ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কোরবানির পশু উপঢৌকন নেয়ার অসুস্থ সংস্কৃতি বন্ধ হোক

প্রকাশনার সময়: ২৬ জুন ২০২৩, ১৬:২৯

শুরু হয়েছে পবিত্র জিলহজ মাস। চারদিকে হাজারো আয়োজন পবিত্র ঈদুল আজহার জন্য। ধনী, গরিব, মধ্যবিত্ত সকল শ্রেণির মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে ঈদ আনন্দ। কিন্তু সেই আনন্দ ছুতে পারেনি কিছু বাবাদের হূদয়। বিশেষ করে যাদের কন্যা বিবাহিত, তাদের জন্য এই ঈদ আনন্দ যেন হতাশায় পরিণত হয়েছে। প্রতিনিয়ত বেয়াই বাড়ি থেকে নানারকম চাপের সম্মুখীন হতে হচ্ছে অসহায় বাবাকে। এই মুদ্রাস্ফীতির বাজারে সংসারের সকল খরচ বহন করার পরে অনেক গরিব ও মধ্যবিত্ত বাবাদের হয়তো নিজের কোরবানি দেয়ার সামর্থ্য নেই, তবুও মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে পাঠাতে হবে কোরবানির পশু। হোক সেটা উচ্চ সুদে ঋণ নিয়ে, নয়তো নিজের সহায় সম্পত্তি বিক্রি করে। এভাবেই সমাজ সৃষ্ট অসুস্থ সংস্কৃতির বেড়াজালে চাপা পড়ে যাচ্ছে ঈদুল আজহার আনন্দ, পবিত্রতা ও মাহাত্ম্য।

ঈদুল আজহা মুসলমানদের জীবনে প্রধান দুটি ধর্মীয় উৎসবের মধ্যে একটি। চলতি কথনে এই উৎসবটি কোরবানির ঈদ নামেও পরিচিত। হিজরি বর্ষপঞ্জি হিসাবে জিলহজ মাসের ১০ তারিখ থেকে শুরু করে ১২ তারিখ পর্যন্ত ৩ দিন ধরে ঈদুল আজহার কোরবানি চলতে থাকে। এই উৎসবকে ঈদুজ্জোহাও বলা হয়। ঈদুল আজহা মূলত আরবি বাক্যাংশ। এর অর্থ ত্যাগের উৎসব। এই উৎসবের মূল প্রতিপাদ্য বিষয় ত্যাগ করা। এ দিনে মুসলমানেরা ফজরের নামাজের পরে ঈদগাহে গিয়ে ঈদুল আজহার নামাজ আদায় করে ও অব্যবহিত পরে স্ব-স্ব আর্থিক সামর্থ্য অনুযায়ী গরু, ছাগল, ভেড়া, মহিষ ও উট আল্লাহর নামে কোরবানি করে।

মুমিন বান্দার জীবনে পবিত্র ঈদুল আজহা ও কোরবানির গুরুত্ব সীমাহীন। কারণ প্রকৃত কোরবানি বান্দাকে দ্রুত আল্লাহর নৈকট্যে ভূষিত করে যা মুমিনের জীবনের একমাত্র আরাধনা। কোরবানি পালনের মাধ্যমে বিশ্বের ধর্মপ্রাণ মুসলমানগণ আল্লাহর প্রিয় বান্দা ও নবী হজরত ইব্রাহিম (আঃ) ও হজরত ইসমাইল (আঃ) এর অতুলনীয় আনুগত্য এবং মহান ত্যাগের পুন্যময় স্মৃতি বহন করে। আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টির জন্য মুসলিম উম্মাহ প্রতি বছর পশুকোরবানি করে থাকে।

কোরবানি অর্থ নৈকট্য, ত্যাগ, উৎসর্গ। এর উদ্দেশ্য পশু কোরবানির সঙ্গে সঙ্গে অন্তরের অভ্যন্তরীণ পশুত্বকেও কোরবানি করা। কিন্তু বর্তমান সমাজের কিছু নামধারী মুসলমান কোরবানির মাধ্যমে অন্তরের পশুত্বকে আরও নতুন রূপে প্রকাশ করে। তারা কোরবানির পবিত্র পশুকে ব্যবহার করছে উপহার হিসেবে।

বাংলাদেশের কিছু কিছু এলাকায় মেয়ের বাড়ি থেকে ছেলের বাড়িতে কোরবানির পশু পাঠানো যেন বাধ্যতামূলক। তারা ছেলের শ্বশুরবাড়ি থেকে কোরবানির পশু গ্রহণটা তাদের অধিকার হিসেবে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করেছে। কোন কারণে যদি মেয়ের বাবা মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কোরবানির পশু পাঠাতে না পারে, তবে সমাজের চোখে সে অপরাধী হয়ে পড়ে। মেয়ে এবং মেয়ের বাবাকে তখন নানারকম হেনস্তার স্বীকার হতে হয়। মেয়েটাকে নিরবে সহ্য করতে শ্বশুরবাড়ির লোকেদের কটুকথাসহ হাজারো অপমান। কখনো সেই অপমান রূপ নেয় চরম পর্যায়ের শারীরিক ও মানসিক অত্যাচারে। সেই অত্যাচারের পরিণতি হিসেবে বিবাহ বিচ্ছেদ ও আত্মহত্যার মতো ঘটনাও ঘটে চলছে অহরহ। এই ভয়ংকর পরিণতির কথা মাথায় রেখেই প্রতিটা বাবা যথাসাধ্য চেষ্টা করে চলে মেয়ের শ্বশুরবাড়িতে কোরবানির পশু পাঠানোর জন্য। কখনো বেয়াইয়ের অন্যায় আবদার মেটাতে অসহায় বাবা তার সহায় সম্বল বিক্রি করতে বাধ্য হয়, কখনো বা বাধ্য হয় উচ্চ সুদে ঋণ নিতে। এভাবেই সমাজের অসুস্থ সংস্কৃতি পালন করতে গিয়ে প্রতিনিয়ত নিঃস্ব হচ্ছে অসহায় বাবারা।

এটি কোন সুস্থ সংস্কৃতির অংশ নয় এবং ইসলাম এই অসুস্থ সংস্কৃতি কোনভাবেই সমর্থন করে না। জোরপূর্বক অন্যায্য দাবি আদায় করার ক্ষেত্রে মহান আল্লাহর শাস্তি নির্ধারিত হয়েছে। সুরা নিসার ৩০নং আয়াতে এরশাদ হচ্ছে, ‘আর যে ব্যক্তি সীমালঙ্ঘন করে ও জুলুম করে অচিরেই তাকে আগুনে দগ্ধ করবো। এটা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ। ‘যে মাসে জিহাদের চেয়েও ইবাদত অগ্রগণ্য, যে মাসে যুদ্ধ বিগ্রহ হারাম, যে মাসে বেশি বেশি নফল ইবাদতের উৎসাহ দেয়া হয়েছে, সে মাসে মুসলিম পরিচয়ে ছেলের শ্বশুরবাড়িকে চাপে ফেলে স্বার্থ হাসিল করা শুধু অমানবিকই নয়; বরং চরম অন্যায়।

এই নিকৃষ্ট প্রথা বন্ধ করার এখনই উপযুক্ত সময়। এর জন্য যুবক এবং প্রবীণদের যৌথ সহযোগিতা প্রয়োজন। এই অসুস্থ সংস্কৃতি থেকে সমাজকে মুক্ত করতে হলে এর সামাজিক ও ধর্মীয় নেতিবাচক প্রভাব সম্পর্কে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠ্যপুস্তকে কোরবানির পশু যৌতুক নেয়াকে নিরুৎসাহিত করে এমন প্রবন্ধ, ছোটগল্প ও কবিতা অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি শিক্ষকদের মাধ্যমে সচেতনতা তৈরি করতে হবে। শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে সচেতন করতে পারলে এই কুসংস্কার দূরীকরণ সহজতর হবে। পাশাপাশি মসজিদগুলোতে এ বিষয়ে আলোচনা বাড়াতে হবে। কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য এবং কোরবানির পশু উপঢৌকন নেয়ার ক্ষেত্রে ধর্মীয় বিধি নিষেধগুলো মুসল্লিদের মাঝে তুলে ধরতে হবে। এতে করে প্রবীণ ও যুবক সকলেই সচেতন হবে। পাশাপাশি কোরবানির পশু উপঢৌকন হিসেবে গ্রহণ করাকে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে ঘোষণা করে নতুন আইন প্রণয়ন করা যেতে পারে। এক্ষেত্রে সরকার ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কঠোর হস্তক্ষেপ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।

লেখক: শিক্ষার্থী, সমাজবিজ্ঞান বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

নয়াশতাব্দী/জেডএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ