গেল শুক্রবার হঠাৎই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে গণভবনে সপরিবারে সাক্ষাৎ করেন কাদের সিদ্দিকী বীরউত্তম। এ নিয়ে ইতোমধ্যেই ডাল-পালা মেলছে নানা গুঞ্জন। রাজনৈতিক অঙ্গনে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা, চলছে হিসাব-নিকাশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে আওয়ামী লীগের বড় সমালোচকের ভূমিকায় থাকা কাদের সিদ্দিকীর হঠাৎই গণভবনে গমন এবং আ’লীগ সভানেত্রীর সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকে রাজনীতিতে নয়া মেরুকরণের আভাস হিসেবেই দেখছেন রাজনৈতিক বোদ্ধারা। তবে কি ক্ষমতাসীনদের সঙ্গেই ভিড়ছেন কাদের সিদ্দিকী নাকি জাতীয় পার্টির সঙ্গে মিলে ‘বিশ্বস্ত বিরোধী দল’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হচ্ছে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ-এমন প্রশ্ন এখন সর্বমহলে।
মুক্তিযুদ্ধ-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে আ’লীগের রাজনীতিতে ওতপ্রোতভাবে জড়িত থাকা কাদের সিদ্দিকী ১৯৯৯ সালে দল ত্যাগ করে গঠন করেন কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। আত্মপ্রকাশের পর থেকে এখন পর্যন্ত তিনিই এই দলের সভাপতি। গত নির্বাচনের আগে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে বিএনপি-গণফোরাম ও কয়েকটি দলের সমন্বয়ে গঠিত হওয়া ঐক্যফ্রন্টেও যোগ দিয়েছিল কাদের সিদ্দিকীর দল। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি ঋণ সংক্রান্ত জটিলতায় নির্বাচনে অংশ নেয়া নিয়ে তৈরি হয়েছিল অনিশ্চয়তা-যা সে সময় দেশের সর্বোচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কাদের সিদ্দিকী ওই নির্বাচনে অংশ নিতে না পারলেও, তার দল থেকে ঐক্যফ্রন্টের মনোনয়নে টাঙ্গাইল-৮ (সখীপুর-বাসাইল) আসনে কন্যা ব্যারিস্টার কুঁড়ি সিদ্দিকী, গাজীপুর-৩ আসনে যুগ্ম সম্পাদক প্রিন্সিপাল ইকবাল সিদ্দিকী ও টাঙ্গাইল-৪ (কালিহাতী) আসনে ইঞ্জিনিয়ার লিয়াকত আলী ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন।
তবে ওই নির্বাচনের কিছুদিন পরেই ঐক্যফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে আসে কাদের সিদ্দিকীর দল। এমনকি ভেঙে যায় ঐক্যফ্রন্টের ‘ইমাম’ খ্যাত ড. কামাল হোসেনের নিজ দল গণফোরামও। নানা অভিযোগ তুলে কামাল হোসেনের দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক সহযাত্রী মোস্তফা মহসিন মন্টু ও সুব্রত চৌধুরীরা কামাল হোসেনকে বাদ দিয়েই গড়ে তোলেন ‘নতুন’ গণফোরাম। আমেরিকা থেকে দেশে ফিরে গণফোরামের রাজনীতিতে যুক্ত হওয়া সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এএমএস কিবরিয়ার ছেলে রেজা কিবরিয়াও ‘গণফোরাম গণমুখী দল নয়’ বলে বেরিয়ে যান। পরে ডাকসুর সাবেক ভিপি নূরের সঙ্গে মিলে গড়ে তোলেন গণঅধিকার পরিষদ নামে নতুন রাজনৈতিক প্লাটফর্ম। এসব কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কিছুদিন পর থেকেই মূলত অকার্যকর হয়ে পড়ে ঐক্যফ্রন্ট। রাজনৈতিক অঙ্গনে ঐক্যফ্রন্ট আবেদন হারালেও সাম্প্রতিক বছরগুলোতে নানাভাবে আলোচনায় ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। বিভিন্ন সময়ে আ’লীগ ও সরকারের নানা কর্মকাণ্ডের তীব্র সমালোচনায় সরব ছিলেন। এরপর করোনাকালে রাজনীতির ময়দানে খুব একটা সক্রিয় দেখা যায়নি তাকে। প্যানডেমিকের পরে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়ে ফের আলোচনায় আসেন তিনি। পিত্তথলিতে পাথরসহ শারীরিক নানা জটিলতায় বেশ কিছুদিন হাসপাতালে ভর্তি থাকেন কাদের সিদ্দিকী। তখন তাকে দেখতে হাসপাতালে ছুটে যান সরকারের একাধিক মন্ত্রীসহ আ’লীগ-বিএনপির অনেক হেভিওয়েট নেতা। হাসপাতাল থেকে ফিরে গত আগস্টের শেষ দিকে টুঙ্গিপাড়ায় জাতির জনকের কবর জিয়ারতের মাধ্যমে ফের রাজনীতিতে সরব হন কাদের সিদ্দিকী।
দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনীতি যখন সরগরম, তখন আ’লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলনের আগের দিন শেখ হাসিনার সঙ্গে তার একান্ত সাক্ষাৎকে রাজনীতিতে নতুন মেরুকরণ হিসেবেই দেখছেন বিশ্লেষকরা। গত আগস্টে জাতীয় পার্টির সঙ্গে দীর্ঘ বৈঠক করে কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। এরপর বছরের শেষে এসে দীর্ঘ বিরতি ভেঙে গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক। এই সমীকরণে একাধিক সূত্র দাবি করছে, জাতীয় পার্টির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সংসদে ‘বিশ্বস্ত বিরোধী দল’-এর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারে কাদের সিদ্দিকীর কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ। বিশ্বস্ত আরেকটি সূত্র জানায়, দীর্ঘদিন পরে হলেও শেখ হাসিনা-কাদের সিদ্দিকীর সম্পর্কের বরফ গলতে শুরু করেছে। এর ধারাবাহিকতায় ক্ষমতাসীনদের সঙ্গে ভিড়তে পারেন কাদের সিদ্দিকী। তবে, ব্যক্তি কাদের সিদ্দিকীর আ’লীগে ফেরার সম্ভাবনা নেই। ক্ষমতাসীন দল জোটের কলেবর বাড়ালে সেখানে জায়গা পেতে পারে কাদের সিদ্দিকীর দল। এসব গুঞ্জন সম্পর্কে জানতে চাইলে কাদের সিদ্দিকী বলেন, ‘যে কেউ স্পেকুলেশন করতে পারে। আমার কিছু বলার নেই। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আমাকে ডেকেছেন, তাই কারণটা তার কাছ থেকেই জেনে নেওয়া ভালো।’ তিনি আরও বলেন, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
লেখক: সাংবাদিক
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ