লবণ পানি অধ্যুষিত উপকূলীয় জনপদ বাগেরহাটের মোংলা। এখানে এক সময়ে প্রচুর ফসলের চাষাবাদ হতো। প্রত্যেক বাড়িঘরেই ছিলো গরু, মহিষ ও ছাগল। উঠানে হতো ধানসহ মৌসুমী ফসলের চাষাবাদ।
কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে ও ভূগর্ভস্ত পানির স্তর ক্রমেই নিচে নেমে যাওয়ায় চাষাবাদ বাধার কবলে পড়ে। এছাড়া এক পর্যায়ে ধীরে ধীরে লবণাক্ততার পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় প্রায় বন্ধ হয়ে যায় সেই গবাদি পশু ও ফসলের চাষাবাদ।
তাই লবণ অধ্যুষিত এ এলাকার মানুষের দুর্বিসহ জীবনজীবিকার কথা চিন্তা করে মাঠে নামে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপ। উপজেলার সোনাইলতলা ইউনিয়নের উত্তর ও দক্ষিণ উলুবুনিয়াসহ কয়েকটি গ্রামের তাদের দেয়া লবণ সহিঞ্চু উন্নতজাতের ফসলের বীজ ও ছাগল-ভেড়া পালনের উপরণাদি সহায়তায় তাতে ঝুঁকে পড়েছেন এখানকার গৃহিণীরা।
সোনাইলতলার নারীরা এখন গোটা উপজেলার নারীদের কাছে দৃষ্টান্ত হয়ে উঠেছেন। সবজি ও পশু পালনে তাদের দেখাদেখি উদ্ভুদ্ধ হচ্ছে অন্যান্য এলাকার নারীরা।
কৃষি ও প্রাণী সম্পদ বিভাগ এ সকল গৃহিণীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে লবণ সহিঞ্চু শাকসবজি ও ভেড়া-ছাগল পালনে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। উপজেলার সোনাইলতলা ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের ১২০টি নারী পরিবার এখন মৌসুমি সবজি চাষে ও ভেড়া-ছাগল পালনে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। কোন ধরনের কীটনাশক ছাড়াই জৈব সার দিয়ে তারা শীতকালীন ও বর্ষাকালীন সবজি চাষ এবং সারা বছর ধরে গবাদি পশু পালন করে ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন তারা। তাদের এ সফলতা দেখে উদ্ভুদ্ধ হচ্ছেন আশপাশের নারীরাও।
উলুবুনিয়া গ্রামের সুবিধাভোগী মুক্তি রায় ও নওরোজ সুলতানা বলেন, আমরা ফ্রেন্ডশিপ থেকে প্রশিক্ষণ ও ১৫/১৬ প্রকার সবজি বীজ পেয়ে বাড়ির পতিত জমিতে কৃষি করি।তা দিয়ে পরিবারে চাহিদা মিটিয়ে গেল বর্ষা মৌসুমে ১০/১২ হাজার টাকা বাড়তি আয় করেছি। এতে আমরা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছি।
একই এলাকার সুবিধাভোগী শিবানী মন্ডল ও হেনা বেগম বলেন, আগে সংসারে স্বচ্ছলতা ছিলো না। টাকা দিয়ে ছাগল-ভেড়া কেনার সামর্থ আমাদের ছিল না। কিন্তু ফ্রেন্ডশিপ আমাদের ছাগল-ভেড়া দিয়েছে। এখন বাচ্চাসহ প্রত্যেকের ৪/৫টি তারও বেশি ছাগল-ভেড়া হয়েছে। পাশপাশি আমরাও এখন দুই একটি কিনতে পারছি। আমরা এখন ছোটখাটো খামারি হয়ে গেছি।
সোনাইলতলা ইউনিয়নের ৮ নম্বর ওয়ার্ডের মেম্বার মো. নওশের শেখ বলেন, লবণাক্ততার কারণে আমাদের এ এলাকায় আগে সবজি চাষ ও গরু, ছাগল-ভেড়া পালনের উপযোগী ছিলো না। কিন্তু ফ্রেন্ডশিপের এএসডি প্রকল্প দুই বছর ধরে কাজ করছে। তাতে এখানকার নারীরা কৃষি ও পশু পালনে প্রশিক্ষিত হয়েছে। ফলে তারা এখন সবজি ও ছাগল-ভেড়া পালনে বিল্পব ঘটিয়েছেন। এখানকার নারীরা এখন আর্থিকভাবে স্বাভলম্বী হয়ে উঠেছেন। তাদের দেখা দেখি আশপাশের গ্রামের নারীরাও এখন এর উপর ঝুঁকছেন।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ফ্রেন্ডশিপের এএসপি প্রকল্পে প্রজেক্ট অফিসার মো. আনোয়ার হোসেন বলেন, অতি লবণাক্ততার কারণে এসব এলাকায় কেউ কোনো চাষাবাদ করেন না। এমনকি পশু পালনও করেন না। পরে আমরা গবেষণা করে বিপল্প পদ্ধতি বের করে নারীদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে কাজে লাগাই তাতেই ব্যাপক সফলতা এসেছে।
ফ্রেন্ডশিপের এএসডি প্রজেক্ট ম্যানেজার মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, আমরা এ এলাকায় ১২০টি পরিবার নিয়ে ৪টি গ্রুপ করি। এই গ্রুপের সদস্যদের আমরা উদ্ভুদ্ধ করি। তাদের বলি, আর যদি বীজ সরবরাহ করি, আধুনিক পদ্ধতিতে সবজি চাষাবাদের প্রশিক্ষণ দেই এতে তারা এগিয়ে আসবেন কিনা। এ প্রস্তাবে তারা রাজি হলো। উপজেলা কৃষি ও প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তার সাথে যোগাযোগ করে তাদেরকে আধুনিক পদ্ধতিতে সবজি ও ছাগল-ভেড়া পালনের প্রশিক্ষণ দিই। আমরা প্রত্যেক নারীকে চাহিদানুযায়ী একটি করে ছাগল ও ভেড়া দেই। তা দিয়ে খামার তৈরি করেছেন।
উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাখাওয়া হোসেন ও উপজেলা উপ-সহকারী প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা মো. ইউনুস আলী বলেন, ফ্রেন্ডশিপ সুবিধাভোগীদের আধুনকি প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তোলার পর তারা এখন সবজি ও পশু পালনে বিপ্লব ঘটিয়েছেন। লবণাক্ততা এলাকায় বিকল্প পদ্ধতিতে চাষাবাদ করে আর্থিকভাবে স্বাভলম্বী হয়েছেন। এটা একটা আশার দিক, আমরাও জেনে খুব আনন্দিত হয়েছি।
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ