ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ বিধ্বংসী বিদেশি গাছ বর্জন করতে হবে

প্রকাশনার সময়: ০৩ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ১২:৪৫

বাংলাদেশের পরিবেশ বিপর্যয়ের অন্যতম প্রধান কারণ বিদেশি প্রজাতির গাছের আগ্রাসন। তাই অবিশ্বাস্য হলেও এমন ঘটনা ঘটছে দেশে। নানাভাবে আমাদের সবুজ-শ্যামল প্রকৃতিতে ঢুকে পড়েছে বিদেশি প্রজাতির অনেকগুলো বৃক্ষ। বিদেশি এসব গাছ ও গুল্মের ক্রমাগত বর্ধনের ফলে গত এক দশকে বাংলাদেশের প্রকৃতি থেকে ধীরে ধীরে হারিয়ে গেছে অন্তত এক হাজার প্রজাতির নিজস্ব গাছ। বিশেষজ্ঞদের মতে, বিদেশি প্রজাতির নানা বৃক্ষ বাংলাদেশের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের অপরিসীম ক্ষতি করছে। তাই পরিবেশ বাঁচাতে বিদেশি ক্ষতিকর বৃক্ষ বর্জন করতে হবে।

সবুজ গাছপালায় আচ্ছাদিত আমাদের গ্রাম বাংলা। এখানে প্রাকৃতিকভাবেই জন্ম নেয় অসংখ্য প্রজাতির বৃক্ষ, গুল্ম, লতাপাতা। তবে সময়ের পরিক্রমায় আমাদের বৃক্ষ সম্পদ ধ্বংসের পথে। নানা কারণে দেশের বৃক্ষ সম্পদ হ্রাস পাচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় আয়তনের ২৫ শতাংশ জমিতে গাছপালা বা বন জঙ্গল থাকার কথা থাকলেও এর অর্ধেক জমিতেও নেই বৃক্ষসম্পদ। আবাসন নির্মাণের পাশাপাশি জ্বালানির কাজে ব্যবহারের জন্য অবাধে কর্তন করা হচ্ছে বৃক্ষ সম্পদ। আর এই সুযোগেই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে দ্রুত বর্ধনশীল বিভিন্ন প্রজাতির বৃক্ষ।

এগুলো জ্বালানি সংকট নিরসনে ভূমিকা রাখে ঠিকই, তবে ক্রমাগত মাটি ও পরিবেশের সর্বনাশ করে চলেছে। বিদেশি বৃক্ষগুলো বাংলাদেশের মানুষই যেমন এনেছে, আবার কিছু উদ্ভিদ নিজেই বাংলাদেশে ইকোসিস্টেমে বা বাস্তুসংস্থানের মধ্যে ঢুকে পড়েছে। বিদেশি প্রজাতির রেইন ট্রি, সেগুন, আকাশমণি, আকাশি, শিশু, বাবলা, ইউক্যালিপ্টাস জাতীয় গাছের জন্য প্রচুর জায়গার দরকার হয়। এগুলো দেশি গাছের তুলনায় অনেক দ্রুততার সঙ্গে বেশি পরিমাণে পুষ্টি ও পানি শোষণ করে। তাই এসব বৃক্ষের আশপাশে দেশীয় প্রজাতির বৃক্ষ বাঁচতে পারে না। ব্রিটিশ আমলে বৈধভাবেই দেশে আসে রেইন ট্রি, মেহগনি, চাম্বুল ইত্যাদি। আশির দশকে আসে আকাশমণি, ইউক্যালিপ্টাস, শিশু, ইপিলইপিল, বাবলা ও খয়ের জাতীয় গাছ। আর বিভিন্ন সময় অনুমতি ছাড়াই প্রবেশ করেছে রিফুজিলতা, স্বর্ণলতা, মটমটিয়া, পিসাইস, পার্থোনিয়াম, কচুরিপানা ইত্যাদি।

গবেষকদের মতে, অতীতে বাংলাদেশে প্রায় পাঁচ হাজার প্রজাতির বৃক্ষ ছিল। কিন্তু বর্তমানে এক হাজারের বেশি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিলুপ্ত হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে, বিদেশি এসব আগ্রাসী বৃক্ষ। আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত দেশীয় বট, কদম, হিজল, জারুল, তমাল আর বাংলা মানেই বট, পাকুড়, ডুমুর, আম, জাম, শিমুল, পলাশ, হিজল, ছাতিম, কদম, শাল, তাল, তেঁতুলসহ অজস্র দেশি বৃক্ষে আচ্ছাদিত। বাংলা মানেই জুঁই, চামেলি, মালতি, গন্ধরাজ, ভাঁট ফুলসহ অজস্র লতাগুল্মের বাহার। বাংলার এসব গাছগাছালিকে কেন্দ্র করেই বাস করে বহু প্রজাতির পশুপাখি, কীটপতঙ্গ। মানুষ বেড়েছে ভারসাম্যহীনভাবে। চাহিদা বেড়েছে খাদ্য, বস্ত্র ও আবাসের। সেই সঙ্গে বেড়েছে ভোগ-বিলাস, বিত্ত-বৈভব, লালসা ও নগদ প্রাপ্তির অসীম চাহিদা। তাই চলছে প্রকৃতি লুণ্ঠনের অজস্র আয়োজন।

কলকারখানার জন্য উন্নয়নের নামে গাছগাছালি সাবাড় করে উজাড় হচ্ছে বন। তা আবার উদ্ধারের নামে রাষ্ট্রের লাখো কোটি টাকায় শত শত প্রকল্পে চলছে সবুজায়নের এক অদ্ভুত আয়োজন। রাষ্ট্র, সমাজ, ব্যক্তি সর্বস্তরে চলছে বাংলার বৃক্ষ-প্রকৃতি বিনাশের কাজ। আর ইউক্যালিপ্টাস বাংলাদেশে ১৯৬০ সালে আনার পর থেকে সরকারি উদ্যোগেও সামাজিক বনায়নের আওতায় লাগানো হয়েছে সর্বত্র। সারা দেশে রাস্তার পাশে, পুকুরপাড়ে, খেতের আইলে এখন চোখে পড়ে এসব পরিবেশ হানিকর গাছ। ইউক্যালিপ্টাস, আকাশমণি গাছ শুধু কাঠের বিবেচনায় রোপণ করা হয়। কিন্তু একটি গাছ মানে তো শুধু কয়েক ঘনফুট কাঠ নয়। গাছের সঙ্গে প্রধান বিবেচ্য বিষয় বাস্তুতন্ত্র তথা পরিবেশ-প্রকৃতি। বিবেচনায় নিতে হবে সেসব গাছ বাস্তুতন্ত্রের সঙ্গে কতটা সংগতিপূর্ণ। একটি গাছের সঙ্গে থাকে অনেক প্রজাতির পশুপাখি, অজস্র অনুজীবের জীবনচক্র ও জীবনপ্রবাহ। মানুষ বুদ্ধি, কৌশল ও বাহুবলে গাছের সর্বাঙ্গ লুণ্ঠন করছে যেন প্রকৃতিতে একমাত্র মানুষ প্রজাতিই একক স্বত্বভোগী! কিন্তু প্রকৃতিতে অন্যান্য প্রাণীরও অধিকার রয়েছে। মানুষ এখন ভোগ-বিলাসে ও বিত্ত-বৈভব অর্জনে আত্মকেন্দ্রিকতায় অন্ধ।

এদিকে বিদেশি ইউক্যালিপ্টাস, আকাশমণি গাছের গড়ন ও আচরণও অত্যন্ত আত্মকেন্দ্রিক। এসব গাছ রাত-দিন প্রচুর পানি শোষণ করে। ইউক্যালিপ্টাস গাছের পানি শোষণসংক্রান্ত নির্ভরযোগ্য কোনো গবেষণার তথ্য জানা না থাকলেও আমি প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে দেখেছি যে আমাদের দুটি পাশাপাশি ছোট্ট পুকুরের একটির পাড়ে কিছু ইউক্যালিপ্টাস গাছের প্রচুর পানি শোষণ। খরা মৌসুমে এ পুকুরের পানি তলানিতে ঠেকত। অন্য পুকুরপাড়ে সাধারণ দেশি গাছ ছিল, যার পানি তুলনামূলক অনেক বেশি থাকত। আবার আমাদের একটি জমির যে পাশে কিছু ইউক্যালিপ্টাস ছিল, সে পাশের মাটি বর্ষাকালেও দু-চারদিন বৃষ্টি না হলে জল শুকিয়ে ঝরঝরে হতো। আর যে পাশে আম-কদম গাছ ছিল, সে পাশের মাটি থাকত অনেক আর্দ্র।

সেসব ইউক্যালিপ্টাস গাছ কাটার পর এ সমস্যা আর দেখা দেয় না। এ রকম তিক্ত অভিজ্ঞতা প্রত্যেক ভুক্তভোগী কৃষকেরই আছে। ইউক্যালিপ্টাস, আকাশমণি গাছের শাখার গড়ন হলো খাড়া ও ছড়ানো। ফলে এসব গাছের ডালে কোনো পশুপাখিই বাসা বাঁধতে পারে না। এমনকি বসে বিশ্রামও নিতে পারে না। এদের ফুল-ফল খেতে পারে না কোনো প্রাণী। পাতা গরু-ছাগলেরও খাবার উপযোগী নয়। এমনকি এদের ওপর কোনো মাইক্রো ফ্লোরা-ফোনা (ক্ষুদ্র উদ্ভিদ ও প্রাণী) জন্মাতে পারে না। যাকে এককথায় বলা যায় একেবারেই আগ্রাসী আত্মকেন্দ্রিক!

বাংলায় উৎপত্তি বেশির ভাগ বৃক্ষের ফুল ও ফল সাধারণত সরস ও শোভাপূর্ণ। এসব বৃক্ষ ঘিরে অসংখ্য পশুপাখির আবাস গড়ে ওঠে। গাছের গড়নবিশেষে পশুপাখি তাদের আবাস বা আশ্রয় নির্বাচন করে। হরেক প্রজাতির শালিক, শ্যামা, টিয়া, ঘুঘু, বুলবুলি, বক, বাজপাখি, চিল বাদুড়সহ অসংখ্য পাখি সাধারণত আম, জাম, কাঁঠাল, বট, অশ্বত্থ, খেজুর গাছে বাসা বাঁধে। বাবুই পাখি তাল, নারকেল, খেজুর গাছের পাতায় অসাধারণ নৈপুণ্যে বাসা বাঁধে, তা সবারই জানা। বক সাধারণত উঁচু তেঁতুল গাছে বাসা বাঁধতে নিরাপদ ও স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। আমি গ্রামে দেখেছি জঙ্গলের মাঝে বাঁশঝাড় ও উঁচু তেঁতুল গাছে শত শত বককে বাসা বাঁধতে। আবার কলা-বাদুড়ের আশ্রয়ও উঁচু তেঁতুল গাছ। আমার দেখা বেশির ভাগ বাদুড়ের বাস তেঁতুল গাছের শক্ত-চিকন ভূমি সমান্তরাল ডালে। তবে তারা সে গাছকে কেন্দ্র করে আশপাশের অন্যান্য গাছ বা বাঁশঝাড়েও ঝুলে থাকে। আশপাশে বট, পাকুড়, ডুমুর গাছে এদের আনাগোনা বেশি। টিয়া পাখি নরম কাঠবিশিষ্ট বড় শিমুল গাছের মগডালে গর্ত করে বাস করে।

বটবৃক্ষ শুধু সাহিত্যে নয়, লোকজ জীবন ও সংস্কৃতির সঙ্গে মিলেমিশে আছে। রোদ-বৃষ্টি ঝড়-ঝাপটায় আশ্রয়-প্রশ্রয়ে বট গাছের উপযোগিতা অপরিসীম। হাটবাজার-মেলা তো বটতলা ছাড়া কল্পনাই করা যেত না। মানুষ তখন কোনো ঠিকানা নিশ্চিত করতে বট গাছকেই ব্যবহার করত। গ্রীষ্মে প্রখর রৌদ্রে শ্রান্ত শরীরে বিশ্রাম নিতে বটবৃক্ষের তলে বসত মানুষের মিলনমেলা। বাড়ির পাশে পুকুরপাড়ে বা খেয়াঘাটে বটগাছের নিচে মানুষের জন্য তৈরি করা হতো বাঁশের মাচা। দুপুর গড়িয়ে চলত গলা ছেড়ে গান, লাগামহীন গল্প। ঝুরিমূলে দোল খাওয়া নিয়ে শৈশব-কৈশোরে বটবৃক্ষের সঙ্গে সখ্য ছিল না, গ্রাম-বাংলায় বেড়ে ওঠা এমন কাউকে পাওয়া যাবে না। খেলাধুলা, বেড়ে ওঠা, গড়ে ওঠার বিকাশ কেন্দ্র ছিল সেসব বৃক্ষতলা। বাংলার পথ-প্রান্তরের নাম বটতলা নির্ধারণ করা হয়। এ নামকরণে বাংলার অন্যান্য বৃক্ষেরও প্রভাব দেখা যায়। যেমন পাকুড়তলী, শিমুলতলী, নিমতলী, কদমতলী, তেঁতুলতলী, আমতলী, জামতলী। সারা দেশে এ রকম রাস্তাঘাট ও মাঠের নাম পাওয়া যায়। তবে বাংলার ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে সংগতির জন্য বটতলা নামটি বেশির ভাগ স্থানে দেখা যায়।

বহু বছর ধরে বাংলায় জন্মানো বৃক্ষ অভিযোজনে উপযোগী করেছে নিজস্ব পরিবেশ-প্রকৃতিকে। জনঘন এ দেশে পরিবেশ দূষণ ও প্রকৃতি বিপর্যয় রোধে বাংলার বৃক্ষগুলোর গুরুত্ব অপরিহার্য।

পরিশেষে বলতে চাই, প্রভৃতি বৃক্ষের সমারোহ বাড়াতে বর্জন করতে হবে বিদেশি বৃক্ষগুলোকে। পানিতে শাপলা-পদ্মের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগের জন্য বর্জন করতে হবে কচুরিপানাকে। সব মিলিয়ে বিদেশি বৃক্ষের ক্ষতিকর দিকগুলো তুলে ধরে সরকারিভাবে ব্যাপক প্রচারণা দরকার। আর প্রতি মৌসুমে সকল বড় বড় রাস্তার ধারে, নদী বা খালের বাঁধে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার, পতিত স্থান ও বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় গাছের চারা রোপণের উদ্যোগ নিলে দেশের সকল এলাকার পরিবেশের ভারসাম্য যেমন সুরক্ষিত হবে, তেমনি এলাকায় প্রাণবৈচিত্র্যও বৃদ্ধি পাবে এবং পাশাপাশি বৈচিত্র্যময় খাদ্যের সহজলভ্যতা সৃষ্টি হবে। তাই, আসুন আমরা সবাই সংগঠিতভাবে ও ব্যক্তি উদ্যোগে সামর্থ্য অনুযায়ী বৈচিত্র্যময় (ফলজ, বনজ ও ওষুধি) গাছের চারা রোপণ করে পরিবেশ রক্ষায় অবদান রাখি। বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুস্থভাবে বেঁচে থাকার সুন্দর ও নিরাপদ পরিবেশ গড়ে দেই।

লেখক: কলাম লেখক ও গবেষক

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ