ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বঙ্গবন্ধু : জনসম্প্রীতি ও জনগণের রাজনীতি

প্রকাশনার সময়: ২৮ আগস্ট ২০২১, ১০:৫৫

স্বাধীন বাংলাদেশের আর্বিভাব নিয়ে বর্তমান প্রজন্মের অনেকের কাছে হয়তো সঠিক ইতিহাস জানতে পারেনি। বাংলাদেশকে স্বাধীনভাবে আবির্ভূত হওয়ার পেছনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনবদ্য ভূমিকা ও অবদান, জনসম্প্রীতি ও রাজনৈতিক চিন্তাধারা সম্পর্কে সঠিক তথ্য আহরণ কঠিন নয়। ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ অভূতপূর্ব বিজয় লাভ করে। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে এবং প্রাদেশিক পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে ২৮৮টিতে জয়লাভ করে। ছয় দফা এবং এগারো দফার ভিত্তিতে নির্বাচনী ইশতেহার রচিত হয় এবং নির্বাচনী প্রচারণা চালানো হয়।

আমরা অত্যন্ত পরিতাপের সঙ্গে লক্ষ্য করছি যারাই বড়মাপের নেতা হন, তারা জনগণের সঙ্গে তেমন সম্পৃক্ততা রাখতে চান না। তারা জনগণকে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে পরিচালনার কথা বলেন। তারা অনেক সময় জনগণের ধরাছোঁয়ার বাইওে থেকে যান। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর বেলায় তা ছিল ব্যতিক্রম। তিনি সব সময় বাংলাদেশের সব পর্যায়ের জনসাধারণের সঙ্গে নিজেকে এক করে দেখতেন এবং তাই তিনি বারবার তার জনগণের জন্য ভালোবাসার কথা উল্লেখ করতেন।

পৃথিবীর বিভিন্ন নেতা ও গুণী ব্যক্তির আত্মজীবনী আমরা যখনই পড়ি এবং তাদের সঙ্গে যখন বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মকা-ের তুলনা করি, তখন তার একটি অভিব্যক্তি, ‘জনগণের প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসা’, তা অনন্য বিরল দৃষ্টান্ত বলে মনে হয়েছে। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণের জন্য তার যে ভালোবাসা, বিশ্বাস এবং প্রতিদানে জনগণের যে ভালোবাসা তিনি পেয়েছেন, তার কথা তিনি নানা ভাষণে বারবার ব্যক্ত করেছেন।

বঙ্গবন্ধু আজীবন প্রতিনিয়তই জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িকতা, সমাজতন্ত্র এসব আদর্শের কথা বলতেন, তবে সাধারণ মানুষের দুঃখকষ্টে তাদের পাশে দাঁড়ানো, জনসাধারণ কোন কোন ইস্যুকে প্রাধান্য দিচ্ছে তার দিকেও তার দৃষ্টি ছিল প্রকট। সাধারণ জনগণের ইস্যু নিয়েই তিনি প্রতিনিয়তই কথা বলতেন, রাজনীতি করতেন। তিনি যখন পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত, তখন তিনি দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের জন্য লঙ্গরখানা খুলে কাজ করেছেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর যখন দেশে খাদ্যের অভাব, তখন তিনি সুষম খাদ্যবণ্টনের আন্দোলন, অনাহারী ও দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের মিছিলে অংশগ্রহণ করেন। তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রতিরোধে কাজ করেন। দাঙ্গাকবলিত মানুষকে উদ্ধারের জন্য কাজ করেছেন। তার রাজনৈতিক চিন্তাধারা শুধু ক্ষমতাকেন্দ্রিক ছিল না, সাধারণ মানুষের সমস্যার সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে তিনি তার রাজনৈতিক চিন্তা গড়ে তুলেছিলেন।

তার বিভিন্ন লেখায় আমরা দেখতে পাই দেশে বন্যা, খরা, প্রাকৃতিক দুর্যোগে কিংবা খাদ্যাভাব অথবা নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য ও ভোগ্যণ্যের মূল্য বা কর বৃদ্ধি হলে তার কত দুশ্চিন্তা হতো। সাধারণ জনগণের ওপর যেসব ইস্যু বা বিষয় প্রভাব ফেলে, তার সবই তার রাজনৈতিক কর্মকা-ের এজেন্ডার মূল বিষয় ছিল। ‘কারাগারের রোজনামচা’য় তিনি লিখছেন : ‘খবরের কাগজ এসেছে...সিলেটের বন্যায় দেড় লক্ষ লোক গৃহহীন, ১০ জন মারা গেছে। কত যে গবাদিপশু ভাসাইয়া নিয়া গেছে তার কি কোনো সীমা আছে। কী করে এ দেশের লোক বাঁচবে তা ভাবতেও পারি না।...কত কর মানুষ দিবে। কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী শোয়েব সাহেব বলেছেন জনসাধারণ অধিকতর সচ্ছল হইয়াছে তাই কর ধার্য করেছেন। তিনি যাদের মুখপাত্র এবং যাদের স্বার্থে কাজ করেছেন তারা সচ্ছল হয়েছে। তাদের করের বোঝা থেকে বাদ দেয়া হয়েছে। শিল্পপতি ও বড় ব্যবসায়ীরা আনন্দিতই শুধু হন নাই, প্রকাশ্যে মন্ত্রীকে মোবারকবাদ দিয়ে চলেছেন। আর জনগণ এই গণবিরোধী বাজেট যে গরিব মারার বাজেট বলে চিৎকার করতে শুরু করেছে।’

বঙ্গবন্ধুর আর একটি বিশেষ গুণ ছিল, যারা সমাজে অবহেলিত, পিছিয়ে পড়া ও বঞ্চিত, তাদের প্রতি তার বিশেষ মমতাবোধ ও সহমর্মিতা ছিল। ‘কারাগারের রোজনামচা’ বইটিতে তিনি বিভিন্ন কয়েদির জীবনবৃত্তান্ত, দুঃখকষ্টের ইতিহাস তুলে ধরেছেন। বিশেষ করে মানসিক রোগে আক্রান্ত কয়েদিদের প্রতি তার মমতাবোধ আমরা লক্ষ করি। জেলের কর্মচারীদের সঙ্গেও তার সম্প্রীতি গড়ে ওঠে। তিনি জেলে নিজ হাতে রান্না করেছেন, বাগান করেছেন এবং তার সঙ্গে ডায়েরিও লিখেছেন। আওয়ামী লীগের অগণিত কর্মীর ব্যক্তিগত সুখ-দুঃখেরও তিনি খবর রাখতেন। তার দুটি বইয়েই আমরা তার বহু সহকর্মীর এবং আওয়ামী লীগের নাম জানা-অজানা বহু কর্মীর ত্যাগ-তিতিক্ষার বর্ণনা পাই।

বঙ্গবন্ধুর বিশেষ গুণ তিনি, একদিকে ছিলেন সাধারণ মানুষের নেতা, মানুষের কাছ থেকে তাদের সমস্যা, আশা-আকাক্সক্ষার কথা তিনি জেনেছেন, শিখেছেন। সাধারণ মানুষের আশা-আকাক্সক্ষাকেই তিনি সামনের দিকে, প্রগতির দিকে নিতে সারাজীবন আন্দোলন করেছেন। তিনি সব সময় শেষ ভরসা করতেন সাধারণ মানুষের ওপর। তাই ১৯৭১ সালের ৭ মার্চে তার ঐতিহাসিক ভাষণে তিনি জনগণকে আহ্বান করে বলেন ‘যার যা আছে তাই নিয়ে’ স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্ত হোন। জাগ্রত জনতার ওপর তার প্রচ- বিশ্বাস ছিল বলেই তিনি সেদিন বলতে পেরেছিলেন, ‘সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবা না।...রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরো দেব, এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’

বঙ্গবন্ধু অসাম্প্রদায়িক বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে নিয়ে কোনো সময় আপোস করেননি। বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলনকে সুসংহত করেছিলেন। তিনি কখনো বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে ঘৃণা সৃষ্টি ও সংঘাতের রাজনীতি করেননি। বহু জাতীয়তাবাদী আন্দোলন এক জাতিকে অন্য জাতির বিরুদ্ধে সহিংস আচরণের দিকে ঠেলে দেয়। বঙ্গবন্ধু শোষকদের হাত থেকে বাঙালির মুক্তি কামনার লক্ষ্যে কাজ করেছেন। বাঙালিকে অন্য কোনো জাতির বিরুদ্ধে সহিংস আচরণে প্ররোচনা দেননি। সম্প্রতি আমরা তথাকথিত উন্নত পশ্চিমা বিশে^র বিভিন্ন গণতান্ত্রিক দেশে উগ্র জাতীয়তাবাদের উত্থান দেখছি, যেখানে বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে তিক্ততা এবং সংখ্যাগুরুদের সংখ্যালঘুদের প্রতি অসহিষ্ণু মনোভাব লক্ষ করছি। বঙ্গবন্ধুর জাতীয়তাবাদের চিন্তা ছিল এর বিপরীত। তিনি সব গোষ্ঠীর সহাবস্থান এবং সব নাগরিকের সমান অধিকারে বিশ্বাস করতেন। তার আত্মজীবনীতে তিনি নিজেকে একাধারে বাঙালি এবং মানুষ হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। তিনি কখনো কোনো অমানবিক কাজের সমর্থন কখনো করেননি।

বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের সুচনালগ্ন থেকেই তাকে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে দেখি। ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট কলকাতার প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবস ও কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার তিনি ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। সোহরাওয়ার্দী সরকারকে কেউই যেন দোষারোপ করতে না পারে সেজন্য তাদের এই দিবসটি শান্তিপূর্ণভাবে পালনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে কলকাতায় এবং পরে নোয়াখালীতে। কলকাতায় তিনি হিন্দু, মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের লোককেই দাঙ্গা থেকে উদ্ধার করার চেষ্টা করেন। এরপর যখন মহাত্মা গান্ধীর সাথে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ফিরিয়ে আনার জন্য সোহরাওয়ার্দী যুক্ত হয়েছিলেন, তখন বঙ্গবন্ধুও সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সেই প্রচেষ্টায় যুক্ত হন।

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর বঙ্গবন্ধু যখন কলকাতা থেকে চলে আসেন, তখন সোহরাওয়ার্দী তাকে বলেন তিনি যেন পূর্ববঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্য কাজ করেন, যাতে হিন্দুরা পূর্ববঙ্গ ত্যাগ করে পশ্চিমবঙ্গে চলে আসতে বাধ্য না হয়। সোহরাওয়ার্দী তাকে বলেছিলেন : ‘চেষ্টা করো যাতে হিন্দুরা চলে না আসে। ওরা এদিকে এলেই গোলমাল করবে, তাতে মুসলমানরা বাধ্য হয়ে পূর্ব বাংলায় ছুটবে। যদি পশ্চিম বাংলা, বিহার ও আসামের মুসলমান একবার পূর্ব বাংলার দিকে রওনা হয়, তবে...এত লোকের জায়গাটা তোমরা কোথায় দিবা...’।

তিনি ঢাকায় ফিরে এসে গণতান্ত্রিক যুবলীগে যোগ দিয়ে সাম্প্রদায়িক মিলনকে একমাত্র কর্মসূচি হিসেবে নেয়ার ওপর জোর দেন। পূর্ব বাংলায় যাতে দাঙ্গা না হয়, তার জন্য তিনি সব সময়ই সতর্ক ছিলেন। দাঙ্গা বলতে যে শুধু হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা তাই নয়, সব রকমের দাঙ্গারই তিনি বিরোধী ছিলেন। তার আত্মজীবনীতে লাহোরে ১৯৫৩ সালের কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে দাঙ্গার তিনি নিন্দা করেছেন। ধর্ম নিয়ে রাজনীতির বিপক্ষে ছিলেন তিনি। ১৯৫৪ সালে নারায়ণগঞ্জের আদমজী পাটকলে বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা যাতে বিস্তৃতি লাভ না করে, তার জন্য তিনি কাজ করেন। ১৯৬৪ সালে ভারতে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার পর তিনি সারা বাংলাদেশে দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করেন এবং ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শিরোনামে প্রচারপত্র প্রকাশ করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের ভাষণেও তিনি জনগণকে সতর্ক করে বলেন : ‘মনে রাখবেন, শত্রুবাহিনী ঢুকেছে, নিজেদের মধ্যে আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটপাট করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-অবাঙালি যারা আছেন, তারা আমাদের ভাই, তাদের রক্ষার দায়িত্ব আমাদের ওপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়।’

সমাজতন্ত্র, শোষণমুক্তি ও বৈষম্যহীনতা নিয়ে তার আত্মজীবনীতে বঙ্গবন্ধু লিখছেন : ‘আমি নিজে কমিউনিস্ট নই, তবে সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি এবং পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে বিশ্বাস করি না। একে আমি শোষণের যন্ত্র হিসাবে মনে করি। এই পুঁজিপতি সৃষ্টির অর্থনীতি যত দিন দুনিয়ায় থাকবে, তত দিন দুনিয়ার মানুষের ওপর থেকে শোষণ বন্ধ হতে পারে না।’ সমাজতন্ত্র বলতে তিনি প্রধানত শোষণমুক্ত এবং বৈষম্যহীন একটা ব্যবস্থার কথা ভাবতেন। ১৯৫২ সালে চীন যাওয়ার পর চীন এবং পাকিস্তানের মধ্যে যে পার্থক্য তিনি দেখেছেন, তা তার মনে গভীর দাগ কেটেছে। এই দুই দেশের পার্থক্য সম্বন্ধে তিনি লিখছেন : ‘তাদের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য হলো তাদের জনগণ জানতে পারল ও অনুভব করতে পারল এই দেশ ও এ দেশের সম্পদ তাদের। আর আমাদের জনগণ বুঝতে আরম্ভ করল, জাতীয় সম্পদ বিশেষ গোষ্ঠীর আর তারা যেন কেউই নন।’

তিনি প্রচ-ভাবে বিশ্বাস করতেন, দারিদ্র্য, শোষণ মুক্তি এবং বৈষম্য দূরীকরণে সরকারের যে দায়িত্ব আছে। চীনে গিয়ে তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন চীন সরকার সাধারণ জনগণের জন্য কী কী কাজ করছে, সে দেশে প্রাধান্য পাচ্ছে শিল্পকারখানার উন্নতি, শৌখিন দ্রব্য নয়। তিনি লিখছেন : ‘ভূমিহীন কৃষক জমির মালিক হয়েছে। আজ চীন দেশ কৃষক-মজুরের দেশ। শোষক শ্রেণি শেষ হয়ে গেছে।’ ‘নতুন নতুন স্কুল, কলেজ গড়ে উঠেছে চারদিকে। ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়ের শিক্ষার ভার সরকার নিয়েছে।’ ‘কারাগারের রোজনামচা’য়ও তিনি লিখেছেন বৈষম্যহীনতার কথা। তিনি লিখেছেন যে, কারাগারে তিনি সবার সঙ্গে একসঙ্গে খেতেন, যেমন ব্যবস্থা ছিল তার নিজ বাড়িতে : ‘আমি যাহা খাই ওদের না দিয়ে খাই না। আমার বাড়িতেও একই নিয়ম।...আজ নতুন নতুন শিল্পপতিদের ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতেও দুই পাক হয়। সাহেবদের জন্য আলাদা, অন্যদের জন্য পৃথক রান্না ও ব্যবস্থাপনা। আমাদের দেশে যখন একচেটিয়া সামন্তবাদ ছিল, তখন জমিদার, তালুকদারদের বাড়িতেও এই ব্যবস্থা ছিল না। আজ সামন্ততন্ত্রের কবরের ওপর শিল্প ও বাণিজ্য সভ্যতার সৌধ গড়ে উঠতে শুরু করেছে, তখনই এই রকম মানসিক পরিবর্তনও শুরু হয়েছে। সামন্ততন্ত্রের শোষণের চেয়েও এই শোষণ ভয়াবহ।’

স্বাধীনতা পরবতী সময়ে তিনি তার স্বপ্নের সোনার বাংলায় কোনো বৈষম্য দেখতে চাননি। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তিনি বলেন : ‘বাংলাদেশে মানুষে মানুষে, ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে বৈষম্য থাকবে না। সম্পদের বণ্টন ব্যবস্থায় সমতা আনতে হবে এবং উচ্চতর আয় ও নিম্নতম উপার্জনের ক্ষেত্রে যে আকাশচুম্বী বৈষম্য এত দিন ধরে বিরাজ করছিল, সেটা দূর করতে হবে।’

বঙ্গবন্ধুর চিন্তাধারা ও সংবিধানের চার মূলনীতি সমুন্নত রাখার বিষয়ে তিনি বারবার উত্থাপন করেছেন। বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক চিন্তাধারার যে চারটি বৈশিষ্ট্য আমরা আমাদের সংবিধানের চার মূলনীতিতে দেখতে পাই। তার কর্মকা-ের লক্ষ্য তিনি খুব সহজ দুটি শব্দে প্রায়ই ব্যক্ত করতেন। তিনি বলতেন তার লক্ষ্য হচ্ছে ‘সোনার বাংলা গড়ে তোলা’, কিংবা তিনি বলতেন ‘দুঃখী মানুষের মুখে তিনি হাসি ফোটাতে চান।’ বঙ্গবন্ধু তার জনসভায় খুবই সরল ভাষায় বক্তৃতা করতেন। তাই তার বক্তব্য ছিল সুস্পষ্ট। যেমন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭২ সালে এক জনসভায় তিনি বলেন : ‘আমি কী চাই? আমি চাই বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত খাক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ সুখী হোক। আমি কী চাই? আমার বাংলার মানুষ হেসেখেলে বেড়াক। আমি কী চাই? আমার সোনার বাংলার মানুষ আবার প্রাণভরে হাসুক।’

বঙ্গবন্ধু অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির হার কিংবা অন্য তাত্ত্বিক বিষয় নিয়ে মাথা ঘামাতেন না। তিনি ঠিকই জানতেন জীবনে একটি হাসি কত অমূল্য এবং সেই অমূল্য সম্পদই অর্জন করাটা ছিল তার লক্ষ্য। সেকারণেই সাধারণ মানুষের অধিকার সমুন্নত রাখা, তাদের ক্ষমতায়ন জোরদার করা ও রাজনীতিকে জনসম্পৃক্ত করার ওপর জোর দিয়েছেন। বর্তমান সময়ে বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী ও ভাষণ থেকে নিয়ে পথ চলার বিকল্প নেই।

সহায়ক সূত্র :

শেখ মুজিবুর রহমান, অসমাপ্ত আত্মজীবনী, ঢাকা, দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড, ২০১২

লেখক : এস এম নাজের হোসাইন, ভাইস প্রেসিডেন্ট, কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)।

ই-মেইল : [email protected]

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ