সেনাবাহিনীর চাকরি থেকে অবসরের পর অনেকেই বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি করেন। কেউবা পেনশন নির্ভর হয়ে বেকার থাকেন, আবার কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমান। তবে অবসরের পর ব্যতিক্রমী উদ্যোগে একজন সফল উদ্যোক্তা হয়েছেন রবিউল হোসেন।
চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড উপজেলার সৈয়দপুর ইউনিয়নের বাকখালী গ্রামের শফিউল্লাহর ছেলে রবিউল হোসেন। তিনি ওয়ারেন্ট অফিসার থেকে ২০২০ সালের ৩ জুলাইয়ে অবসরে যান। এরপর ৪ বছর ধরে তিনি নিজের স্বপ্নের গরুর খামার গড়ে তোলেন। দিনরাত কঠিন পরিশ্রমের বিনিময়ে গরুর খামারে সফলতা পেয়েছেন রবিউল। বর্তমানে তার বছরে আয় প্রায় ৪৫ লাখ টাকা। এতে খরচ হয় প্রায় ৩০ লাখ।
২০২০ সালের ২২ আগস্ট শাহিওয়াল জাতের মাত্র দুটি গরু নিয়ে একটি ছোট গরুর খামার শুরু করেন। পরে তিনি ধীরে ধীরে ঢাকার সাভার এলাকা থেকে আরও ১৫টি গরু সংগ্রহ করেন। এসব গাভী থেকে ধারাবাহিক প্রজননের মাধ্যমে খামারে গরুর সংখ্যা বাড়তে থাকে। বর্তমানে খামারে ৪২টি গরুর মধ্যে ২০টি বিক্রি হয়েছে।
জানা যায়, রবিউল হোসেন এক ছেলে ও দুই মেয়ে এবং স্ত্রীকে নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় বসবাস করছেন। পরিবার ঢাকায় বসবাস করলেও তিনি কঠোর পরিশ্রম করে নিজ গ্রাম বাকখালীতে গড়ে তোলেন এই গরুর খামার।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ১০ শতক জমির ওপর নির্মিত এগ্রোর প্রবেশ পথের ডান পাশে রয়েছে একটি টিনের শেড এবং ভিতরে রয়েছে আরও একটি বড় টিনের শেড ঘর। শেডের ভেতরে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয়েছে আলাদা আলাদা দুগ্ধজাত গাভী ও ষাঁড়ের বাসস্থান। খামারের ভেতর-বাইরে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। মশা-মাছি আর পোকামাকড় প্রতিরোধেরও ব্যবস্থা রয়েছে।
গরুর খামারে দেখা যায়, রবিউলের খামারে শাহিওয়াল, নেপোলিয়ন, হোলস্টেইন ফিজিয়ান, অস্ট্রেলিয়ান ফিজিয়ানসহ উন্নত জাতের গরু রয়েছে। যেখানে ১৬টি দুগ্ধজাত গাভী, ১২টি বড় ষাঁড়, ২টি বলদ এবং ৬টি বকনা বাছুর রয়েছে। যার আনুমানিক বাজার দাম এক কোটি টাকার বেশি। গাভী থেকে প্রতিদিন ৯০-১০০ লিটার পর্যন্ত দুধ পাওয়া যায়। এসব দুধ প্রতিদিন বিভিন্ন ডেইরি প্রসেসিং কোম্পানি ও মিষ্টির দোকানে সরবরাহ করা হয়।
এ ছাড়া গরুর দুগ্ধ খামারের পাশাপাশি রয়েছে ছাগলের খামারও। যেখানে দেশি ও উন্নত জাতের প্রায় ১২টি ছাগল রয়েছে। ছাগলের মধ্যে রয়েছে ব্ল্যাক বেঙ্গল, তোতাপুরীসহ বেশ কিছু জাত।
প্রতি বছর ২৫-৩০টি ষাঁড় বাজারজাত করা হয়। কোরবানির জন্য খামারে বিক্রি উপযোগী গরু ২ লাখ থেকে সর্বোচ্চ সাড়ে তিন লাখ টাকা দাম পর্যন্ত। নিজ বাড়িতে খামার থাকায় তিনি শখ করে দেশি মুরগি পালন করছেন।
খামারি রবিউল হোসেন জানান, মুরগি বড় হলেই বাড়ি থেকে বিক্রি হয়। বর্তমানে তার খামারে তিনজন শ্রমিক কাজ করছেন। তাদের বেতন ২০ থেকে ২৪ হাজার টাকা। শ্রমিকরা জানান, এখানে কাজ করে তারা খুবই খুশি।
তিনি আরও জানান, খামারের আশপাশে নিজস্ব জমিতে নেপিয়ার ঘাসসহ বিভিন্ন ধরনের ঘাস চাষ করা হয়েছে। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে গরু মোটাতাজা করা হয়। মোটাতাজা করণের জন্য ফিড খাওয়ানো হয়। বিশেষ করে দানাদার খাবারের পর গরুর পেটে যাতে গ্যাস না হয়, সেজন্য শুকনা খড় খাওয়ানো হয়। খরচ বাদ দিয়ে প্রতি বছর ১৫ লাখের বেশি আয় হয়। গরুর খাদ্য ও দুধের বাজারের দামের সঙ্গে আয় ওঠানামা করে।
উদ্যোক্তা জানান, তার খামারে সাফল্যের পাশাপাশি তাকে খারাপ সময়ের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। গত ৪ মাস আগে খুরা রোগে খামারের দুগ্ধজাত গাভীসহ ৬টি গরু মারা যায়। মারা যাওয়া গরুর আনুমানিক দাম ১০ লাখ টাকা।
তিনি অভিযোগ করে বলেন, গ্রামের গবাদিপশুদের সময় মতো খুরা রোগের ভ্যাকসিন দেওয়া হলেও খামারে দেওয়া হয়নি। এ ছাড়া খামারে হাসপাতালের ডাক্তার টাকা ছাড়া আসে না। এদিকে চট্টগ্রামের ডিএলও মহোদয় বলার পর থেকে খামারের ডাক্তার আসলে তবুও ৮০০-১০০০ টাকা দিতে হয়।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এ উপজেলায় ছোট-বড় ৬৫টি পশুর খামার রয়েছে। এসব খামারে বিভিন্ন জাতের গরু লালনপালন করা হয়েছে। ২০২৪ সালে চাহিদা রয়েছে ৫৩১৫০ টি। এদের মধ্যে ষাঁড় (গরু) - ২৪০৮৪ টি, বলদ- ১০৩২২, গাভী- ১৭১৮, মহিষ- ৩১১১, ছাগল- ১১৮৮৪,, ভেড়া- ২৬৮৫। সর্বমোট গবাদিপশু মজুদ রয়েছে ৫৩ হাজার ৮০৪ টি।
উপজেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা ডা. মোছা. তাহমিনা আরজু বলেন, এবারের কোরবানি উপলক্ষ্যে এ উপজেলায় ছোট-বড় ৬৫টি পশুর খামার রয়েছে। এ ছাড়া খামারি ছাড়াও গ্রামে অনেক গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া পালন করে। সে অনুযায়ী যথেষ্ট পশু মজুত রয়েছে। এরমধ্যে খামারগুলোতে পরিদর্শন ও নানা পরামর্শ দিচ্ছি।
গরুর ফিড খাওয়ানো সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, গরুর ফিডকে আমরা সুষম খাবার বলে থাকি। কেননা, এতে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট ও ভিটামিন রয়েছে। ফিড খাওয়াতে আমরা উদ্বুদ্ধ করি। শুধু কুড়া, ভুষি খাওয়ালে পুষ্টি পাই না। পাশাপাশি ঘাস খাওয়ানো দরকার। এবার কোরবানির হাট প্রাণিসম্পদ দপ্তর ও ভেটেরিনারি হাসপাতালের চিকিৎসকসহ একটি টিম থাকবে। সেখানে পশু অসুস্থ হলে চিকিৎসা দেওয়া হবে।
নয়া শতাব্দী/এনএইচ/এসআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ