ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফেলে আসা শৈশবের গল্পে হারিকেন ও কু‌পিবা‌তি 

প্রকাশনার সময়: ২২ অক্টোবর ২০২২, ১৭:০০

হারিকেন ও কু‌পিবা‌তি ছিল গ্রামীণ ঐতিহ্যের আলোর দিশারী। এই আলোয় ছিল অন্ধকার দূর করার অবলম্বন। এই আলোর মিছিলে রাতে হাট করে বাড়ি ফিরত বণিক। দূরের পথিক হেঁটে যেত শব্দের পথ ধরে আর ছায়ার ছবি এঁকে। ঘরের কাজ করত গৃহিণী, পানের বাটা নিয়ে বসত বাড়ির বৃদ্ধা, গোল হয়ে বসে একটানা শব্দ করে পড়ত জীবনের শৈশব। পড়ার মিহি সুর আর লাল আলোর সঙ্গে যুৎসই রেখে নেচে উঠত জোনাকির দল।

কুপিবাতি ও হারিকেনের কেরোসিন তেল আনতে বাড়িতে ছিল বিশেষ ধরনের কাচের বোতল। সেই বোতলের গলায় রশি লাগিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হতো বাঁশের খুটিতে অথবা মা‌টির দেয়া‌লে। এ দৃশ্য এখন আর চোখে পড়ে না। প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় এসবই হারিয়ে যাচ্ছে গ্রামীণ জনপদ থেকে। হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের স্মৃতি-বিস্মৃতির গুদামঘর।

বর্তমানে হারিকেন ও কুপিবাতির পরিবর্তে স্থান করে নিয়েছে পল্লী বিদ্যুৎ ও সোলার প্ল্যান্ট এবং চার্জার লাইট। সমাজের বিবর্তনে আর আধুনিকতার ছোঁয়ায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য কুপিবাতি ও হারিকেন। প্রতিদিনই এসব অতীত স্মৃতিতে পরিণত হয়ে হচ্ছে। আমরাও ভুলে যাচ্ছি সেসব সোনালি দিনের কথা। গোল হয়ে পাঠের সেই শৈশব। পরবর্তী প্রজন্ম হয়তো জানবেই না এই পাড়া-মহল্লায় একদিন লাল আলোর ঝলক ছিল।

মুক্তিযুদ্ধ ঘিরে আছে কুপিবাতি আর হারিকেনের স্মৃতি। যুদ্ধের সময় ক্যাম্পে চলাচলের জন্য কুপিবাতি ও হারিকেন ব্যবহার হ‌তো। ডাকপিয়নও রাতেরবেলা হারিকেনের আলোয় পত্র নিয়ে ছুটে বেড়াত এদিক-সেদিক। রিকশাওয়ালাও টুং টাং শব্দ করে মায়াবী আলোর রেখা টেনে মিশে যেত অন্ধকারে। দূর থেকে মনে হতো পথ বেয়ে চলে যাচ্ছে আকাশের সন্ধ্যাতারা।

কুপিবাতি ও হারিকেনগুলো ছিল বাহারি নকশার। এর মধ্যে মাটি, লোহা, কাঁচের বোতল আবার পিতলের তৈরি কুপিও ছিল। বর্তমানে বিদ্যুতায়নের ফলে সব কিছুর সুবিধা নিচ্ছে গ্রামীণ জনপদের বাসিন্দারা। এখন দিনের বেলায়ও আলো জ্বালাতে হয়। হাত পাখার বদলে বৈদ্যুতিক পাখা ও এয়ারকন্ডিশন ব্যবহার করা হচ্ছে।

গ্রাম বাংলার আপামর লোকের কাছে কুপি ও হারিকেনের কদর হারিয়ে গেলেও এখনও অনেকে আঁকড়ে ধরে আছেন কুপি ও হারিকেনের স্মৃতি। এখনো পোলট্রি ফার্মের ছোট্র বাচ্চাদের তাপ দেওয়ার জন্য হারিকেন ব্যবহার করা হয় কিছু খামারে।

হারিকেনের আলোয় শৈশব এখনো জ্বলজ্বল করে ওঠে চোখে। যখন আমরা সবাই গ্রামে ছিলাম তখন হারিকেনের আলোই ছিল আমাদের একমাত্র ভরসা। হারিকেন এই শব্দের সঙ্গে কত মায়া আর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। কত প্রেম লুকিয়ে আছে।

ফেলে আসা সেই দিনগুলোই সন্ধ্যা থেকেই গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে শুরু হতো হারিকেন নিয়ে আয়োজন! মা ডাক দিয়ে বলতেন, ‘সলতেটা (হারিকেনের ফিতা) ঠিক আছে তো?’ দাদু হাক ছেড়ে বলতেন, ‘চিমনিটা (কাঁচের তৈরি) কালো হয়ে আছে কি ? একটু পরিস্কার কর না ভাই।’ বাবা বলতেন, কি গো, খোকার মা, হারিকেনে তেল আছে তো? নাকি বাজার থেকে আবার কেরোসিন আনতে হবে?’

সেই হারিকেন ঘিরে ছোট মুখগুলো পড়তে বসতাম। আলোর খেলা নিয়ে ঝগড়া হতো ভাইবোনের সঙ্গে। হারিকেন নিয়ে ছুটে যেতাম আড়ালে। আহ্, কী মধুর ছিল সেই শৈশব।

পরীক্ষার সময়ে গভীর রাত পর্যন্ত হারিকেনের লালচে আলোয় পড়া হতো। হারিকেনের আলোয় ছায়া পড়ত ঘরের পুরোনো দেয়ালে। সে এক লম্বা ছায়া। আমরা ছেলেবেলায় হারিকেনের আলো-আঁধারি মিষ্টি আলোতে হাতের আঙুলগুলো বিভিন্ন রকম কসরত করে দেয়ালের তার প্রতিবিম্ব ফুটিয়ে ছায়াছবি তৈরি করতাম। অবাক কান্ড সেই হাতের আঙুলগুলো কখনো কখনো তোতা পাখির মুখ, কখনো ছাগলের মাথা, কখনো উড়ন্ত পাখি হয়ে যেত। আর হারিকেন নিয়ে এ স্মৃতিমন্থর লেখার কি অন্ত আছে ? গেয়ে ওঠি-

পুরানো সেই দিনের কথা

ভুলবি কিরে হায়

ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা

সে কি ভোলা যায়

পুরানো সেই দিনের কথা

ভুলবি কি রে হায়

ও সেই চোখের দেখা প্রাণের কথা

সে কি ভোলা যায়।...

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ