ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

লংকায় যাওয়ার আগেই কি রাবণ

প্রকাশনার সময়: ১৭ জুলাই ২০২৩, ১৫:১৯

কথায় আছে, যে যায় লংকায়, সেই হয় রাবণ। শাসকগোষ্ঠীর দ্বারা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হয়ে অথবা প্রতারিত হয়ে সাধারণ মানুষের দীর্ঘশ্বাস এ প্রবাদে ফুটে উঠেছে। এ মুহূর্তে ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুরকে নিয়েও এ ধরনের একটি কথা চাউর হয়েছে। নুরকে নিয়ে গণমাধ্যমে যেসব তথ্য আসছে তাতে লংকায় যাওয়ার আগেই রাবণ না হলেও রাবণ হওয়ার বেশ কিছু লক্ষণ নুরের মধ্যে দেখা দিয়েছে। তার দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহকর্মী, পরিচিতজন, এলাকার মানুষ যে তথ্য দিচ্ছে এবং সোশ্যাল মিডিয়া বাদ দিয়ে মূল ধারার গণমাধ্যমে যে তথ্য আসছে তাতে অবাক হতে হয়। মনে মনে বলতে ইচ্ছে করে, এই ছিল ‘তোর’ মনে!

নুরের উত্থান সম্পর্কে কমবেশি সবাই জানেন। কোটা সংস্কার আন্দোলন, ভিপি নির্বাচিত হওয়া, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাতের পর একটি রাজনৈতিক দল গঠনের মনোবাসনা নিয়ে তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ার শুরু হয় মাত্র দু’বছর আগে। রাজনীতিতে নেমেই প্রথমে নুর আপামর জনগণের চিরাচরিত ডানপন্থি মনোভাব ও ধর্মীয় বিশ্বাসকে পুঁজি করে সেই ভাবধারার রাজনীতির পথে হাঁটার কৌশল অবলম্বন করে। চাকরি বঞ্চিত, বেকার নিম্ন ও মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তানদের প্রতি আকাঙ্ক্ষার প্রতি তার জোরালো সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং এই শিক্ষিত, নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানদের কানে সে যেন হ্যামিলিয়নের বাঁশির সুর তোলেন। তার সেই মুক্তির মোহন বাঁশির সুরে কীট পতঙ্গের মতো তরুণেরা জুটতে থাকে। প্রচলিত রাজনীতির যে ধারা এসব তরুণদের আশাহত করেছে, যুগ যুগ ধরে প্রতারিত করেছে সেই তরুণেরা চতুর নুরের নতুন রাজনৈতিক ধারার সপক্ষে এসে দাঁড়ায়। স্লোগানে স্লোগানে কম্পিত করে রাজপথ। মার খায়। মামলায় জড়িয়ে পড়ে। আবার ফিরে আসে। তবুও নুরকে ছাড়ে না।

গণমাধ্যমের খবরে জানা যায়, নুর নিজেও নিম্ন-মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। বাবা কৃষক। দু‘বছর আগে কৃষিকাজের পাশাপাশি পটুয়াখালীতে একটি চায়ের দোকান চালাত। তার স্বল্প শিক্ষিত দু‘ভাই সেখানে সময় দিতো। কেউ কেউ বলেছেন যাত্রাবাড়িতে কলার ব্যবসা করতেন। নুরকে পড়াতে গিয়ে তার বাবা জমি বন্ধক রাখেন। মোটামুটি এই হচ্ছে নুরের দু’বছর আগের পারিবারিক অর্থনৈতিক অবস্থা। রাজনীতি শুরুর পর দু’বছর আগেও নুর খুবই সাধারণ পোশাক পরতেন। চেহারায় ছিল খেটে খাওয়া মানুষের রূঢ় সংগ্রামী ছায়া, সেখানে ধনীর আদুরে বা প্রচলিত রাজনীতির সুবিধা নেয়া লাবণ্যময়তা ছিল অনুপস্থিত। কথাও বলতেন দৃঢ় চেতা মানুষের মতো। যেন সমাজের সব কিছু ভেঙেচুরে নতুন করে গড়ে পিটে মানুষের জন্য বাসযোগ্য করার মহানব্রত নিয়ে তিনি রাজনীতিতে এসেছেন। নিজে ইংরেজি সাহিত্যের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও কথায় কোনো ফুটুর-ফাটুর ইংরেজি নেই। পটুয়ারখালীর স্থানীয় ভাষার টানে তার বক্তব্য হয়ে উঠে খুবই সাধারণ। নুরের রাজনীতি মানুষের কল্যাণে মানুষের ভাগ্য বদলের জন্য— এ ছবি তিনি কর্মে-নিষ্ঠায়, পরিশ্রমের ঘামরক্তে আঁকতে পেরেছিলেন মানুষের মনে। অনেক মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন ছিল তার প্রতি। সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে সেই সমর্থন দেশের গন্ডি পেরিয়ে বিদেশেও এক ধরনের মাদকতা তৈরি করেছিল। প্রবাসীদের বেশিরভাগই হয়ে উঠেছিল তার অন্ধ ভক্ত।

কিন্তু মানুষের ভাগ্য ফেরাতে, তাদের কল্যাণে প্রচলিত রাজনীতির বিপরীতে মানুষের রাজনীতি করতে গিয়ে নুর যে ভেতরে ভেতরে নিজকেই বদলে ফেলেছেন, যে শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করবেন বলে এসেছিলেন সেই শ্রেণির দেয়াল ভেঙে তিনি কখন বেরিয়ে গেছেন সেই পরিচিত শ্রেণিতে যারা অর্থ কেলেঙ্কারী করে, ক্ষমতাবান হয়ে পয়সা কামায়, সাধারণ মানুষকে ঠকিয়ে সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলে। ঘরে-বাইরে মিথ্যা বলে। নুরকে এখন সেই শ্রেণির লোক হিসেবেই তার সহকর্মী-গণমাধ্যম চিত্রিত করছে। তার সপক্ষে প্রমাণও মিলছে ভূরি ভূরি।

আলোচিত নুর বেশি আলোচনার মধ্যে আসেন ৬-৭ মাস আগে। তিনি পবিত্র ওমরা হজ পালনের কথা বলে কাতার সফরে যান। সেই সফরের সময়ে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের একজন সদস্য মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে বৈঠক পরবর্তী একটি ছবি সোশ্যাল মিডিয়া ও গণমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। দেশজুড়ে তো বটেই প্রবাসেও তোলপাড় হয়ে যায় এ মোসাদকাণ্ডে। নুর দেশের বাইরে থেকে অস্বীকার করেন। সোশ্যাল মিডিয়ায় তর্ক-বিতর্ক করেন এবং এক পর্যায়ে তিনি স্বীকারও করেন মিটিং হয়েছে। সরকার ব্যবস্থা নেবে এ ভরসায় সবাই চুপ করে যায় এবং বিষয়টি এক প্রকারের ধাপাচাপা পড়ে যায়। সম্প্র্রতি সেই বিষয়টি আবার উত্থাপিত হয় এবং ফিলিস্তিনি রাষ্ট্রদূত মোসাদ এজেন্টের সঙ্গে দফায় দফায় তার বৈঠকের বিষয়টি গণমাধ্যমের সামনে আনেন। তারও আগে আরও কতকগুলো ঘটনা ঘটে তার দল গণঅধিকার পরিষদের অভ্যন্তরে। দলের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়ার সঙ্গে অর্থসহ নানা বিষয়ে মতানৈক্য দেখা দিলে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারের ঘটনা ঘটে। রেজা কিবরিয়া দল থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই থলের বিড়াল বেরিয়ে আসতে থাকে। নুরের আর্থিক অস্বচ্ছতা, দলের ভেতরে স্বেচ্ছাচারিতা প্রকাশ পেতে থেকে। মূলত দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় অনিবন্ধিত গণঅধিকার পরিষদ। দল থেকে বেরিয়ে যায় দলের আরও এক জোরালো কণ্ঠ তারেক।

দলটির ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন আর কিছু না বলাই ভালো। নুরের রাবণ হয়ে উঠার লক্ষণগুলো নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।

দু‘বছর আগে নুরের বাড়িতে মাটির মেঝের একটি টিনের ঘর ছিল। সেখানে এখন পাকা দালান। বাবা আর চায়ের দোকান করেন না। স্ত্রী প্রাইমারি স্কুলের টিচার। এক ভাই কোটি টাকা লগ্নিতে দেশের প্রতিষ্ঠিত কোনো শিল্প গ্রুপের ডিলারশীপ নিয়েছেন। নুর চড়ছেন ২৬ লাখ টাকা ব্যয়ে কেনা একটি গাড়িতে।

নুরের এই যে আর্থিক সচ্ছলতা, পরিবর্তন, প্রতিদিনকার বেশভুষায় বাহারি চাকচিক্য— সেটা ঘটানোর জন্য নুরের স্থায়ী কোনো পেশা নেই। এক টিভি টকশোতে তিনি নিয়মিত আয় হয় এমন কোনো পেশার কথা জানাতে পারেননি। তাহলে নুরের এ আর্থিক উন্নতির চাবিকাঠি কি? কোন আলাদ্বিনের চেরাগ তিনি ঘষা দিয়ে দৈত্যকে আদেশ দিয়ে এ সচ্ছলতা তিনি আনলেন।

উত্তর দলের ভেতর থেকেই পাওয়া যাচ্ছে। দলীয় প্রোগ্রামের নামে আসা চাঁদার টাকার কোনো হিসেব তিনি দিতেন না আর্থিক কমিটির কাছে। প্রবাসীদের পাঠানো টাকাও তিনি দু’হাতে খরচ করতেন। তারও কোনো জবাবদিহিতা ছিল না। এ ছাড়াও প্রবাসীদের কমিটি দেয়ার নামে তিনি লাখ লাখ টাকা হাতিয়েছেন বলেও তার ঘনিষ্টরা অভিযোগ করছে। আর রেজা কিবরিয়া তো সরাসরি বলেছেনই মোসাদের সঙ্গে বৈঠকের পর তিনি কালো ব্যাগে কিছু একটা নিয়ে ফিরেছেন। সেটা অর্থ হওয়াটাই স্বাভাবিক। মোসাদের সদস্য মেন্দি এন সাফাদির সঙ্গে তার বৈঠকের বিষয়টি পরিষ্কার করেছেন তার ঘনিষ্ট তারেক রহমান। দলের ঘরোয়া বৈঠকে মিটিংয়ের কথা নুর তাদেরকে জানিয়েছেন। নুরের অর্থ আত্মসাত নিয়ে আরও কথা বলেছেন তারেক রহমান। ছাত্র অধিকার পরিষদের এক ছাত্রের চিকিৎসা বাবদ দেয়া দু’লাখ টাকা নুর আত্মসাত করেছিলেন এবং সেই দায়ে তাকে বহিষ্কারও করা হয়েছিল বলেও জানান তারেক। পরে তারই অনুরোধে তাকে সংগঠনের জায়গা দেয়া হয়। সেই সুই এখন ফাল হয়ে বের হয়েছে। তারেক তার এই আচরণে দুঃখ পেয়েছেন এবং লাইভ টকশোতে অশ্রুপাত করেছেন এ ধরনের এক ব্যক্তির পক্ষে অতীতে সাফাই গাওয়ার জন্য।

নুর কি তাহলে গণমানুষের অনুভূতি, তরুণদের স্বপ্ন-আকাঙ্ক্ষা, ভাগ্য ফেরাবার রাজনৈতিক মতাদর্শের সঙ্গে বেইমানি করেছে? প্রতারণা করেছেন? এর উত্তর নুরই দিতে পারবেন ভালো। শুধু সাদামাটা চোখে দেখলে নুরের হঠাৎ এ পরিবর্তনটা চোখে লাগে। আঙ্গুল দিয়ে কাউকে দেখিয়ে দিতে হয় না। প্রচলিত রাজনীতির দলনেতার মতোই তিনি সাধারণ কর্মীদের ঢাল বা সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করে নিজের আখের গুছিয়েছেন। তার ঘনিষ্টজনরা বলছেন, চতুর নুর অন্যান্য রাজনীতিবিদের মতোই হয়তো নিজের নামে কিছু করেননি। সব বেনামে জমিয়েছেন সুখের আশায়।

এসব বিষয়ে তদন্তের দাবি উঠেছে। বিশেষ করে ইসরাইলি গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তার বৈঠকের বিষয়ে সরকারের তদন্ত দাবি করছে বেশিরভাগ মানুষ। তাদের বক্তব্য ইসলামের জাতশত্রু ইসরাইলের সঙ্গে নুরের ঘনিষ্টতা এদেশের মানুষ কোনোভাবেই মেনে নেবে না।

তদন্ত হওয়া দরকার নুরের অর্থ লেনদেনের। একটি নতুন দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতার বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ নিশ্চয়ই রাজনীতির জন্য শুভ নয়। তাহলে বিশ্বাসটা থাকল কই। লংকায় যাওয়ার আগেই নুরের এই রাবণ হওয়ার বিষয়টি দেশের মানুষের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার।

লেখক: সাংবাদিক

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ