আজ মায়ের ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী। ২০০৬ খ্রিস্টাব্দের ২৫ ডিসেম্বর সবার মায়া ত্যাগ করে তিনি এই পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। পৃথিবীতে প্রতিটি সন্তানের নিকট মা পরম আরাধ্য। আমার জীবনেও মা প্রিয় মানুষ, শ্রেষ্ঠ সম্পদ। মায়ের স্নেহ-আদর আর মমতায় বড়ো হয়েছি। মায়ের স্নেহরাজি আজও অন্তরে প্রবহমান। মায়ের পবিত্র মুখখানি যখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে, মনে হয়, এক্ষুনি মায়ের কাছে ছুটে যাই। জন্মলগ্ন থেকে পরিণত বয়স পর্যন্ত প্রতিটি ধাপে মা যত্ন করে আমায় গড়ে তুলেছেন। মা ছাড়া এক মুহূর্তও থাকতে পারতাম না। শৈশব আর কৈশোরের সেই দিনগুলোর কথা ভাবলে দু’চোখ ভিজে যায়। প্রতিবার নির্বাচনী জনসংযোগে যাবার প্রাক্কালে কাছে টেনে পরম আদরে কপালে চুমু খেয়ে প্রাণভরে দোয়া করতেন মা। মমতাময়ী মায়ের সেসব কোমল স্মৃতি খুব মনে পড়ে।
প্রতি বছর ভোলায় গ্রামের বাড়িতে বাবা-মায়ের মৃত্যুবার্ষিকী পালন করে তাদের স্মরণ করি। আমার বাবার নাম আজহার আলী, মা ফাতেমা খানম। আমি দাদা-দাদি, নানা-নানিকে দেখিনি। মা ১৯১৪ সনে জন্মগ্রহণ করেন। মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তান আমি। বাবা-মায়ের সুখের সংসার। তিন ভাই, চার বোনের মধ্যে আমার অবস্থান পঞ্চম। বিদ্যালয় জীবনের সূচনাতে নিজ বাড়িতে থেকে গ্রামের একটি প্রাইমারি স্কুল কোড়ালিয়া ফ্রি প্রাইমারি স্কুলে লেখাপড়ায় হাতেখড়ি। এরপর বাড়িতে থেকেই খায়েরহাট জুনিয়র হাই স্কুল থেকে ষষ্ঠ শ্রেণি পাস করে বোরহানউদ্দিন হাই স্কুলে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হই। প্রাইমারি এবং জুনিয়র স্কুলের পরীক্ষায় প্রতিটি বিষয়ে ভালো নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করতাম। আজকাল গ্রামে উপজেলায় অনেক হাইস্কুল হয়েছে। তখনকার দিনে এত হাইস্কুল ছিল না। আমাদের এলাকা বোরহানউদ্দিনে একটি মাত্র হাইস্কুল ছিল, সেখানে ভর্তি হই। বোরহানউদ্দিন হাই স্কুলে আমাকে কষ্ট করে লেখাপড়া করতে হয়েছে। সেকালে আমাদের গ্রাম অনুন্নত ও অন্ধকারে নিমজ্জিত ছিল। স্কুলে তখন কোন হোস্টেল ছিল না। সেই ছোট্টকালেই যখন আমার বয়স মাত্র ১৩, তখন আত্মীয়-স্বজন এবং শুভানুধ্যায়ীর বাড়িতে থেকে পড়ালেখা করতে হয়েছে। কষ্ট হলেও মা আমাকে আদর করে লেখাপড়ায় নিয়মিত উৎসাহ জোগাতেন। সপ্তম শ্রেণির পরীক্ষা শেষে যখন অষ্টম শ্রেণিতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি, সে সময় আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক মান্নান স্যার বললেন, ‘ভোলা সরকারি হাই স্কুলে অষ্টম শ্রেণিতে চারটি আসন খালি আছে, তুমি ভালো ছাত্র, পরীক্ষা দাও।’ ১৯৫৭’র জানুয়ারি মাসে ভোলা সরকারি স্কুলে ভর্তি হই এবং স্কুল হোস্টেলে থাকতে শুরু করি। শুরু হয় হোস্টেলে থেকে লেখাপড়ার পালা। স্কুল, কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে মোট ১৪টি বছর আমি হোস্টেলে ছিলাম। মা আমাকে আদর করে ‘মনু’ বলে ডাকতেন। সবসময় বলতেন, ‘মনু, মনোযোগ দিয়ে লেখাপড়া করো।’ মায়ের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করতাম। মা-কে ছেড়ে জীবনের প্রথম হোস্টেল জীবন। মন পড়ে থাকতো মায়ের কাছে। প্রতি সপ্তাহে ছুটির আগের দিন মায়ের কাছে চলে যেতাম।
১৯৬০ সনে ম্যাট্রিক পাশ করে ঢাকা কলেজে ভর্তি হই। কিন্তু মায়ের কাছ থেকে দূরে থাকতে হবে এটা ছিল বেদনাদায়ক। তখন ছোট্ট একতলা কাঠের লঞ্চে গ্রামের বাড়ি থেকে ঢাকা আসতে ২৪ ঘণ্টা লাগত। সেজন্য ঢাকা কলেজ ছেড়ে বরিশাল ব্রজমোহন কলেজে ভর্তি হই। ব্রজমোহন কলেজ থেকে সাপ্তাহিক ছুটিতে লঞ্চযোগে ভোলায় মায়ের কাছে একদিন থেকে ফিরে আসতাম। ব্রজমোহন কলেজে ছাত্রাবস্থায় ছাত্রলীগের সদস্য হিসেবে রাজনৈতিক জীবনের শুরু। তারপর ধাপে ধাপে অগ্রসর হয়ে যথাক্রমে ব্রজমোহন কলেজের ক্রীড়া সম্পাদক, পরে ইকবাল হলের (বর্তমানে শহিদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) ক্রীড়া সম্পাদক, তারপর মৃত্তিকা বিজ্ঞান বিভাগের ভিপি, হলের ভিপি, ডাকসুর ভিপি, ছাত্রলীগের সভাপতি, এরপর ’৭০-এর ২ জুন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ও জাতীয় নেতৃবৃন্দের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগে যোগদান।
মা এবং মাতৃভূমি আমার কাছে সমার্থক। মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ভারতের দেরাদুনে মুজিববাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্পে বক্তৃতায় আমরা বঙ্গবন্ধুকে উদ্দেশ করে বলতাম, ‘প্রিয় নেতা, তুমি কোথায় আছো, কেমন আছো জানি না! যতদিন আমরা প্রিয় মাতৃভূমি তোমার স্বপ্নের বাংলাদেশকে হানাদার মুক্ত করতে না পারব, ততদিন মায়ের কোলে ফিরে যাব না।’ সেদিনের সেই শপথও আমরা জীবনবাজি রেখে বাস্তবায়ন করে দেশমাতৃকাকে শত্রুমুক্ত করেছি। যুদ্ধ শেষে বিজয়ীর বেশে আমি ও রাজ্জাক ভাই ১৮ ডিসেম্বর এবং স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ ২২ ডিসেম্বর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করে। আর ২৮ ডিসেম্বর ভোলায় গ্রামের বাড়িতে অবস্থানরত আমার পরম শ্রদ্ধেয় জননীর কোলে ফিরে আসি।
আমার বড় ভাই ’৭৫-এর ১১ জুলাই মৃত্যুবরণ করেন। বড় ভাই যখন হলি ফ্যামিলি হাসপাতালে, মা তখন অসুস্থ। আমাকে বলেছিলেন মাকে দেখতে চাইলে তাড়াতাড়ি চলে এসো। আমি গিয়েছিলাম। মা বেঁচে গিয়েছিলেন। কিন্তু বড় ভাই মায়ের আগেই মৃত্যুবরণ করেন। সংবাদ পেয়ে বঙ্গবন্ধু আমার তৎকালীন সরকারি বাসভবনে এসে আমাকে আদর করে সান্ত্বনা দিয়েছিলেন। আমার ভাইয়ের জানাজায় অংশগ্রহণ করে মৃতদেহ তিনি হেলিপ্যাডে নিয়ে হেলিকপ্টারে করে ভোলায় প্রেরণের ব্যবস্থা করেন। সে সময় যতদিন ভোলায় ছিলাম ১২ থেকে ৩০ জুলাই প্রতিদিন বঙ্গবন্ধু আমার খবর নিতেন। তখন টেলিফোন সহজলভ্য ছিল না। থানার টেলিফোনে নির্ধারিত সময়ে অর্থাৎ সকাল ১১টায় আমাকে থাকতে বলেছিলেন। বঙ্গবন্ধু প্রতিদিন ফোন করে আমার খোঁজ নিতেন।
’৭৫-এ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর আমি ৩৩ মাস ময়মনসিংহ ও কুষ্টিয়া কারাগারে বন্দি ছিলাম। সাবেক রাষ্ট্রপতি হোসাইন মোহাম্মদ এরশাদ ক্ষমতায় এলে ’৮৩-এর ১৫ ফেব্রুয়ারি আমাকে গ্রেফতার করে প্রথমে সেনানিবাসে পরে সিলেট কারাগারে প্রেরণ করে। সিলেট কারাগারে গিয়ে মা আমার সঙ্গে দেখা করেছেন। সেদিন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ আমাদের ৪০ জনকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর ’৮৪-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে সাভার স্মৃতিসৌধে গ্রেফতার করা হয়। ’৮৫তে আমাকে গ্রেফতার করে ১৫ দিন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে রেখে পরে কুমিল্লা কারাগারে দীর্ঘদিন বন্দি করে রাখা হয়। ’৮৭তে ভোলা থেকে গ্রেফতার করা হয়। আমি তখন সংসদ সদস্য। গ্রেফতার সংবাদে বিক্ষুব্ধ জনতা রাস্তায় নেমে এলে আমাকে এক ঘণ্টার মধ্যে বরিশালে কারাগারে একটি নির্জন কক্ষে বন্দি করে রাখা হয়। ’৯৬-এ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে আমাকে গ্রেফতার করে রাজশাহী কারাগারে পাঠানো হয়। ২০০১-এর নির্বাচনের পর বিএনপি-জামায়াত সরকার ভোলায় আমার গ্রামের বাড়িতে তাণ্ডব চালায়। আমার গাড়ি ভাংচুর করে। বৃদ্ধ বয়সে আমার মাকে এসব দেখতে হয়েছে। ২০০২-এ সিঙ্গাপুর থেকে চিকিৎসা শেষে যখন ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করি, তখন আমাকে গ্রেফতার করে এক রাত ক্যান্টনমেন্ট থানায় রেখে পরে কাশিমপুর কারাগারের সেখানে রাখা হয়, যেখানে ফাঁসির আসামি কুখ্যাত এরশাদ শিকদারকে রাখা হয়েছিল। আমার পাশেই অন্তরীণ আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দীন নাছিম। পরে আমাকে কুষ্টিয়া কারাগারে প্রেরণ করা হয়। ২০০২-এ মায়ের বয়স তখন ৮৮ বছর। অসুস্থ শরীরে বৃদ্ধ বয়সে মা আমাকে দেখতে কুষ্টিয়া কারাগারে ছুটে গিয়েছেন। এক নজর মায়ের মুখখানি দেখে মনে অনাবিল শান্তি অনুভব করেছি। কাশিমপুর থেকে কুষ্টিয়া কারাগারে যাত্রাপথে গোয়ালন্দ ফেরিঘাটে একটি পতাকাবাহী গাড়ি দেখি। যে গাড়িটি ছিল জামায়াত নেতা ও খালেদা জিয়া সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মুজাহিদের। তার গাড়িতে পতাকা, আর আমার হাতে হাতকড়া। স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বমোট ৭ বার আমাকে গ্রেফতার করা হয়েছে এবং প্রত্যেকটি কারাগারে আমার বৃদ্ধ মা ছেলেকে দেখার জন্য ছুটে গিয়েছেন। সে কি কষ্ট! জেলগেটে যখন মা আমার সঙ্গে দেখা করতেন সর্বক্ষণ আমার মাথাটা মায়ের বুকে থাকত। যখন তিনি আমাকে রেখে বিদায় নিতেন, তখন তার দু’চোখে অশ্রুর নদী। দুই ছেলে মৃত্যুবরণ করেছে, এক ছেলে কারান্তরালে। কি নিঃস্ব রিক্ত আমার মা!
সেই কঠিন দিনগুলোর কথা স্মৃতির পাতায় ভেসে ওঠে। মায়ের স্মৃতিকে আমি ধরে রাখতে চাই। বাবা-মায়ের নামে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে মায়ের স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে চাই। জীবনে স্বপ্ন ছিল বৃদ্ধাশ্রম করার। যেখানে আমার মায়ের মতো মায়েদের সেবা-শুশ্রূষা করতে পারব। মা ছিলেন ধর্মপরায়ণ, যিনি সর্বদাই অপরের কল্যাণের কথা ভাবতেন। গ্রামের বাড়িতে আত্মীয়-স্বজন প্রতিবেশী যে কারও দুঃখে তিনি ছুটে যেতেন। সাধ্যমতো সাহায্য করতেন। আমাকে সবসময় বলতেন, ‘তুমি একা বড় হতে পারো না। সবাইকে সঙ্গে করেই তোমাকে এগিয়ে যেতে হবে।’ মা সুখে-দুঃখে আমায় ছায়া দিতেন বটবৃক্ষের মতো। ’৯৬-এ সরকার গঠনের পর আমি তখন শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী। বেইলি রোডে অবস্থিত বাসভবন ‘তন্ময়’-এ থাকি। মা আমার সঙ্গেই থাকতেন। প্রতিদিন মায়ের আদর নিয়ে দিনের কাজ শুরু করতাম। বনানীর যে বাসায় এখন থাকি এই বাসাতে আমার শয়ন কক্ষের পাশেই মায়ের ঘর। সকালে ঘুম ভাঙার পর মায়ের স্নেহের আলিঙ্গন ছিল নিত্যদিনের পাথেয়। মাকে চুমু দিয়ে সকালে বের হতাম। আমি না ফেরা পর্যন্ত মা জানালার কাছে তিবহ হাতে নিয়ে পথের দিকে তাকিয়ে থাকতেন কখন ফিরব। ঘরে প্রবেশ করেই মাকে চুমু দিয়ে শয়নকক্ষে যেতাম। আমার বন্ধু-বান্ধব-স্বজন প্রত্যেককেই মা অন্তর থেকে ভালোবাসতেন। মা আমার জীবনে অনুপ্রেরণার নিরন্তর উৎস হয়ে সদা বিরাজমান। মা যখন অসুস্থ তখন প্রত্যেকেই তার সেবা-শুশ্রূষা করেছেন। মৃত্যুর দু’দিন আগে আমি যখন নিজ হাতে মাকে খাওয়াচ্ছি তখন তিনি ব্যথায় খুব কষ্ট পাচ্ছিলেন। যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় মা আমায় বলেছিলেন, ‘তুমি কী আমাকে মরতে দেবে না?’ আমি বলেছিলাম, মা আপনি যদি মৃত্যুবরণ করেন তখন আমাকে দোয়া করবে কে? মা আমায় বলেছিলেন, ‘তোমাকে আমি আল্লাহ্র কাছে রেখে গেলাম। আল্লাহ্ই তোমাকে হেফাজত করবেন।’ এটাই ছিল মায়ের সঙ্গে আমার শেষ কথা।
লেখক: আওয়ামী লীগ নেতা, সংসদ সদস্য, সভাপতি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ।
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ