবাজার থেকে কাঙ্ক্ষিত প্রাপ্তি নেই বাংলাদেশের। অস্ট্রেলিয়া, জাপানসহ বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ যেখানে কর্মক্ষম জনগোষ্ঠী স্বল্পতায় শঙ্কিত, বাংলাদেশে সেখানে ৬৫ শতাংশ মানুষের বয়স ১৫ থেকে ৫৯ এর মধ্যে। ২০১২ সালে এ বোনাসকালে প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। এ সময়টাতে সবচেয়ে কম থাকে নির্ভরশীল জনগোষ্ঠী। আর সবচেয়ে বেশি থাকে কর্মক্ষম জনসংখ্যা। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, দেশে প্রতিবছর ২০ লাখ তরুণ শ্রমবাজারে ঢুকছেন। তাদের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করা তরুণও রয়েছেন। কিন্তু যোগ্যতা অনুযায়ী তারা চাকরি পাচ্ছেন না। বিদেশে শ্রমবাজারে রয়েছে প্রায় ৭০ লাখেরও বেশি বাংলাদেশি। তাদের বেশির ভাগই অদক্ষ শ্রমিক। বাংলাদেশ থেকে অনেক কম জনশক্তি রপ্তানি করেও কয়েকগুণ বেশি রেমিট্যান্স আয় করে ফিলিপাইনসহ এশিয়ার অনেক দেশ। দক্ষতাই তাদের মূল পুঁজি, যা বাংলাদেশের নেই বললেই চলে। বিশেষজ্ঞদের অভিযোগ, বাংলাদেশের জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে রূপান্তরিত করতে যে ধরনের পদক্ষেপ নেয়া দরকার, সরকার তা নিচ্ছে না। শুধু দেশেই নয়, বিদেশের শ্রমবাজারেও রয়েছে দক্ষ জনশক্তির বিরাট চাহিদা। সেই চাহিদা পূরণে দক্ষতা তৈরির সরকারি উদ্যোগ পর্যাপ্ত নয়। জনশক্তি রপ্তানিতে বেসরকারি খাত মূল ভূমিকা পালন করলেও বিদেশের শ্রমবাজার উপযোগী দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে তাদের ভূমিকাও গৌণ।

এমন একটা সময় ছিল যখন এমন কোনো পরিবারই ছিল না যার সন্তান সংখ্যা ১০/১২ টার কম। বাংলাদেশে বর্তমানে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারে সন্তান নেয়ার হার কম হলেও নিম্নবিত্ত পরিবারে সন্তান নেয়ার হার এখনো আশঙ্কাজনক। বস্তির একটি পরিবার মনে করে, একটি সন্তান মানে একটি আয়ের উৎস। যদি পাঁচটা ছেলে থাকে তাহলে রিকশা চালালেও রোজ কম করে হলেও ৫০০ টাকা নগদ আয়। অর্থাৎ পাঁচ ছেলের আয় ২৫০০ টাকা। তাই তারা বাড়িয়ে চলেছে জনসংখ্যা। তাই উপার্জনক্ষম সন্তান পরিবারের জন্য বোঝা নয় বরং আশীর্বাদ।

বর্তমান পৃথিবীতে জনসংখ্যাকে বোঝা হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু পৃথিবীতে মানুষ কখনো বোঝা নয়। পৃথিবীতে যে সম্পদ রয়েছে সে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে পারলে এবং পৃথিবীতে বিরাজমান প্রাকৃতিক শক্তিতে উদ্ভাবনজুড়ে দিতে পারলে পৃথিবীর জনসংখ্যা আরও হাজার বছর বাড়লেও এখানে মৌলিক চাহিদাগুলোর কোনো অভাব হবে না। বর্তমান পৃথিবীর রাজনৈতিক ব্যর্থতা, অর্থনৈতিক তত্ত্বের ব্যর্থতা এবং বিজ্ঞানীদের সময়ের সঙ্গে উদ্ভাবনী ব্যর্থতার দায় চাপিয়ে দেয়া হয়েছে মানুষের ওপর। তাই জনসংখ্যাকে দরিদ্র বিশ্বে বোঝা হিসেবে দেখা হয়। পৃথিবীতে প্রায় ৮৫০ কোটি একর চাষযোগ্য জমি রয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ৩৫০ কোটি একর জমিতে চাষ হচ্ছে। তার মানে এখনো বিশ্বে যে পরিমাণ জমিতে আবাদ হচ্ছে তার দ্বিগুণ জমিতে চাষ করা সম্ভব। আবার এর মধ্যে ৪০০ কোটি একর জমি হবে দো-ফসলা। বিদ্যমান জমিতে উন্নত জাতের বীজ ব্যবহার করেও উৎপাদন দ্বিগুণ করা সম্ভব, যার উদাহরণ বাংলাদেশ। চাষ অযোগ্য জমিকে চাষযোগ্য করা যাবে যদি সময়ের সঙ্গে সমান্তরাল গতিতে বিজ্ঞান উন্নত হয়। বিজ্ঞান উন্নত হবে কী করে, যে বিশ্বের সিংহভাগ অর্থ, সম্পদ আর মেধা ব্যয় করা হয় মানুষ হত্যার মরণাস্ত্র তৈরির পেছনে, সে বিশ্বের বিজ্ঞানীদের আর রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আর কতটুকুই বা আশা করা যায়?

বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ে নিযুক্ত প্রধান অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন এ বিষয়ে বলেন, জনসংখ্যাকে জনশক্তিতে পরিণত করতে যে ধরনের পদক্ষেপ দরকার, তা দেখা যাচ্ছে না। বেকারদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে হবে। এজন্য বিনিয়োগ বাড়ানো জরুরি। কিন্তু কয়েক বছর ধরে বিনিয়োগ স্থবির। তিনি বলেন, ‘বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়াতে হবে। তাহলে জনসংখ্যাকেও জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব।’

জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে নিম্নোক্ত বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য করতে হবে:

প্রথমত, সর্বাধিক কর্মক্ষম এ জনগোষ্ঠীকে সর্বাধিক কাজে লাগাতে হলে প্রচুর কাজের সুযোগ এবং পরিবেশ তৈরি করতে হবে। এর জন্য প্রয়োজন সংঘাতমূলক রাজনীতি এড়িয়ে গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতাকে অক্ষুণ্ন রাখা।

দ্বিতীয়ত, ব্যক্তি উদ্যোগকে সর্বোচ্চ সুযোগ দিতে হবে। যাতে প্রচুর কর্মসংস্থান সৃষ্টি হতে পারে। সবার মধ্যে আত্মবিশ্বাস সৃষ্টির জন্য ও আয় বৈষম্য কমিয়ে রাখার প্রয়োজনে দুর্নীতি দমনে সর্বোচ্চ প্রয়াস চালাতে হবে।

তৃতীয়ত, সুপরিকল্পিতভাবে জনগোষ্ঠীকে কারিগরি দক্ষতায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে পারলে জনসংখ্যা সম্পদে পরিণত হবে।

এ ছাড়া নারীর কর্মসংস্থান ও ক্ষমতায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপের পাশাপাশি সব ধরনের অসাম্য দূর করতে হবে। জনসংখ্যার বোনাসকালকে কাজে লাগাতে চাইলে সবার জন্য স্বাস্থ্য ও শিক্ষার সুযোগ নিশ্চিত, বয়স্কদের জন্য নিরাপত্তাবেষ্টনী সম্প্রসারণ, মানবসম্পদ উন্নয়নের জন্য উপযোগী ও যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে। উল্লিখিত পদক্ষেপগুলো বাস্তবায়নে এগিয়ে গেলে কর্মক্ষম জনসংখ্যার আধিক্যের এ বোনাস জাতীয় জীবনের অর্থনৈতিক ও সামাজিক চেহারার আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিতে পারবে।

তাই একথা সত্য যে, যদি জনসংখ্যার গুণগতমান উন্নয়ন করা যায় এবং এ জনসংখ্যাকে সদ্ব্যবহার করার পরিবেশ সৃষ্টি করা যায় তবে তা দায় না হয়ে সম্পদে রূপান্তরিত হবে এবং উন্নয়নের সহায়ক হবে।

লেখক: সহকারী অধ্যাপক, হোসেনপুর আদর্শ মহিলা ডিগ্রি কলেজ

নয়া শতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ