ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষ্ণার শরীরে স্প্লিন্টারের দাগ আজও মুছেনি

প্রকাশনার সময়: ২১ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪৩ | আপডেট: ২১ আগস্ট ২০২৩, ১৬:৪৭

২০০৪ সালের ২১ আগস্টে হামলায় আহত কৃষ্ণার শরীরে স্প্লিন্টার বিদ্ধ হওয়ার দাগ আজও মুছেনি। ২১ আগস্ট আসলেই মনে পরে ওই দিনের সেই নৃশংসতার ভয়াবহ দৃশ্য। কৃষ্ণ পাটিকর (৬১) চাঁদপুরের কচুয়া পৌরসভার পাটিকরের বাসিন্দ।

গ্রেনেড হামলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে কৃষ্ণ পাটিকর বলেন, ওই সময় তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সমাবেশের ডাক দিয়েছিল। সেই ডাকে সাড়া দিয়ে কচুয়া থেকে আমি কৃষ্ণা, উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আহসান হাবীব প্রানজল, দেবীপুর গ্রামের মিজান এবং আমাদের গ্রামের গাজী কামালের বাবা আব্দুল গফুর সহ আমরা চারজন ওই সমাবেশে যোগ দেই। সমাবেশে ট্রাকের ওপর স্থাপিত অস্থায়ী মঞ্চের খুব কাছেই ছিলাম আমরা। আমাদের নেতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর স্যারকে মঞ্চে উঠিয়ে দিয়ে একটু সরে আসি। এর ফাঁকে প্রানজল বলে ‘আমি একটু পানি খেয়ে আসি’ তারপর আর তাকে খুঁজে পাইনি। নেত্রীর বক্তব্য শুরু হওয়ার পর মনোযোগ সহকারে শুনছিলাম। বক্তব্যের শেষ পর্যায়ে হঠাৎ বিকট একটা শব্দের আওয়াজ শুনলাম। আওয়াজের সাথে সাথে দেখলাম আমাদের নেতাকর্মীরা মাটিতে ঢুলে পড়ছে। তখন আমি মনে করলাম তারা ভয়ে মাটিতে শুয়ে পড়ছে। কিছুক্ষণ পর দেখি আমার শরীরে একট উষ্ণ উষ্ণ গরম লাগছে। তখন ভাবলাম আমার শরীর এমন লাগছে কেন। সাথে সাথে আমি আমার শরীরে হাত দেই তারপর চোখে সামনে হাত এনে দেখি তাজা রক্ত।

তিনি আরও বলেন, জীবন বাঁচানোর তাগিদে তখন আমিও সবার মত ছুটছুটি করা শুরু করলাম। তখন দেখি আমার নেতা ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর ঘোরপাক করতেছে, মনে হচ্ছে ওনি যেকোনো দিক দিয়ে বের হবে সে পথ খুঁজে পাচ্ছে না। তখন আমার শরীর দিয়ে রক্ত ঝড়ছে। সেই সময়ে দেখলাম একটি ভ্যান গাড়ি পাশ দিয়ে যাচ্ছে। নিজের চিন্তা না করে স্যারকে বাঁচানোর জন্য সাথে সাথেই আমি ভ্যান গাড়িটি থাবা দিয়ে ধরে ড্রাইভারকে বললাম আমার নেতাকে বাঁচাও, তখন নেতাকে ভ্যান গাড়িতে তুলে দিয়ে পান্থপথের দিকে পাঠিয়ে দেই। আহত অবস্থায় আমি কাতরাতে কাতরাতে সামনে এগুলাম তখন দেখলাম আমাদের নেত্রীর গাড়িটি পিরামিনিয়া মাকের্টের কাছাকাছি। নেত্রী গাড়িতে উঠার সাথে সাথে অপরদিক থেকে নেত্রীর গাড়ি লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করে। ওইখানে আরও কয়েকজন নেতাকর্মী নেত্রীকে ঘিরে গাড়িতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। এমন চলতে চলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে, তখন নিজের জীবন বাঁচাতে ঘটনাস্থলে পাশাপাশি অবস্থিত আমাদের পাশের গ্রামের মক্কা ট্র্যার্ভেলসের মালিক জামালের স্বরনাপন্ন হই। ট্রার্ভেলসের দরজার সামনে গিয়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।

কৃষ্ণ পাটিকর বলেন, জ্ঞান ফিরার পর আমি দেখলাম জামালের পার্টনার আমার রক্তাক্ত কাপড় পরিবর্তন করে তোয়ালে দিয়ে আমাকে মুড়িয়ে রেখেছেন। পরে জামাল এবং জামালের পার্টনার আমাকে মনোয়ারা হসপিটালে নিয়ে যায়। ওইখানে গিয়ে দেখি প্রানজল ওই হসপিটালে। প্রানজল আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। ওই সময় হসপিটালে অনেক রোগী। করো হাত নেই, কারো পা নেই। পরে প্রানজল ডাক্তারদের ডেকে এনে আমার পায়ের এবং মাঝার থেকে স্প্লিন্টার বের করে। প্রানজল যদি ওই সময় আমার চিকিৎসার দায়িত্ব না নিত তাহলে আমি মনে হয় বেঁচে ফিরতে পারতাম না। তার দায় আমি কখনো দিতে পারবো না। পরে প্রানজল তার উলনের বাসায় আমাকে নিয়ে যায়। রাতে আমার যখন শ্বাস বন্ধ হয়ে আসছিল তখন আমার হাতে-পায়ে সারারাত তেল দিয়ে মালিশ এবং বুকে পাঞ্চ করে শ্বাস-প্রশ্বাস নিতে সহায়তা করে। সকালে একটু সুস্থ হলে তাকে বলি আমি বাড়িতে চলে যাবো পরে সে আমাকে সায়েদাবাদ এনে কচুয়ার বাসে তুলে দেয়।

তিনি আরও বলেন, পরে বাড়িতে আসলে পরিবার, এলাকাবাসী ও আত্মীয়-স্বজন আমাকে দেখে কান্নাকাটি শুরু করে দেয়। পরে আমাকে কচুয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসার জন্য ভর্তি করে। যদিও সেই সময়ে আমি সুস্থ হই কিন্তু দীর্ঘ বছর ধরে এ যন্ত্রণা সঙ্গে নিয়ে অভাব অনটনের মধ্য দিয়ে জীবন কাটছে। শরীরে বৃদ্ধ হওয়া সেই স্প্লিন্টারের দাগ আজও মুছে যায়নি।

২১ শে আগস্টের পর এক এক করে কৃষ্ণা পাটিকরের জীবন থেকে ১৯ বছর কেটে যাচ্ছে অথচ আজও রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে তার খোঁজ-খবর নেওয়া বা কোনো প্রকার সহায়তা প্রদান করা হয়নি। এই বর্বরোচিত হামলায় নিহত এবং আহতদের এবং এবং পরিবারের খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিকট তিনি আকুল আবেদন জানান।

উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি আহসান হাবীব প্রানজল বলেন, ওই সমাবেশে আমরা চারজন কচুয়া থেকে সমাবেশে যোগ দেই। গ্রেনেট হামলার ঠিক আগ মুহূর্ত আমি কৃষ্ণকে বলে পানি আনতে যাই। তার কিছুক্ষণ পরেই বিকট শব্দের আওয়াজ দলীয় নেতাকর্মীরা এইদিক ওদিক ছুটাছুটি শুরু করছে। এখন মনেহয় পানি আনতে যাওয়াতে আমি প্রাণে বেঁচে গেছি। জীবনের শেষ সন্ধিক্ষণে এসে কৃষ্ণ পাটিকর চিকিৎসার অভাবে দুখে দুখে কাতরাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন কৃষ্ণার মত ত্যাগী কর্মীরা অভিমান করলেও বেইমানি করে না। চিকিৎসার অভাবে কৃষ্ণার যেন মৃত্যু না হয়।

উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন চৌধুরী সোহাগ বলেন, কৃষ্ণা পৌরসভার পাটিকর পাড়ার আওয়ামী লীগের একজন ত্যাগী কর্মী। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় কৃষ্ণা পাটিকর আহত হয়েছে। পরে সে চিকিৎসা নিয়েছে। তবে বর্তমানে তার পরিবার নিয়ে চলাচল এবং চিকিৎসা খরচ যোগান দিতে হিমশিম খেতে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আকুল আবেদন, অসহায় ও আহত কর্মীদেরকে যেন আর্থিক সহায়তা দেওয়া হয়।

নয়া শতাব্দী/এসআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ