শীতের এই সময়ে খেজুর রসের কদরই থাকে অন্যরকম। এই রসের টানে শহুরে জীবন ছুটে চলে গ্রামের পথে-প্রান্তরে। গ্রামের গাছিরা ব্যস্ত থাকে নতুন ঘ্রাণের সৌরভে। তখন তাদের জীবনের রুটিনও বদলে যায়। বদলে যায় গাছি মো. ইয়াছিনের জীবনও। একজন ইয়াছিন মো. ইয়াছিনের বাড়ি তাড়াশ উপজেলার রানীদিঘী গ্রামে। পিতা মৃত সোবাহান আলী এবং মাতা সবিলা বেওয়া। সাত ভাইবোনের মধ্যে সবার বড়। বয়স ৫৫ ছুঁইছুঁই।
বাবার কাছে হাতেখড়ি
ইয়াছিনের বয়স তখন দশ কি পনেরো। সঠিক সংখ্যাটা মনে করতে পারছেন না। বাবাকে দেখতেন, শীতের এই সময়গুলোতে খেজুর গাছের রস সংগ্রহে ব্যস্ত। খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠছেন, রস সংগ্রহ করছেন। বিকালে গাছের পরিচর্যা করছেন। বাবার কাছেই রস সংগ্রহের হাতেখড়ি ইয়াছিনের। এখন এই পেশার প্রেমেই পড়ে গেছেন ইয়াছিন। বললেন, এই কাজে বাবা আমার অনুপ্রেরণা ও শিক্ষক।
গাছের পরিচর্যা যেমন
কার্তিক মাসেই রস সংগ্রহের জন্য গাছগুলো প্রস্তুত করতে হয়। একটা গাছকে ডাল-পালা কেটে প্রস্তুত করতে এক দিনের মতো সময় লাগে। রস সংগ্রহের জন্য সাধারণত মাটির হাড়ি ব্যবহার করা হয়। হাড়ির ধারণ ক্ষমতা ৬ থেকে ১০ লিটারের মতো হয়। রস ভালো রাখার জন্য হাড়ির ভেতরে চুনের প্রলেপ দেয়া হয়। তবে যে গাছের কাচা রস খাওয়া হয় সে গাছের হাড়িতে চুন দেয়া হয় না।
যেভাবে রস সংগ্রহএকটা গাছ থেকে ২-৩ মাস রস পাওয়া যায়। কোনো গাছে ১০ কেজি রসও হয়। গাছ থেকে রস সংগ্রহে নিয়ম মানার কথা বললেন গাছি ইয়াছিন। ইয়াছিনের কাছে ব্যাপারটা এমন যে, প্রথম ৩ দিন রস সংগ্রহ করে পরবর্তী ৩ দিন গাছ থেকে রস সংগ্রহ করা যাবে না। একে আমরা বলি পালি দেয়া। আর এ নিয়মেই চলবে যতদিন পর্যন্ত রস সংগ্রহ করা হবে। বিকেল ৩টা থেকে রস সংগ্রহের জন্য গাছে গাছে হাড়ি বাঁধি। পরদিন ভোররাত অর্থাৎ ৫-৬ টা থেকেই শুরু হয় আমাদের রস সংগ্রহের কাজ।
বাড়িতে বানান গুড়
শুরুতে রসগুলো ছেকে বড় একটা খোলায় (পাত্রে) ঢালতে হয়। এরপর জাল দিতে হয়। আগুনের তাপে ধীরে ধীরে রস কমে আসে এবং লাল রং ধারণ করতে থাকে। এ সময় চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে সুস্বাদু ঘ্রাণ। এ ঘ্রাণে মন মাতাল হয়ে যায়। নেশা ধরে যায় তনুমনে। এক কেজি গুড় বানাতে ১২ থেকে ১৫ কেজি রসের প্রয়োজন হয়।
গুড় যায় সারাদেশেখেজুরের গুড়ের সুনাম আছে দেশের প্রতিটি অঞ্চলে। ইয়াছিনদের বানানো গুড় যায় সারাদেশে। রাজধানী ঢাকাতেই বেশি যায় বলা চলে। অনেক সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে লোকেরা দেখতেও আসে। এবার প্রতি কেজি গুড় ১৫০ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।
কাজটার মায়ায় পড়ে গেছিযুবক বয়সে একশ’র বেশি গাছ লাগাতাম। বর্তমানে ৫০ থেকে ৬০টি গাছের রস সংগ্রহ করছি। এখন আর আগের মতো কাজ করতে পারি না। মাঝেমধ্যে ইচ্ছে হয়, কাজটি ছেড়ে দিই। পারি না। কাজের মায়ায় পড়ে গেছি।
ইয়াছিনের ভালো স্ত্রীইয়াছিন চান, রস সংগ্রহের ব্যাপারটি অনেক দিন বেঁচে থাকুক। কেউ না কেউ এ পেশায় আসুক। কারণ, গাছি না থাকলে খেজুরের রস আর খাঁটি গুড় থাকবে না। ইয়াছিনের স্ত্রী ভালো মানুষ। তার পাশে ছায়ার মতো আছেন। বললেন, এই রস সংগ্রহ ও গুড় বানানোর কাজে আমাকে সাহায্য করে আমার স্ত্রী।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ