ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের বিচার প্রসঙ্গে

প্রকাশনার সময়: ২৫ আগস্ট ২০২১, ০৮:৩০

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ছিল বৃষ্টিঝরা দিন। সেদিন শ্রাবণের এই দিনে বৃষ্টি নয়, ঝরেছিল জাতির জনকের রক্তবৃষ্টি। সেই থেকে প্রতি বছর এটি আমাদের ইতিহাসে একইসঙ্গেও বেদনার, হদয়ে রক্তক্ষরণের এবং কালো দিন। সেই দিন তার বুক থেকে রক্তগোলাপের মতো লাল রক্ত ঝরেছিল ঘাতকের বুলেটে।

সেদিন আমাদের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসগৃহে, ৩২ নম্বরের সেই বাড়িতে, আমাদের ইতিহাস তীর্থে, তিনি সেদিন কবরে শায়িত হয়েছিলেন কেবল তার নশ্বর শরীর নিয়ে, কিন্তু তার অবিনশ্বর চেতনা ও আদর্শ ছিল মৃত্যুঞ্জয়ী। ঘাতকের সাধ্য ছিল না ইতিহাসের সেই মহানায়কের অস্তিত্ব, আদর্শ ও চেতনাকে বিনাশ করা। ১৫ আগস্ট ইতিহাসের বেদনাবিধুর ও বিভীষিকাময় দিন।

১৯৭৫ সালের ওই দিনের কালরাতে ঘটেছিল ইতিহাসের সেই কলঙ্কজনক ঘটনা। বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্রষ্টা, বাঙালি জাতির মহানায়ক, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, অবিসংবাদিত নেতা, গণতন্ত্র, শান্তি ও পরাধীনতার শৃঙ্খল মুক্তির মানসপুত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করে একাত্তরের পরাজিত শক্তি ও নরপিশাচরা।

সত্যিই সেদিন কাঁদারই দিন। সেই ভয়াল-বীভৎস ১৫ আগস্ট। সেদিন বাতাস কেঁদেছিল। শ্রাবণের বৃষ্টি নয়, আকাশের চোখে ছিল জল। গাছের পাতারা শোকে সেদিন ঝরেছে অবিরল। সেদিন ঘাতকচক্র মুছে দিতে চেয়েছিল রক্তের চিহ্নসহ জনকের লাশ। ভয়ার্ত বাংলায় ছিল ঘরে ঘরে চাপা দীর্ঘশ্বাস... সেই শোক জেগে আছে রক্তরাঙ্গা ওই পতাকায়, সেই শোক অনির্বাণও এখনো বহমান এই বাংলায়।

নদীর স্রোতের মতো চির বহমান কাল থেকে কালান্তরে জ্বলবে নিরন্তর এই শোকের আগুন। বঙ্গবন্ধু আর বাংলাদেশ সমার্থক। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে তারা বাংলাদেশকে, দেশের স্বাধীনতাকেই হত্যা করতে চেয়েছিল, মুছে দিতে চেয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে অর্জিত এই দেশকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে। কিন্তু চাইলেই সহজেই কি মুছে ফেলা যায় জনকের নাম আর জনকের স্বপ্নজাত দেশটিকে?

দক্ষিণ এশিয়ায় পাঁচ হাজার বছরের ইতিহাসে আমরাই একমাত্র জাতি যারা সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে প্রত্যক্ষ যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করেছি একজন মানুষের ডাকে, একটিমাত্র রণমন্ত্র কণ্ঠে ধারণ করে। সেই মানুষটি হলেন আমাদের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর সেই রণমন্ত্র ছিল ‘জয় বাংলা’। বিভিন্ন কবির অসংখ্য কবিতার পঙ্ক্তিতে উঠে আসা সেই ধন্য পুরুষ স্বাধীন বাংলার স্থপতি, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪৬তম শাহাদাতবার্ষিকী। বাংলাদেশ ও বাঙালির জন্য গভীর মর্মস্পর্শী শোকের দিন, জাতীয় শোক দিবস। বাঙালি জাতি আজ গভীর শোক আর শ্রদ্ধায় তার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে স্মরণ করছি।

বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে শ্রেষ্ঠতম সেই পুরুষ তিনি, একটি স্বাধীন জাতিরাষ্ট্র হিসেবে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। বাংলার মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাত্র ৫৫ বছরের জীবনে (১৯২০-১৯৭৫) স্বদেশের মাটি আর মানুষকে এমন গভীর ভালোবাসার বন্ধনে বেঁধেছিলেন, যে বন্ধন কোনোদিন ছিন্ন হবার নয়। আজীবন ঔপনিবেশিক শোষণ-বঞ্চনার বিরুদ্ধে, দরিদ্র-নিপীড়িত বঞ্চিত মানুষের মুক্তির সংগ্রামে এমন এক অনন্য ভূমিকা রেখেছিলেন, যার তুলনা বিরল। একজন প্রকৃত নেতার যেসব গুণাবলি থাকা প্রয়োজন, সব গুণ নিয়েই জন্মে ছিলেন ক্ষণজন্ম এই মহাপুরুষ। যার রাজনৈতিক জীবন ছিল বহুবর্ণিল, যার কণ্ঠে ছিল জাদু। যিনি রচনা করেছিলেন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিজয় ইতিহাস।

ঘাতকচক্র চেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে দেশকে পাকিস্তানি ভাব ধারায় পরিচালিত করা, স্বাধীনতা ও মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, বঙ্গবন্ধুর নাম মানুষের হৃদয় থেকে মুছে ফেলতে। কিন্তু এমন একজন রাষ্ট্র্রনায়ককে একটি জাতির হদয় থেকে চিরতরে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু প্রতিটি উৎসবে, আনন্দ-বেদনা, হাসি-কান্না, কর্মে ফিরে আসেন বারবার, সব সময়ে। কারণ তিনি যে মৃত্যুঞ্জয়ী। কবিতার ভাষায়- ‘এই ইতিহাস ভুলে যাব আজ, আমি কি তেমন সন্তান? যখন আমার পিতার নাম শেখ মুজিবুর রহমান।’ তাই শোকের দিবসে আজ সারাদেশের পথে-প্রান্তে লাখো-কোটি কৃতজ্ঞ বাঙালির কণ্ঠে ধ্বনিত হবে কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের সেই বিখ্যাত পঙ্ক্তিমালা ‘যতকাল রবে পদ্মা যমুনা, গৌরী মেঘনা বহমান/ততকাল রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’

বাংলাদেশের স্থপতির নির্মম-নৃশংস হত্যাযজ্ঞের বিচার পেতে বাঙালি জাতিকে ৩৫ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। কারণ জিয়াউর রহমানের শাসনামলে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির মাধ্যমে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হত্যার বিচারের পথ বন্ধ করে দেয়। সেই থেকে প্রতি পদে পদে খুনিদের দোসর ও মদতদানকারীদের ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজালে আটকে থেকেছে ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম এই হত্যাযজ্ঞের বিচার। সব ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের বেড়াজাল ছিন্ন করে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ১৯৯৬ সালের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণের পর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে জাতির জনকের হত্যার বিচার শুরু করেন।

পরবর্তীতে ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনা দ্বিতীয় মেয়াদে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব পেয়ে ২০১০ সালের ২৮ জানুয়ারি মধ্যরাতে মানবতার শত্রু নরপিশাচ বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত পাঁচ খুনির মৃত্যুদ- কার্যকর করেন। সর্বশেষ ভারতে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর আরেক খুনি আবদুল মাজেদকে এ বছর দেশে গ্রেফতারের পর আইনি প্রক্রিয়া শেষে ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়। এখনো কয়েকজন খুনি বিদেশে পালিয়ে আছে। ছয় খুনির ফাঁসি হলেও আজও নেপথ্যের কুশীলবরা রয়েছে ধরাছোঁয়ার বাইরে। বঙ্গবন্ধু হত্যাযজ্ঞের ‘মাস্টারমাইন্ড’ জিয়াউর রহমান, আওয়ামী লীগসহ বিভিন্ন মহল দীর্ঘদিন ধরে এ অভিযোগ করে আসছে। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার সাক্ষী, আসামিদের বক্তব্যেও জিয়ার সম্পৃক্ততার বিষয়টি উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু হত্যার ৪৬ বছরের পথ পরিক্রমায় জিয়াউর রহমানসহ অনেকের নামই আসলেও তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। তাছাড়া সপরিবারে জাতির জনককে হত্যার ঘটনায় দেশি বিদেশি চক্রও জড়িত ছিল। তাই এসব ষড়যন্ত্রকারীকে চিহ্নিত করে তাদের বিচারের আওতায় আনাও সময়ের দাবি। তাই এবারের শোক দিবসের সর্বত্র একই আওয়াজ উঠেছে- বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত শুধু খুনি নয়, নেপথ্যের কুশীলবদেরও দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। এ জন্য একটি বিশেষ কমিশন গঠন করে জাতির সামনে তাদের মুখোশ উন্মোচন করতে হবে। সরকারের সর্বোচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রী ও নেতাদের মুখ থেকেও এ দাবি উঠেছে বেশ জোরালোভাবে। তাই জাতিকে সম্পূর্ণরূপে কলঙ্কমুক্ত করতে হলে বঙ্গবন্ধুর হত্যার নেপথ্যের কুশীলবদের মুখোশ ও মরণোত্তর বিচার হওয়া প্রয়োজন।

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট

নয়া শতাব্দী/এসএম

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ