ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কষ্টের বর্ষণ বাংলাদেশে...

প্রকাশনার সময়: ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১১:০৮

কষ্টের কথাগুলো বলতে চাই না আর। তবুও বারবার ঘুরে ফিরেই সামনে আসে ওসব। হূদয়ে এত বেশি রক্তক্ষরণ হয় যে লেখনির মাধ্যমে তা না ঝরালে প্রলয়ের সম্ভাবনা থাকে। অতি নিকটে রাজধানী ঢাকা লাগোয়া ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের যাত্রামুড়া এলাকায় এক শতবর্ষী বৃদ্ধ মাকে রাতের আঁধারে রাস্তায় ফেলে গেছে তার সন্তান। ওই মা শুধু তার ছেলে তাকে সেখানে ফেলে গেছে এতটুকুই বলতে পারেন। এতটা বয়স বেড়েছে যে স্মৃতিতে আর নিজের ঠিকানাটা পর্যন্ত নেই।

পাঠক একবার ভাবুন বিষয়টা কতটা বেদনার। এমন হাজারও মায়ের বেদনার গল্প আছে এদেশে। ওদের কষ্টে আর হাকচিৎকারে দিনদিন বাংলার বাতাস ভারি হয়ে উঠেছে। বাতাসও এই কষ্ট বহনের শক্তি হারাচ্ছে। কষ্ট বহন করতে না পারলে ‘কষ্টের বর্ষণ’ হলে দেশটা তো ছাড়খাড় হয়ে যাবে। অভিশপ্ত দেশে নানা বিপর্যয় হচ্ছেও। এমন বেদনা নিয়ে বেঁচে থাকা হাজারও মায়ের গল্প জানি আমি। এর মধ্যে যারা মারা যান এমন সংবাদ পেলে ‘ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন’ বলার সঙ্গে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ও বলি। মনে মনে বলি বেঁচে গেলেন বেচারি কিংবা বেচারা। ভাবি দুনিয়াতে দোজখ ভোগ করে বেহেশতের যাত্রী হয়েছেন তারা। ওনাদের মৃত্যুতে আলহামদুলিল্লাহ বলি একারণে ভাগ্যাহত এসব মানুষের কষ্ট আসলেও সইবার নয়। যে মা-বাবা আমাদের এত কষ্ট করে মানুষ করল, সেই তাদের এত কষ্ট; তা কি সহ্য করার মতো?

এসব নানা কারণে মনে প্রশ্ন জাগে, বাংলাদেশের বৃদ্ধ বাবা-মায়েরা ভালো আছেন তো? সন্তানের কষ্টে কারও চোখের জল ঝরছে না তো? বিনা চিকিৎসায় আর অনাহারে নেই তো কেউ? আপনারা কেউ বৃদ্ধাশ্রমে আছেন কি? এমন প্রশ্ন জাগার কারণ আছে অনেক। পত্রিকার শিরোনাম যদি এমন হয়- ‘ডাস্টবিন থেকে উদ্ধার করা অসুস্থ বৃদ্ধ পিতাকে বৃদ্ধাশ্রমে প্রেরণ’; অন্যটির শিরোনাম- ‘বাসস্ট্যান্ডে ফেলে রাখা বৃদ্ধ মায়ের ছেলের জন্য অপেক্ষায় কাটল একমাস’। তাহলে তো প্রশ্ন জাগবেই। সংবাদগুলো আমাদের বিবেক, মূল্যবোধ, পারিবারিক বন্ধন এবং আত্মার সম্পর্ক বিষয়ক এত দিনকার ধ্যান ধারণার ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। এমন সংবাদ সমাজের এক নগ্ন বাস্তবতাকে উন্মোচন করে।

হালযুগে বাবা-মায়ের প্রতি সন্তানদের দায়িত্ববোধ কমতে শুরু করেছে।

সবাই কেমন যেন ব্যস্ত হয়ে উঠছি আমরা। স্বার্থপর তো বটেই! তাই অনেক বাবা-মায়ের আশ্রয় হয় এখন বৃদ্ধাশ্রমে। আজকাল বৃদ্ধাশ্রমের সঙ্গে বেশ পরিচিত আমরা। এক দশক আগেও অধিকাংশ মানুষের মধ্যে বৃদ্ধাশ্রমের তেমন ধারণা ছিল না। এখন দেশের অনেক জায়গায়ই বৃদ্ধাশ্রম গড়ে উঠেছে। আর নরক নামীয় এ বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় হচ্ছে অনেক বৃদ্ধ পিতা-মাতার। সেখানে যেতে তাদের বাধ্য করা হয়।

অনেকে আবার জন্মদাতা পিতা-মাতার জন্য অতটুকুও ভদ্রতা দেখান না। ওরা জন্মদাত্রীকে ফেলে আসেন রাস্তাঘাটে, নর্দমায়। ওই পশুরা আমাদের অতি শ্রদ্ধেয় মুরব্বিদের কখনবা ডাস্টবিনে ফেলে আসতেও দ্বিধা করেন না। এমন ঘটনা কতটা অমানবিক, কতটা বিবেকবর্জিত এবং আপত্তিকর, সেটা সহজেই বোঝা যায়।

এই অমানবিক বিষয়গুলোকে আমাদের সামনে আনা উচিত। সমাজ, রাষ্ট্র এবং পরিবারের অপরাপর লেখকদের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে প্রতিরোধ গড়ে তোলা উচিত। এ নিয়ে আন্দোলন হতে পারে। পরিবারের লোকজন এ আন্দোলনে শামিল হবেন, প্রতিবেশীরা যোগ দেবেন। রাষ্ট্রেরও এ ব্যাপারে দায় আছে। রাষ্ট্র এমন অমানবিক বিষয়কে আইনের আওতায় আনতে পারে। নিয়োজিত ম্যাজিস্ট্রেটদের মাধ্যমে ভ্রাম্যমাণ আদালত গঠন করে কুসন্তান কিংবা কু-পুত্রবধূদের তাৎক্ষণিক ৬ মাস কিংবা ততোধিক সময়ের জন্য সাজা দিতে পারে না। বিষয়গুলো জনসমক্ষে নিয়ে আসা রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে আমাদেরও কর্তব্য আছে।

পরিবারের অন্য সদস্য, প্রতিবেশীরা এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বিরুদ্ধে তার কর্মস্থলে গিয়ে প্রতিবাদ জানাতে পারেন। লিখিত অভিযোগ দিতে পারেন। মোদ্দা কথা হলো, সবাইকে সবার জায়গা থেকে ওদের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে, প্রতিবাদ করতে হবে, প্রতিরোধ গড়তে হবে। সবচেয়ে ভালো হয় নিজেরা নিজেদের থেকে ভালো হয়ে গেলে। ভাবনায় আনতে হবে, আমরা আমাদের পিতা-মাতার কারণেই পৃথিবীতে আসতে পেরেছি। তারাই আমাদের আলোর মুখ দেখিয়েছেন। তারাই আমাদের আগুন, পানি, রোদ-বৃষ্টি থেকে রক্ষা করেছেন। শিক্ষা দিয়েছেন, দিনদিন বড় করে তুলেছেন। মানুষের মতো মানুষ করে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন; যদিও আমরা অনেকে মানুষ না হয়ে অমানুষই হয়েছি।

আমরা অমানুষ হয়ে যাচ্ছি বলেই আমাদের মা-বাবারা আমাদের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। ‘আপনের চেয়ে পর ভালো, পরের চেয়ে বৃদ্ধাশ্রম।’ কঠিন এক সত্য। আর এ সত্যকে মেনেই অনেক বৃদ্ধ মা-বাবা আশ্রয় নেন বৃদ্ধাশ্রমে। সন্তানের কাছে যাদের বেশি কিছু চাওয়ার নেই; শেষ বয়সে আদরের সন্তানের পাশে থেকে সুখ-দুঃখ ভাগ করার ইচ্ছা এতটুকুই যা চাওয়ার। আর এ নিয়েই প্রতিটি পিতা-মাতা প্রহর গুনতে থাকেন দিবা-রজনী। কিন্তু অনেকেরই সেই সন্তানের কাছে আশ্রয় না হয়ে; আশ্রয় হয় আপনজনহীন বৃদ্ধাশ্রমে। শেষ বয়সে ঘরের কোণেও জনমদুখী মা-বাবার এতটুকুও জায়গা মিলে না। ওদের ছুঁড়ে দেয়া হয় প্রবীণ নিবাসনামীয় নরকে। তবুও প্রতিবাদ দানা বাঁধে না; মন অভিশাপ দেয় না। নাড়ি ছেঁড়া ধন ওরা। তাই চুপ থাকেন, একেবারে চুপ। তবে এ নিষ্ঠুরতা তাদের কেবলই কাঁদায়। এ কেমন নিয়তি? ভাবি আমরা কতটাই না আধুনিক স্বার্থপর!

এ লেখায় আরও কিছু পুরোনো ঘটনা সামনে না আনলে পাঠকের পুরোপুরি চেখের জল ঝরবে না হয়তো। ‘বৃদ্ধাশ্রম থেকে সন্তানের কাছে মায়ের চিঠি’ ফেসবুকে এ শিরোনাম দেখে এ লেখার মন্তব্যে আমি এভাবে লিখেছিলাম- ‘এই ছেলে তোকে কি বলে ডাকি বলতো? কুকুর, বিড়াল, শূকর? না এ নামে তোকে ডাকলে পশু জাতির যে আর মান ইজ্জত রইবে না। ডাকাডাকি বাদ দিই। বরং তোর মায়ের মতোই তোর জন্য দোয়া করি- ‘তুই বেঁচে থাক বছরের পর বছর অনন্তকাল’। খোদার কাছে প্রার্থনা এই যে, তিনি যেন তোর অমানুষী মনে উপলব্ধি সৃষ্টি না করে তোর কাছে আজরাইল না পাঠান। চিঠি পড়ে তোর মায়ের কষ্ট আমি পুরোটা উপলব্ধি করতে পারছি না। এত বেশি কষ্ট উপলব্ধি করি কি করে? তোর জন্য ফরিয়াদ করি, খোদা যেন তোকে তোর মায়ের মতো সমকষ্ট দিয়ে পৃথিবী ত্যাগ করান। এর বেশি কষ্ট তোর জন্য বোধ করি প্রয়োজন পড়বে না। তোর মা কষ্ট যেমনটা পেয়েছেন ঠিক তেমন কষ্টই তোকে দিক খোদা। ভালো থাকিস.. ”। ফেসবুকে আমার এ মন্তব্যের পর এর সমর্থনে শতাধিক মন্তব্য পেয়েছি যা পড়লে অনেকেরই চোখে জল আসবে।

বৃদ্ধাশ্রম অবহেলিত বৃদ্ধদের জন্য শেষ আশ্রয়। তাদের সারা জীবনের অবদানের যথার্থ স্বীকৃতি, শেষ সময়ের সম্মান ও নিরাপত্তা দেয়া হয় এসব বৃদ্ধাশ্রমে। এখানে তারা নির্ভাবনায়, সম্মানের সঙ্গে, আনন্দের সঙ্গে বাকি দিনগুলো কাটাতে পারেন। প্রয়োজনে অনেক বৃদ্ধাশ্রমে চিকিৎসারও সুন্দর ব্যবস্থা করা আছে। কিন্তু সকল প্রাপ্তির মাঝেও এখানে যা পাওয়া যায় না তা হলো নিজের পরিবারের সান্নিধ্য। বৃদ্ধ বয়সে মানুষ তার সন্তান, নাতি-নাতনিদের সঙ্গে একত্রে থাকতে চান। তাদের সঙ্গে জীবনের আনন্দ ভাগাভাগি করে নিতে চান। সারা জীবনের কর্মব্যস্ত সময়ের পর অবসরে তাদের একমাত্র অবলম্বন এই আনন্দটুকুই। বলা যায় এর জন্যই মানুষ সমগ্র জীবন অপেক্ষা করে থাকে। বৃদ্ধাশ্রমে আশ্রয় পাওয়া যায়, সঙ্গীসাথী পাওয়া যায়, বিনোদন পাওয়া যায়, কিন্তু শেষ জীবনের এই পরম আরাধ্য আনন্দটুকু পাওয়া যায় না যার জন্য তারা এই সময়টাতে প্রবল মানসিক যন্ত্রণা আর ভারাক্রান্ত হূদয়ে আবেগাপ্লুত হয়ে ওঠেন। নেহায়েত অন্যপায় হয়ে, ইচ্ছার বাইরে যারা বাবা-মাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠান, তাদের কথা ভিন্ন।

কিন্তু যারা নিজের পর্যাপ্ত সম্পদ ও সময় সুযোগ থাকার পরও শুধু অবহেলা করে পিতা-মাতাকে বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দিয়ে ভুলে যান, তাদের স্মরণ রাখা দরকার, এমন সময় তাদের জীবনেও আসতে পারে। যে বাবা-মা একসময় নিজে না খেয়েও সন্তানকে মুখে তুলে খাইয়ে দিতেন, তারা আজ কোথায় কেমন আছেন সেই খবর নেয়ার সময় যার নেই তার নিজের সন্তানও হয়তো একদিন তার সঙ্গে এমনই আচরণ করবে। বিভিন্ন উৎসবে, যেমন ঈদের দিনেও যখন তারা তাদের সন্তানদের কাছে পান না, সন্তানের কাছ থেকে একটি ফোনও পান না, তখন অনেকেই নিরবে অশ্রুস্নাত করেন আর দীর্ঘশ্বাস ছাড়েন। এমনকি সেই সন্তানকে অভিশাপ দিয়ে কামনা করেন, তার সন্তান তার সঙ্গে যে আচরণ করল, ভবিষ্যতে তার ছেলের সন্তানও যেন একই আচরণ করে।

একদিন যে সন্তানের জন্য বাবা-মা ছিলেন স্নেহময়, যে সন্তান একটু আঘাত পেলেই বাবা হয়ে উঠতেন চিন্তিত। যে সন্তানকে নিজে হাত দিয়ে খাইয়ে দিয়েছেন, কোলে-পিঠে করে মানুষ করেছেন এবং কখনই নিজের অসুবিধার কথা সন্তানদের বুঝতে দেননি। আজকাল সমাজে এমন কিছু সন্তান দেখা যায়, যারা কি না মা-বাবার এতসব আদর-যত্নের কথা ভুলে মা-বাবাকে ঠেলে দেয় অজানা গন্তব্যে। বৃদ্ধ ও অসহায় বলে তাদের ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রমে। ঘরের মধ্যে সবার থাকার জায়গা হলেও এখানে বৃদ্ধ মা-বাবার জায়গা হয় না। আসলে মা-বাবা তার সন্তানদের জন্য যা করেন, তা তাদের পক্ষে সারা জীবনেও শোধ করা সম্ভব নয়।

বুড়ো বয়সে এসে তারা চান একটু শান্তি, ভালোবাসা ও স্নেহ। এ বয়সে একটু আদর-যত্ন পেলেই তারা খুশি হন। মা-বাবা চান সন্তানরা যেন তার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শোনে। আমাদের মনে রাখা উচিত, আজ যিনি সন্তান, তিনিই আগামী দিনের পিতা কিংবা মা। বৃদ্ধ বয়সে এসে মা-বাবারা যেহেতু শিশুদের মতো কোমলমতি হয়ে যায়, তাই তাদের জন্য সুন্দর জীবনযাত্রার পরিবেশ তৈরি করাই সন্তানের কর্তব্য। আর যেন কখনও কোনো পিতা-মাতার ঠিকানা বৃদ্ধাশ্রম না হয়, সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখতে হবে। তাদের জন্য তৈরি করতে হবে একটা নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী।

লেখক: মহাসচিব, কলামিস্ট ফোরাম অব বাংলাদেশ

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ