ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তাঁতের শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত শ্রমিকরা, মজুরি নিয়ে অসন্তোষ

প্রকাশনার সময়: ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭:০৫ | আপডেট: ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৭:৩০

আসন্ন পবিত্র ঈদুল ফিতর ও পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষকে সামনে রেখে তাঁতের শাড়ি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন টাঙ্গাইলের শ্রমিকরা। তারা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত কাজ করছেন।

যেকোনো অনুষ্ঠানেই আবহমান বাঙালি নারীর প্রথম পছন্দ শাড়ি। এর মধ্যে আবার তাদের টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির প্রতি রয়েছে আলাদা টান। তাই ঐতিহ্য ধরে রাখতে এবার ঈদ ও পহেলা বৈশাখের জন্য শাড়িতে এসেছে বাহারি ডিজাইন আর নতুনত্ব। এসব শাড়ি তৈরিতে এখন ব্যস্ত সময় পার করছেন তাঁত শ্রমিকরা। পুরুষদের পাশাপাশি নারীরাও মেতেছেন এসব কাজে। শ্রমিকরা ভোর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করে তৈরি করেছেন শাড়ি। সবমিলিয়ে চিরচেনা রুপে ফিরেছে টাঙ্গাইলের তাঁত পল্লীগুলো।

জানা যায়, তাঁতের রাজধানী টাঙ্গাইলের পাথরাইল ছাড়াও বাজিতপুর, এলাসিন, করটিয়া, বল্লা, এনায়েতপুর, পোড়াবাড়ি, চারাবাড়ি, বাঘিলসহ সকল তাঁতপল্লীগুলোতে তাঁতের খটখট শব্দে মুখোরিত।

সরেজমিনে দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল তাঁত পল্লীতে গিয়ে দেখা যায়, এ শিল্পে শুধু পুরুষরাই নয়, বাড়ির নারীরাও এই কাজে যথেষ্ট শ্রম দিচ্ছেন। কেউ সুতা ছিটায় উঠানোর কাজে, কেউ সুতা পাড়ি করার কাজে, আবার কেউ সুতা নাটাইয়ে উঠানোর কাজে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সুতি শাড়ি সর্বনিম্ন ৬শ’ টাকা থেকে ২৫ হাজার, মার্সরাইজড কটন সর্বনিম্ন ১ হাজার ২৫০ টাকা থেকে ২০ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে। সিল্ক, সফট সিল্ক, হাফ সিল্ক, মসলীন, অ্যান্ডি সিল্ক, জামদানি শাড়ি সর্বনিম্ন ২ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে।

তাঁত শ্রমিকরা বলেন, ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে আমাদের ব্যবস্থা বেড়েছে। ব্যস্ততা বাড়লেও বর্তমানে আমাদের মজুরি কম। কম মজুরি দিয়ে আমাদের সংসার চলা দূরহ হয়ে উঠেছে।

তাঁত শ্রমিক মো. রশিদ নয়া শতাব্দীকে বলেন, আমি প্রায় ৩৫ বছর ধরে তাঁতের কাজ করছি। বর্তমানে তাঁতের সুতার দাম বেশি। কিন্ত কাপড়ের দাম কম। এতে করে মহাজনেরও কিছু থাকে না আমাদেরও কিছু থাকে না। বর্তমানে এই মজুরি দিয়ে আমাদের সংসার চলে না। তবুও ঈদ এবং বৈশাখকে কেন্দ্র করে আমরা শাড়ি বুননের কাজ করছি।

তাঁত শ্রমিক মুসলিম মিয়া বলেন, একটা শাড়ি তৈরিতে প্রায় দুই দিন সময় লাগে। পেটের তাগিদে এ পেশা ধরে রেখেছি। মহাজনে ঠিকমতো কাপড় বিক্রি করতে পারলে আমাদের কাজ দেয়। আর বিক্রি করতে না পারলে আমাদের কাজ দেয় না। এভাবেই চলছে আমাদের কার্যক্রম।

আরফান আলী বলেন, আমাদের টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি সম্পূর্ণ হাতে তৈরি হয়। একটি জামদানি শাড়ি তৈরি করতে সময় লাগে তিন-চার দিন। বিক্রি হয় তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকায়। মজুরি দেয় মাত্র এক হাজার টাকা। ছেলে-মেয়ে নিয়ে আমাদের অনেক কষ্ট করে চলতে হয়। বেশিরভাগই এ পেশা থেকে চলে গেছেন। আমি অন্য কোনো কাজ শিখি নাই, তাই যেতে পারি নাই। আমাদের মজুরি বাড়ানো হলে পরিবার নিয়ে একটু ভালোভাবে চলতে পারব।’

দেশের নানা প্রান্ত থেকে দলে দলে ক্রেতারা শাড়ি কিনতে ভিড় করছেন টাঙ্গাইলের তাঁতপল্লী ও জেলা শহরের শোরুমগুলোতে। স্বাচ্ছন্দে নিজের জন্য এবং প্রিয়জনকে উপহার দেয়ার জন্য পছন্দের শাড়ি কিনছেন ক্রেতারা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকেও শাড়ি ক্রেতা আসছেন টাঙ্গাইলের শাড়ির শোরুমগুলোতে। এবার ভারতে ৭৫ লাখ পিস টাঙ্গাইল শাড়ি রপ্তানি হয়েছে।

ভারত থেকে আসা স্বপ্না বসাক নয়া শতাব্দীকে বলেন, নর্ববষ উপলক্ষে আমি স্বামীকে নিয়ে টাঙ্গাইল শাড়ি কিনতে এসেছি। টাঙ্গাইল শাড়ির মান ও দাম অনেক ভালো।

ভারত থেকে আসা কিশরী মন বসাক এ প্রতিবেদকে বলেন, আমার স্ত্রীকে নিয়ে ভারত থেকে বাংলাদেশে শাড়ি কেনার জন্য এসেছি। শাড়ি দেখে আমাদের প্রছন্দ হয়েছে। সাথে আমিও পাঞ্জাবি কিনবো।

ক্রেতা সুমাইয়া শিমু বলেন, ‘ঈদ ও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে দুটি তাঁতের শাড়ি নিয়ে গেলাম। পরিবারের জন্যও তিনটি নিয়েছি। শাড়ির মান ও ডিজাইন অনেক ভালো। এজন্য প্রতি বছর টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি কিনতে আসি। আগের থেকে এবার দাম বেশি রাখছে। দাম একটু কম হলে ভালো হতো।’

পাথরাইল এলাকার তাঁতশিল্পের মালিক গোবিন্দ সূত্রধর বলেন, ‘বর্তমানে আমাদের অবস্থা খুব একটা ভালো না। পাওয়ার লুমের কারণে হ্যান্ডলুমের তৈরি শাড়ি কম চলে। এদিকে হ্যান্ডলুমের শাড়ির দামও বেশি। পাওয়ার লুমের শাড়ি পাওয়া যাচ্ছে পাঁচশ’ থেকে সাতশ’ টাকায়। এদিকে হ্যান্ডলুমের শাড়ি তৈরি করতেই মজুরি দিতে হয় পাঁচশ’ থেকে সাতশ’ টাকা। এজন্য আমাদের শাড়ি কম চলে। তারপরও আশা করছি এবার ঈদ ও পহেলা বৈশাখ পাশাপাশি হওয়ায় এবার আমাদের বিক্রি ভালো হবে।

টাঙ্গাইল চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির পরিচালক পলাশ চন্দ্র বসাক এ প্রতিবেদকে বলেন, ‘টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়িতে এবার নতুনত্ব এসেছে। টাঙ্গাইল শাড়িতে যে কোনো সময়ে নতুনত্ব আনা সম্ভব। এরমধ্যে অনেক শাড়ি বিক্রি হয়ে গেছে। গরমকে বিবেচনা করে সুতির শাড়ি, মার্সরাইজড কটন এবং সফট সিল্ক শাড়িগুলো বেশি বিক্রি হচ্ছে।

এব্যাপারে টাঙ্গাইল জেলা শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি রঘুনাথ বসাক নয়া শতাব্দীকে বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা না থাকার কারণে ঈদ ও পহেলা বৈশাখকে কেন্দ্র করে গত বছরের তুলনায় এ বছর ২৫ ভাগ বেশি টাঙ্গাইল শাড়ি বিক্রি হবে। এরমধ্যে অনেক শাড়িই বিক্রি হয়ে গেছে।

ভারতের জিআই পণ্য পাওয়ায় টাঙ্গাইল শাড়িতে কোনো প্রভাব পড়েনি। বর্তমানে তাঁত ও তাঁতির সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে। জেলায় বর্তমানে ৭২- থেকে ৭৫ ভাগ তাঁত বন্ধ হয়ে গেছে। এ শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা প্রয়োজন।

তিনি আরও বলেন, এবার বাংলাদেশ থেকে ভারতে ৭৫ লাখ পিস শাড়ি রপ্তানি হয়েছে। এ রপ্তানি আমাদের ধরে রাখতে হবে। কারণ শুধু আমাদের দেশের বাজার দিয়ে উৎপাদন ধরে রাখা কোনোভাবেই সম্ভব হবে না। বিভিন্ন হাটের কারণে টাঙ্গাইল শাড়ির মান কিছুটা কমেছে।

এ ব্যাপারে বাংলাদেশ তাঁত বোর্ডের লিয়াজোঁ অফিসার রবিউল ইসলাম বলেন, তাঁতিদের আমরা চলমান প্রক্রিয়ায় ঋণ দিয়ে থাকি। প্রণোদনামূলক ঋণ হিসেবে ৫ শতাংশ ঋণ সার্ভিস চার্জে তাঁতিদের সর্বোচ্চ তিন লাখ টাকা ঋণ দিতে পারি।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ