ঢাকা, রোববার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১, ১৮ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কূটনীতিকদের তৎপরতা ও আমাদের আত্মমর্যাদা

প্রকাশনার সময়: ২৮ জুলাই ২০২৩, ০৮:১২
ছবি: সংগৃহীত

উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন আমেরিকান কূটনীতিকদের আসার আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের একটি ছয় সদস্যের প্রতিনিধি দল ৯ জুলাইয়ের প্রথম দিকে বাংলাদেশে দুই সপ্তাহের সফর শুরু করে। প্রতিনিধি দলটি বিরোধী দল বিএনপিসহ বিভিন্ন দলের নেতা, মন্ত্রণালয় ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সংগঠনের প্রধানদের সঙ্গে বৈঠক করেন। ইইউ প্রতিনিধি দল ঢাকায় আসার পরপরই অন্তত ১২ জন বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও প্রতিনিধির সঙ্গে দেখা করে। তারা বাংলাদেশে নিযুক্ত ইউরোপীয় ইউনিয়নের রাষ্ট্রদূত চার্লস হোয়াইটলির সঙ্গেও সাক্ষাৎ করেন। এই সফর চূড়ান্তভাবে নির্ধারণ করবে যে ব্রাসেলস বাংলাদেশে আসন্ন নির্বাচনের জন্য পর্যবেক্ষকদের একটি দল পাঠাবে কিনা। দলটির নেতৃত্ব দিচ্ছেন ইউরোপিয়ান এক্সটারনাল অ্যাকশন সার্ভিসের (ইইএএস) পলিসি অফিসার রিকার্ডো চেলেরি। তিনি এর আগে ২০১৯ সালে শ্রীলঙ্কায় অনুরূপ একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন।

মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে বাংলাদেশের ব্যাপক অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন হয়েছে এবং স্বাধীনতার পর ৫০ বছরে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে ঈর্ষণীয় সাফল্য এসেছে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক সূচকগুলোতে প্রতিযোগীদের পেছনে ফেলে সামনের সারিতে বাংলাদেশ। এই সাফল্যের নেপথ্যে রয়েছে কৃষি, গার্মেন্টস এবং রেমিট্যান্স। মোট বৈদেশিক আয়ের প্রায় ৯০ শতাংশ আসে গার্মেন্টস ও রেমিট্যান্স থেকে। আর মোট শ্রমশক্তির ৪০ শতাংশের বেশি কৃষিতে। শুধু অর্থনীতি নয়, দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নেও ভূমিকা রাখছে খাতগুলো। বাংলাদেশের অর্থনীতির আরেক চালিকাশক্তি পোশাক শিল্প। বর্তমানে বিশ্বে তৈরি পোশাক রপ্তানিতে চীনের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান। সারা পৃথিবীতে ‘মেইড ইন বাংলাদেশ’ খ্যাতি দিয়েছে এই পণ্য। এ খাত থেকে রপ্তানি আয় দেশে মোট রপ্তানি আয়ের প্রায় ৮৫ শতাংশ। আইএমএফের হিসাবমতে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ভারতকে ছাড়িয়ে গেছে। ২০১৫ সালেই আমাদের মাথাপিছু আয় পাকিস্তানকে ছাড়িয়ে গিয়েছিল। ২০১৯ সালে দারিদ্র্যের হার কমে ২০ দশমিক ৫ শতাংশে দাঁড়ায়। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে দেশের বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। মাঝারি ও বৃহৎ শিল্পে বিনিয়োগের ফলে তৈরি পোশাক, খাদ্য-পানীয়-তামাক, ইস্পাত, সিমেন্ট, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, ভোজ্যতেল, রাবার ও প্লাস্টিক পণ্য, ইলেকট্রনিকস, হালকা ইঞ্জিনিয়ারিং দ্রব্যাদি, বাইসাইকেল, মোটরসাইকেল প্রভৃতির উৎপাদন বেড়েছে, যার ফলে অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানো ও রপ্তানি উভয়ই সম্ভব হচ্ছে। ২০২১ সালের মার্চ পর্যন্ত বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিমাণ ২০ বিলিয়ন ডলার। দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণের জন্য ২০৩০ সালের মধ্যে সারা দেশে ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করা হবে। গোল্ডম্যান স্যাক্স এর সাম্প্রতিক সমীক্ষায় ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চায়না এবং দক্ষিণ আফ্রিকা ছাড়াও বিশ্বে সম্ভাবনাময় ১১টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ ম্যাকেনজি/ইউএসইউড রিপোর্টে বলা হচ্ছে কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কারণে অন্যের ওপর নির্ভরশীলতা কমার বর্তমান হার হ্রাস পাওয়ায় আগামী ১০ বছরে বাংলাদেশে প্রায় দেড় কোটি লোকের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা রয়েছে। নিঃসন্দেহে আজকের বাংলাদেশ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর মতোই গতিময় এক প্রবৃদ্ধির পথরেখায় রয়েছে। সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া এবং থাইল্যান্ড ১৯৮০-৯০ দশকে মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৪০০ ডলার ছাড়িয়ে যাওয়ার পর যে পথে এগিয়ে ওই মাথাপিছু আয়কে ৪ হাজার ডলারের ওপর নিয়ে গেছে, এই দশকে বাংলাদেশও সে পথে এগোনোর সম্ভাবনা তৈরি করেছে (বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ২ হাজার ৮০০ ডলার ছাড়িয়েছে)। এ পথে এগিয়ে যেতে পারলে ২০২৬ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মাথাপিছু আয় ৪ হাজার ডলার ছাড়িয়ে যেতে পারে। বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের একটি সরকারি নথিতে বলা হয়েছে, ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার হবে ১ ট্রিলিয়ন ডলার (ইউএস)। যদি বর্তমানে ধারাবাহিক প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি অব্যাহত থাকে এবং প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের বেশি হলে ২০৩০ সাল নাগাদ তা অর্জিত হবে। প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশের নিচে নেমে গেলেও ২০৪০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনীতি ট্রিলিয়ন ডলারের মাইলফলক স্পর্শ করবে।

ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন চাইছে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে প্রভাবিত করতে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া’ ক্ষুণ্ন করে এমন বাংলাদেশি কর্মকর্তাদের ভিসা নিষেধাজ্ঞা দেয়া হবে বলে জানিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এর আগে, মার্কিন ট্রেজারি বিভাগ বাংলাদেশের আধাসামরিক বাহিনী, র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‍্যাব) এবং এর ছয়জন সিনিয়র কর্মকর্তার ওপর মানবাধিকার নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। কিন্তু গত বুধবার ভোররাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিসৌরি রাজ্যে রমিম উদ্দিন আহমেদ নামে এক বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে অপরাধীরা। ৪ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের বোস্টনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন বাংলাদেশি ছাত্র সৈয়দ ফয়সাল আরিফ। যে দেশে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ মানবাধিকার নিয়ে উদ্বিগ্ন, শাস্তিস্বরূপ নানা বিধিনিষেধ আরোপ করে, সে দেশে পুলিশের হাতে নিরীহ মানুষ নিহত হচ্ছে। কিন্তু তার কোনো বিচার নেই। যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি বছর গড়ে এক হাজার মানুষ পুলিশের হাতে প্রাণ হারায়। নিজেদের দেশেরই যখন এমন অবস্থা, তখন তারা কীভাবে বলবে যে বাংলাদেশে মানবাধিকার নেই। ইরাক ও ভিয়েতনামে আমেরিকার মানবাধিকার নিয়ে কি বিশ্ব কোনো ব্যবস্থা নিয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে হত্যা নির্যাতন হযেছিল, তখন আমেরিকা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। ১৯৭১ সালের মানবাধিকার বিষয়ে আমেরিকার ভূমিকা কী? ভারতবর্ষকে ২০০ বছর লুটপাট, ধন সম্পদ লুটকারী, মাস্টার দ্য সূর্য সেনের মতো স্বদেশ আন্দোলনকারীদের ওপর অত্যাচারকারী ব্রিটিশরা মানবাধিকার বিষয়ে খুবই ভালো কথা বলছে! পাকিস্তানের একটি সরকারকে পতন ঘটানো, বিরোধীদের ওপর, নারীদের ওপর নির্যাতনের বিষয়ে আমেরিকা, ইউরোপ, ব্রিটিশরা নীরব। আমাদের দেশের ধর্মপরায়ণ জনগণ সৃষ্টিকর্তা ছাড়া কারও কাছে মাথা নত করেন না। ধর্মীয় স্কলাররা আমোদের কলমার ব্যাখ্যা দেন। তাহলে এই আমেরিকা, ইউরোপ, ব্রিটিশদের কাছে নত হচ্ছি কেন? আমাদের দেশের স্বাধীন নীতি কি আমরা ঠিক করতে পারব না। আমেরিকা ইউরোপ ব্রিটিশরা যেদেশেই গণতন্ত্র ঠিক করতে গেছে, সেই দেশকে ধ্বংস করেছে। কারণ তাদের স্বার্থ ও ওই সকল দেশের সংস্কৃতি বোঝার অক্ষমতা। আমেরিকা ইউরোপ ব্রিটেনে কি নির্বাচনের আগে সরকার

পদত্যাগ করে?

মার্কিন চাপের জবাবে হাসিনা প্রকাশ্যে দাবি করেছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার সরকারকে পতন করতে চাইছে। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় হাসিনার প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেছে। বলা চলে বাংলাদেশে বিদেশি কূটনীতিকরা অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক কর্মীদের মতো ভূমিকা পালন করছেন। নির্বাচনের সময় ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে বিদেশি কূটনীতিকরা সক্রিয় হয়ে উঠেছে, যেন তারা রাজনৈতিক দল। যা শিষ্টাচার ও ভিয়েনা কনভেনশনের লঙ্ঘন। ভিয়েনা কনভেনশনের অনুচ্ছেদ ৪১-এর ১ ধারায় বলা হয়েছে যে ব্যক্তিরা অন্য দেশে কূটনৈতিক মর্যাদা এবং সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেন তারা সেই দেশের আইন ও নীতির দ্বারা আবদ্ধ হবেন। এ ছাড়া তারা সে দেশের অভ্যন্তরীণ কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবে না। এই বিভাগে আরও দুটি উপধারা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, অনুচ্ছেদের ২ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, কূটনীতিকদের সব ধরনের অফিসের কাজ, যা প্রেরক দেশ কূটনৈতিক মিশনে অর্পণ করবে, তা অবশ্যই গ্রহণকারী দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে করতে হবে। এবং ৩ নম্বর উপধারায়, কূটনীতিকরা তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন কোনো উদ্দেশ্যে তাদের মিশন অফিসের প্রাঙ্গণ ব্যবহার করতে পারবেন না। চুক্তিতে আরও বলা হয়েছে কূটনৈতিক সম্পর্ক দেশগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্মতির ভিত্তিতে হবে। এ ছাড়া ভিয়েনা কনভেনশনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ধারা বা আর্টিকেল ৯-এ বলা হয়েছে যে কোনো দেশ কোনো কারণ ছাড়াই ওই দেশে নিযুক্ত অন্য কোনো দেশের কূটনীতিককে ‘ব্যক্তিত্বহীন’ বা অগ্রহণযোগ্য ঘোষণা করতে পারে।

পরিশেষে একটি আত্মমর্যাদা সম্পন্ন জাতি হিসেবে আসুন আমরা একটি সুন্দর গ্রহণযোগ্য নির্বাচন করি, বিরোধী দলকে সম্মান করি, সকল রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় নির্যাতনকে না বলি। আমরাই এই দেশকে স্বাধীন করেছি, আমরাই এই দেশকে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ধারায় এনেছি। আমরা পারি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে একটি সুন্দর দেশ উপহার দিতে। প্রতিহিংসার রাজনীতির ফসল এই বিদেশিদের অপতৎপরতা। এরাই কোরআন পোড়ায়, এরাই ফিলিস্তিন ভাই-বোনদের ওপর অত্যাচার করে, এরাই হিজাবের বিরুদ্ধে। আসুন বিদেশিদের এই অমর্যাদাকর হস্তক্ষেপকে না বলি।

লেখক: কথা সাহিত্যিক , কবি, গবেষক ও প্রাবন্ধিক

নয়া শতাব্দী/এফআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ