বঙ্গবন্ধু সশরীরে বাঙালির মাঝে নেই। কিন্তু তিনি যে আদর্শ ও চেতনাকে রেখে গেছেন তাকে ধারণ করেই বাঙালি এগিয়ে যাচ্ছে সোনালি ভবিষ্যতের দিকে। কবির ভাষায়— ‘আমরা সন্ধ্যায়, হারিয়ে যাওয়া ছায়ারই মতো হয়ে যাচ্ছিলাম,/আমাদের দিনগুলি ঢেকে যাচ্ছিল শোকের পোশাকে,/তোমার বিচ্ছেদের সংকটের দিনে/আমরা নিজেদের ধ্বংসস্তূপে বসে বিলাপে ক্রন্দনে/ আকাশকে ব্যথিত করে তুললাম ক্রমাগত; তুমি সেই বিলাপকে/রূপান্তরিত করেছো জীবনের স্তুতিগানে, কেননা জেনেছি—/ জীবিতের চেয়েও অধিক জীবিত তুমি।’
পরাধীন জাতিকে স্বাধীনতা এনে দিয়ে বিশ্ব দরবারে যিনি বাঙালিদের একটি বীরের জাতি হিসেবে পরিচিত করালেন, মাত্র ৪ বছরের মধ্যে দেশি ও আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মাধ্যমে ঘাতকরা সেই মানুষটিকে সপরিবারে হত্যা করে। বাঙালি জাতিকে পরিয়ে দেয় কলংকের তিলক। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে দীর্ঘ ৩৫ বছর জাতি হিসাবে আমরা যে কলঙ্কের বোঝা বহন করেছি বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গঠিত সরকার বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের বিচারের মাধ্যমে সেই বোঝা কিছুটা হলেও হালকা করেছেন। খুনিদের অনেকেই যারা এখনো বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে আছে, তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার আপ্রাণ চেষ্টা করা হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা ও পরে জাতীয় চার নেতা হত্যাকাণ্ডের পর সারাদেশের মানুষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সামনে এমন কেউ ছিলেন না যারা তখন জাতিকে নেতৃত্ব দিতে পারেন। সেই অন্ধকারময় আশার আলোহীন দুর্দিনে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী সীমান্তে গড়ে তুলেছিলেন প্রতিরোধ।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার প্রতিবাদে বাংলাদেশের উত্তর-পূর্ব সীমান্ত এলাকায় শুরু হয় প্রতিরোধ যুদ্ধ। সারাদেশে কারফিউ আর সেনা তৎপরতার মুখে যখন টুঁ শব্দটি করার উপায় ছিল না, তখন এক দল যোদ্ধা অস্ত্র হাতে গর্জে ওঠে। ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগানে তারা কাঁপিয়ে তোলে সীমান্তবর্তী জনপদ। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনাদের পরাস্ত করে যেসব বীর মুক্তিযোদ্ধা স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েন তাদের অনেকে। মাত্র চার বছরের ব্যবধানে পঁচাত্তরে দেশি বাহিনীর বুলেটের টার্গেটে পরিণত হন বীর মুক্তিযোদ্ধারা।
১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ পর্যন্ত চলমান ওই প্রতিরোধ— সংগ্রামে শাহাদাতবরণ করেন ১০৪ বীরযোদ্ধা। যদিও এই প্রতিরোধ সাধারণ মানুষের মনে সেভাবে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পারেনি। তবে স্বৈরশাসকরা এ প্রতিরোধের কারণে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের ওপরে নির্যাতন ও জেল-জুলুম নিয়ন্ত্রণ করতে বাধ্য হয়েছিল।
বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী গণমাধম্যকে দেয়া এক সাক্ষাৎকার বলেন, ‘১৫ তারিখ ভোরে আমি বাসাতে ছিলাম। তখন জানতে পারি বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার কথা। তখন আমি তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ কয়েকজন নেতার সঙ্গে কথা বলি। তাদের বলি— এ হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। এ প্রতিরোধের কথা জানিয়ে লিফলেট প্রকাশ করা হয়। আমি মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকা, টাঙ্গাইলসহ ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা এবং পরে ভারতে গিয়ে ২০০ কিলোমিটারের বেশি সীমান্ত এলাকাজুড়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলি। তখন শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা প্রতি মাসে চিঠি দিয়ে আমাদের অনুপ্রাণিত করেছেন। সেই সময় যদি আমরা এ প্রতিরোধ গড়ে না তুলতাম তাহলে জিয়াউর রহমান দেশে আওয়ামী লীগের কোনো অস্তিত্বই রাখত না। আমাদের প্রতিরোধের মুখে তারা অন্য নেতাকর্মীদের নির্বিচারে হত্যা করতে পারেনি।’
বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ যেমন পরস্পর অভিন্ন, তেমনি নদ-নদীসহ প্রাকৃতিক জলসম্পদ ও নৌ পরিবহন ব্যবস্থা এ দেশের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এর সঙ্গে মিশে আছেন কালের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এক কথায় নৌপরিবহন ব্যবস্থার উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান ছিল প্রথম পথপ্রদর্শক।
অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছিলেন, ‘যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান, ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান।’
নৌপথের উন্নয়নে বঙ্গবন্ধুর অবদান প্রসঙ্গে নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলেন, “বঙ্গবন্ধু বুঝতে পেরেছিলেন, মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানের রেখে যাওয়া ‘খনক’ নামের একটি মাত্র ড্রেজার দিয়ে বিশাল আয়তনের অভ্যন্তরীণ নৌপথের নিয়মিত পলি অপসারণ ও নদী খনন সম্ভব নয়। বঙ্গবন্ধু তার সংক্ষিপ্ত শাসনামলে বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃক্ষের জন্য দু’দফায় নেদারল্যান্ডস থেকে সাতটি উন্নতমানের ড্রেজার সংগ্রহ করেছিলেন। যেগুলো এখনো বিআইডব্লিউটিএ’র বহরে যুক্ত ও সচল রয়েছে।”
নয়া শতাব্দী/জেআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ