এই নিবন্ধটি লিখতে বসে নানারকম চিন্তা মাথায় খেলা করছিল। এই চিন্তার উদ্ভব পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে সংঘটিত অপরাধের জন্য জবাবদিহিতার অভাব সংক্রান্ত। আমি একজন যুক্তিবাদী মানুষ হিসেবে বিশ্বাস করি যে, এই ধরনের নিয়ম বহির্ভূত আচরণ যখন একাধিক্রমে ঘটতে থাকে তখন কেবল কোন সমাজ, দেশ এবং জাতি নয়, সারাবিশ্বই একের পর এক অমানবিক ঘটনা প্রত্যক্ষ করে। এই যে অপরাধ, এর নিকৃষ্টতম হলো হত্যা।
আমি এর আগেও বলেছি, আবারও বলছি, হত্যাই খুলে দেয় হত্যার দরজা। বেশি দূর যেতে হবে না।এই ধরনের অপকর্ম যেসব সমাজে ঘটেছে, সেখানকার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলেই বিষয়টি সম্বন্ধে জানতে পারব। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে আমরা পাকিস্তানের অদিবাসী ছিলাম। পাকিস্তান নাম অগণতান্ত্রিক স্বৈরতন্ত্রে যে অনাচার, অত্যাচার এবং হত্যা আমরা দেখেছি এসবই বাংলার মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের দিকে।
আমরা ছাব্বিশ মার্চ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেছিলাম এবং ষোল ডিসেম্বর যুদ্ধ জয় করেছিলাম। যে একটি বিষয়ে আমরা বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে সঙ্গে নিশ্চিত হয়েছিলাম, সেটি হলো যে আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় চার নীতি যথা- গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র এবং জাতীয়তাবাদকে হাতিয়ার করে একটি সুস্থ, স্বাভাবিক গণমুখী দেশ প্রতিষ্ঠিত করলাম।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ লাখ মানুষের আত্মাহুতি এবং অগুণিত নারীর সম্ভ্রমহানির পর আবারও মানুষের মৌলিক অধিকার এবং জীবনের অধিকার লঙ্ঘিত হবে সেটা আমরা কল্পনাও করিনি। অথচ সেই ঘটনাটিই ঘটেছিল। বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছিল পনের আগস্ট, ১৯৭৫। সেই সঙ্গে এ ঢাকা শহরেরই বিভিন্ন স্থানে তার পরিবারের এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের আরও অনেক মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়।
এই হত্যাকাণ্ড, আপাতদৃষ্টিতে কিছু উচ্ছৃঙ্খল সেনা কর্মকর্তার দ্বারা সংঘটিত বলে মনে হলেও আসলে এটি ছিল সুচিন্তিত, সুদূরপ্রসারী এবং তাৎপর্যপূর্ণ একটি ষড়যন্ত্র। আমরা জানি যে ১৬ ডিসেম্বর থেকেই বাংলাদেশ-বিরোধী শক্তি আমাদের দেশের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করে পাকিস্তানি মূল্যবোধ সম্পৃক্ত একটি দেশের পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য ষড়যন্ত্র শুরু করেছিল। বঙ্গবন্ধু হত্যা সেই ষড়যন্ত্রেরই অংশবিশেষ।
ভাবতে অবাক লাগে যে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত একের পর এক যেসব সরকার আমাদের দেশের ক্ষমতা দখল করেছে তারা কেউ এই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডের বিচার তো করেইনি বরং হয় এর প্রত্যক্ষ অনুমোদন দিয়েছে এবং হত্যাকারীদের পুনর্বাসন করেছে নতুবা পরোক্ষভাবে হত্যার পক্ষে যায় এমন সব পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
তবে কি এ-ই বলে ধরে নিতে হবে যে আমাদের বিজয় দিবস থেকে যে চক্রান্ত শুরু হয়েছিল, এক ভয়াবহ স্বাধীনতা বিরোধী চক্রান্ত, তার সঙ্গে এসব সরকারের সংশ্লিষ্টতা ছিল? যদি বলি এ ধরনের সংশ্লিষ্টতার জন্য ওই সব সরকারগুলো বাংলাদেশ-বিরোধী অনেক কাজ করেছে তাহলে কি বাড়িয়ে বলা হবে?
সেই ৫২ সালের রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন দিয়ে শুরু করে বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা আন্দোলন, বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক ১১-দফা আন্দোলন এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান এই সকলেরই লক্ষ্য ছিল বাঙালির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা। অতএব, ১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিপুল বিজয়ের পর থেকেই আমরা আবহাওয়ায় স্বাধীনতার গন্ধ পাচ্ছিলাম। সেই কারণেই ’৭১-এর সাত মার্চে রমনার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন মুক্তির কথা, স্বাধীনতার কথা। এই ইঙ্গিতই যথেষ্ট ছিল সকল বাঙালির জন্য।
আমরা দেখতে পাই যে, পঁচিশ মার্চ কালরাত্রিতে ঢাকার নিরস্ত্র জনগণের ওপরে যখন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সকল নৃশংসতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তখন একদিকে যেমন পাকিস্তানের ভাবী প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেছিল, ‘আল্লাহ পাকিস্তানকে রক্ষা করেছে’, আরেকদিকে পূর্বে পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় সকল মানুষ বঙ্গবন্ধুর আহবান অনুযায়ী ‘যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নেমে পড়েছিল।
সেই যুদ্ধে বাঙালি সেনাবাহিনীর সদস্যরা স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে শরিক হয়েছিল। এই বাঙালি কখনই জাতির পিতার রক্তে নিজ হাত রঞ্জিত করতে পারে না। যারা এই জঘন্য কাজটি করেছিল এবং পরবর্তীতে এই নৃশংস হত্যার বিচার করেনি তারা অবশ্যই বাংলাদেশ-বিরোধী ছিল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পরে সবচেয়ে খুশি হয়েছিল জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং তড়িঘড়ি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছিল। সেটা কোন বাংলাদেশ ছিল?
সেই বাংলাদেশ, যা একটি অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ নয় বরং পাকিস্তানের আদলে সাম্প্রদায়িক, সন্ত্রাসী এক বাংলাদেশ। এই কারণে বঙ্গবন্ধুকে যারা হত্যা করেছিল তাদেরকে পুরস্কৃত করেছিল নব্য বাংলাদেশের ধারক এবং বাহক এক সরকার। এরা সক্রিয়ভাবে চেষ্টা করেছে বঙ্গবন্ধুকে নতুন প্রজন্মের হৃদয় থেকে নির্বাসিত করতে। তার ভাবমূর্তিকে বিনষ্ট করতে। এক কথায় বাংলাদেশের মুক্তিকে অস্বীকার করতে।
মনে পড়ে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক নির্বাচনের পর আমার এক পরিচিতজন আমাকে কথাচ্ছলে বলেছিল, ‘দেখ কী গণতন্ত্রমনা মার্কিন নেতারা! শত বিরোধিতা করলেও ওবামার জয়ে ম্যাককেইন ঠিকই তাকে অভিনন্দন জানায়।’ আমি তাকে জবাবে বলেছিলাম, ‘এটাই স্বাভাবিক। কেননা রাজনৈতিক মতপার্থক্য থাকলেও ওবামা এবং ম্যাককেইন কতগুলো মৌলিক বিষয়ে দ্বিমত নয়। তারা দু’জনেই বিশ্বাস করে যে তারা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে স্বাধীন হয়েছে। তারা দু’জনেই বিশ্বাস করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতির পিতা জর্জ ওয়াশিংটন। তারা দু’জনেই বিশ্বাস করে তাদের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে।’
আমাদের দেশটিকেও আমরা একটি উপনিবেশবাদ থেকে স্বাধীন করেছি। আমাদেরও একটি স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র আছে যা ১৭ এপ্রিল, ১৯৭১-এ মেহেরপুরের বৈদ্যনাথ তলায় পাঠ করা হয় এবং যার মাধ্যমে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়। আমাদেরও একজন জাতির পিতা আছেন যার নেতৃত্বে আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম এবং স্বাধীনতা লাভ করেছিলাম।
কিন্তু সেই জাতির পিতার নৃশংস হত্যার পরে গঠিত সরকারসমূহ ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত ইতিহাসের এসব সত্যগুলোকে অস্বীকার করে এসেছে। কিন্তু কথায় আছে, ‘ধর্মের কল বাতাসে নড়ে।’ তাই অতিবিলম্বে হলেও শত চক্রান্তকে পরাজিত করে আজ সত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
যতদিন নির্যাতিত, নিপীড়িত মানুষের সংগ্রামের কথা ইতিহাসের পাতায় পাতায় লেখা হবে ততদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে থাকবেন সব মুক্তিকামী মানুষের অন্তরে। পনের আগস্ট বঙ্গবন্ধুর প্রয়াণ দিবস। বাঙালির কাছে ওই দিনটি একটি কৃষ্ণ দিবস। নির্মমভাবে আমাদের জাতির পিতাকে, তার অতি আপনজনদের হত্যা করেছিল নব্য পাকিস্তানি চক্র। কিন্তু যে কারণে তাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছিল, অর্থাৎ বাংলাদেশকে বিপদগামী করে আবারও একটি সাম্প্রদায়িক স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করা, সেই উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে পারেনি কুচক্রীরা। বাংলার মানুষ রুখে দাঁড়িয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর কাছে প্রতিটি বাংলাদেশির যে ঋণ তা শোধ করতে পারি আমরা কেবল মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধকে সম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত করে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করে এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনায় গণতন্ত্রকে চিরায়ত করে। কেবল তাহলেই তার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শন করা সম্ভব হবে আমাদের পক্ষে।
(লেখাটি ইতিহাসের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু গ্রন্থ থেকে নেয়া)
লেখক: বাংলাদেশী অভিনেতা, ব্যবসায়ী ও কলামিস্ট। তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি পুরস্কার, বঙ্গবন্ধু পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী পদকসহ বিভিন্ন পুরস্কার লাভ করেছেন।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ