২০০৪ সালের ১ এপ্রিল মধ্যরাতে চট্টগ্রাম ইউরিয়া সার কারখানা বা সিইউএফএল জেটিঘাটে খালাসের সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বিপুল পরিমাণে অস্ত্রশস্ত্র আটক করে যা পরিবহনের জন্য ১০টি ট্রাক প্রয়োজন হয়েছিল।
এ অস্ত্রশস্ত্রের চোরাচালান জাহাজের মাধ্যমে বঙ্গোপসাগর দিয়ে কর্ণফুলী নদীতে আনা হয়েছিল। ২০০৫ সালের ৬ জুলাই এ মামলার বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এ মামলাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে ১০ ট্রাক অস্ত্র মামলা বলে পরিচিত। বাংলাদেশের ইতিহাসে ধরা পড়া অস্ত্র চোরাচালানের মধ্যে এটি সর্বোচ্চ পরিমাণ। এ মামলার পাবলিক প্রসিকিউটর কামাল উদ্দিন আহমেদের মতে আসামি ছাড়াও এ মামলার কয়েকজন সাক্ষী আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফার জন্য আটককৃত অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশের জলসীমা ব্যবহার করে আনয়ন করা হয়েছিল।
আটককালে চোরাচালনের মোট ৪৬৩টি বাক্স অস্ত্রসস্ত্র উদ্ধার করা হয় যেগুলোর মধ্যে ছিল এমটিটি, এসএমজি, টমিগান ৭৯০টি, গ্রেনেড ২৭ হাজার, রকেট লঞ্চার ১৫০, ম্যাগজিন ৬২০ এবং ১১ লাখ ৪৩ হাজার ৫২০টি গুলি। এগুলোর আনুমানিক মূল্য ২৭ হাজার কোটি টাকা। অস্ত্রের মজুদের এমন ভয়াবহতা দেখে পুরো জাতি সেদিন আতকে উঠেছিল। সবার মনে ছিল প্রশ্ন, কিভাবে এ বিপুল পরিমাণ অস্ত্রের মজুদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাকি দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করল? কেন আনা হলো এ অস্ত্র? কি কারণে আনা হলো এ অস্ত্র?
৩ এপ্রিল ২০০৪ কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আহাদুর রহমান বাদী হয়ে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(বি) ধারায় এবং ১৮৭৮ সালের ১৯(এ) ধারায় অস্ত্র আইনে দুটি মামলা দায়ের করেছিলেন। পরবর্তী কালে মামলার তদন্তের দায়িত্ব দেয়া হয় সিআইডি পুলিশকে। পুলিশ তদন্তে বের হয়ে আসে থলের বিড়াল।
১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় দায়ের করা দুটি মামলার তৎকালীন বিশেষ ট্রাইব্যুনাল-১-এর বিচারক এস এম মজিবুর রহমান কর্তৃক প্রদত্ত ৫১৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়ে উঠে আসে গা শিউড়ে ওঠার মতো তথ্য। সেখানে উঠে এসেছিল কিভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দিয়ে তৎকালীন সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে দেশের অভ্যন্তরে আরেক দেশের বিচ্ছিন্নতা বাদীদের চারণ ভূমি বানানো হয়েছিল। কিভাবে আমাদের প্রাণপ্রিয় মাতৃভূমিকে বানাতে চাওয়া হয়েছিল বিচ্ছিন্নতা বাদীদের অভয়ারণ্য।
সম্প্রতি সময়ে এ বিষয়টি আরেকবার আলোচনায় এসেছে উলফা প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক অনুপ চেটিয়া এবং ভারতের প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা ডিফেন্স ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির (ডিআইএ) সাবেক ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেল মেজর জেনারেল গগনজিৎ সিংয়ের গণমাধ্যমকে দেয়া সাক্ষাৎকারকে কেন্দ্র করে। দুজনের সাক্ষাৎকার উঠে এসেছে একটি বিষয় তা হলো ২০০৪ সালের এপ্রিলে চট্টগ্রাম থেকে ১০ ট্রাক অস্ত্রের যে বিশাল চালান উদ্ধার করা হয় তা শুধু উলফা নয়, ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আরও কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর কাছে যাচ্ছিল। এসব অস্ত্র ব্যবহার করে ওই অঞ্চলকে অস্থিতিশীল করে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
অনুপ চেটিয়া সাক্ষাৎকার, মেজর জেনারেল গগনজিৎ সিংয়ের সাক্ষাৎকার এবং আদালত কর্তৃক প্রদত্ত ৫১৪ পৃষ্ঠার পূর্ণাঙ্গ রায়— এ ৩টি বিষয় বিশ্লেষণ করলে মোটা দাগে কয়েকটি বিষয় নিশ্চিত হওয়া যায়। প্রথমত, বাংলাদেশকে ভারতের বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন উলফাসহ ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের আরও কয়েকটি বিদ্রোহী গোষ্ঠীর অভয়ারণ্য বানানো চেষ্টা করা হয়েছিল। এদের অস্ত্র সরবরাহের ট্রানজিট রুট হিসেবে বাংলাদেশকে ব্যবহার করা হয়েছিল এবং এ বিষয়ে প্রত্যক্ষ মদদদান করেছিল পাকিস্তানি গোয়েন্দা সংস্থা দ্বিতীয়ত, পুরো বিষয়ে তৎকালীন রাজনৈতিক সরকারের শুধু সায় ছিল না বরং তাদের প্রত্যক্ষ মদদে এ ঘটনা ঘটেছে। তৃতীয়ত, এ ঘটনা সংগঠিত করতে যারা ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করছেন তারা রাষ্ট্রের অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানে কর্মরত ছিলেন।
ভাবতে অবাক লাগে জনগণের ভোটে নির্বাচিত একটি সরকার কিভাবে দেশের সার্বভৌমত্ব জলাঞ্জলি দিয়ে দেশকে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের চারণভূমি বানানোর পরিকল্পনা করতে পারে? ভোট হচ্ছে জনগণ কর্তৃক প্রদত্ত আমানত। অথচ সেই আমানতের খেয়ানত করে রাষ্ট্রের নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের আমন্ত্রণ জানানোর মহোৎসবে মেতে ছিল তৎকালীন সরকার।
তৎকালীন সরকারের পাকিস্তানি গোয়েন্দা বাহিনীর প্রেসক্রিপশন গলধকরণ করে যে হীন অপচেষ্টা চালিয়েছিল তা শুধু ৩০ লাখ শহিদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল চেতনাকে ভূলুণ্ঠিত করেনি বরং আন্তর্জাতিকভাবে বাংলাদেশের ভাবমূর্তিকেও ভয়াবহভাবে ক্ষুণ্ন করে। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাহায্য ছিল সার্কের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এ ধরনের ঘটনার ফলে শুধু বাংলাদেশের নিরাপত্তা নয় বরং গোটা উপমহাদেশের নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়েছিল।
আরেকটি দুঃখজনক বিষয় হচ্ছে, এ কুকর্মগুলোকে পরিচালনা করতে যাদেরকে ক্রীড়নক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল তারা সবাই ছিল রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা। অবশ্যই ব্যক্তির কুকর্মের দায় প্রতিষ্ঠান বহন করবে না। তাই যেসব উচ্চাভিলাষী ও দুর্নীতিপরায়ণ ব্যক্তিরা দেশের স্বার্থ এবং নিজেদের প্রতিষ্ঠানের মর্যাদার কথা চিন্তা না করে এ ধরনের কুকর্মে লিপ্ত হয়েছিলেন তাদেরও কঠোর শাস্তির মুখোমুখী করা উচিত।
তাদের সঙ্গে সঙ্গে যারা তৎকালীন সময়ে ওইসব কর্মকর্তাদের এ কাজের অনুমতি দিয়েছে, যাদের প্রশ্রয়ে ওইসব কর্মকর্তা এ ধরনের কুকর্ম করেছে তাদের বিষয়েও সর্বোচ্চ পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। মনে রাখতে হবে এহেন অপরাধীদের বিন্দুমাত্র ছাড় সমাজে খারাপ উদাহরণ সৃষ্টি করবে।
সর্বশেষে বলতে চাই, গণতন্ত্রে বহু মত কিংবা বহু পথের অস্তিত্ব থাকবে। এমনকি মত-দ্বিমত গণতান্ত্রিক রাজনীতির সৌন্দর্য হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু তাই বলে দেশের অস্তিত্ব হুমকির মুখে ফেলে, দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে কোনো রাজনীতি হতে পারে না। বাংলাদেশে রাজনীতি করতে হলে দেশের নিরাপত্তা ও দেশের স্বার্থকে সর্বাগ্রে বিবেচনায় নিয়েই রাজনীতি করতে হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও অ্যাকটিভিস্ট
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ