স্বাধীনতার ৫১ বছর পেরিয়ে গেলেও পাবনায় অধিকাংশ গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো অযত্ন-অবহেলায় রয়েছে। সরকারের বিশেষ উদ্যোগে জেলার কিছু কিছু গণকবর ও বধ্যভূমি চিহ্নিত করা হলেও সহজে চেনার উপায় ছিল না। বর্তমান সরকারের আমলে বধ্যভূমি ও গণকবরগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি কিছুস্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও যথাযথভাবে দেখভালের অভাবে তা অযত্ন আর অবহেলায় রয়েছে। অনেক স্থান এখন ঘাস, লতাগুল্মতে পরিপূর্ণ, অনেক স্থান গোচারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
পাবনা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ও বীরমুক্তিযোদ্ধাদের দেয়া তথ্য সূত্রে জানা গেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পাবনা শহরের নূরপুর ডাকবাংলোয় ছিল পাকিস্তানি বাহিনীর টর্চার সেল। রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি বাহিনী সেখান থেকে মুক্তিযোদ্ধা আকবর হোসেন আকু, হাসান খাঁ, দুলাল, হায়দার আলী, পুলিশ সিপাহী আল্লারেক্ষা, মন্টু মিয়া ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক শিক্ষকসহ ২০ জনকে সদর উপজেলার টেবুনিয়া খামারে নিয়ে হত্যা করা হয়। পরে পাক বাহিনী চলে গেলে স্থানীয়রা খামারের মধ্যে একটি গর্ত করে তাদের গণকবর দেয়। সেখানে শহীদদের গণকবরের স্মৃতিচিহ্ন নেই। তবে খামারের কর্মচারীদের উদ্যোগে ওই স্থানে টেবুনিয়া বধ্যভূমি নামে একটি সাইনবোর্ড ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
পাবনা জেলার সাঁথিয়া উপজেলার ধুলাউড়িতে ১৯৭১ সালের ২৭ নভেম্বর পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায়। জেলার বিভিন্ন স্থানের একদল মুক্তিযোদ্ধা ধুলাউড়ি গ্রামে আশ্রয় নিয়ে পাক বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করার প্রস্তুুতি নিচ্ছিলো। এমন সময় স্থানী রাজাকার, আলবদর, আলশামসদের সহযোগিতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ওই গ্রামের চারদিক ঘিরে ফেলে। পরে ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে পাকবাহিনী ধুলাউড়ি গ্রামে ধরে নিয়ে যায়।
অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় ছাত্তার রাজাকারসহ তার সহযোগীরা বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে ও গলায় ছুরি চালিয়ে নিষ্ঠুরভাবে তাদের হত্যা করে। এ স্থানে খবির উদ্দিন, চাঁদ আলী, দ্বারা মিয়া, মকছেদ আলী বিশ্বাস, আকতার আলম, মহসিন মধু, শাহজাহান আলী, মোসলেম উদ্দিন, ডা. আব্দুল আওয়াল, ডা. আবুল কাশেম ফকির, আব্দুর রশিদ ফকির, জহুরুল ইসলাম ফকির, ওয়াজেদ আলী সরকার, কোবাদ আলী বিশ্বাস, আব্দুল গফুর, আব্দুস সামাদ বিশ্বাস, আকতার হোসেন তালুকদারসহ ১৮ জন মুক্তিযোদ্ধাকে হত্যা করা হয়। তার মধ্যে ১১ জনকে এক সাথে গণকবর দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীনতার পর গ্রামবাসীর সহযোগীতায় গণকবরটি ইট দিয়ে বাঁধানো হয়। দীর্ঘ বছর পর সেখানে বর্তমানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।
পাবনার ফরিদপুর উপজেলার ডেমড়া গ্রামে দেশের উত্তরাঞ্চলের দ্বিতীয় বৃহৎ গণহত্যা চালায় পাক হানাদার বাহিনী। গ্রামটি নিরাপদ ভেবে বিভিন্ন এলাকার হিন্দু-মুসলমানসহ ধনী ব্যবসায়ীরা এ গ্রামে আশ্রয় নিয়ে ছিল। সেই সময় স্থানীয় আসাদ রাজাকারের নেতৃত্বে গ্রামের ২৫০ জন হিন্দু ব্যবসায়ীসহ প্রায় সহস্রাধিক মুক্তিযোদ্ধা এবং স্থানীয় গ্রামবাসীকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা এবং ব্যাপক লুটতরাজ ও নারী ধর্ষণ করা হয়। নির্মমভাবে নিহত ২৫০ জন হিন্দুকে সারিবদ্ধভাবে মাটি চাপা দেওয়া হয়। মুসলমানদের লাশগুলোও সারিবদ্ধভাবে কবর দেওয়া হয়। বর্তমানে ঝোপ আর জঙ্গলে পরিপূর্ণ এ গণকবরটি। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সম্প্রতি সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হলেও তা বেহাল দশায় পড়ে আছে।
১৯৭১ সালের ১৯ এপ্রিল মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীর সঙ্গে সাঁথিয়া উপজেলার শহীদনগর ডাববাগান এলাকায় পাকিস্তনি হানাদার বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এ যুদ্ধে ১৯ জন ইপিআর সদস্যসহ প্রায় ২০০ মুক্তিযোদ্ধা ও নিরীহ গ্রামাবাসী নির্মমভাবে নিহত হয়। শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ‘বীরবাঙ্গালী’ নামে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।বীর মুক্তিযোদ্ধা সাইফুল আলম বাবলু জানান, পাবনা শহরের ওয়াপদা হাউজে পাকবাহিনীর একটি টর্চারসেল ছিল। সেখানে মুক্তিকামী মানুষকে নির্মমভাবে হত্যার পর তাদের লাশ নিয়ে ফেলা হতো ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশি রেলওয়ে কলোনির লোকোশেড পাম্পহাউজ স্টেশনের কাছে। এখানে একটি বধ্যভূমি রয়েছে। বর্তমানে সেখানে কোনও স্মৃতিচিহ্নও নেই। এমনিভাবে রেলওয়ে কলোনির আশপাশে আরও কয়েকটি স্থানে গণকবর ও বধ্যভূমি রয়েছে। তবে সেখানে সরকারি উদ্যোগে শহীদদের সম্মাননা জানানো হয়নি। সংরক্ষণের উদ্যোগও নেওয়া হয়নি। তিনি আরো জানান, আটঘরিয়া উপজেলার মাজপাড়া বংশীপাড়া ঘাটে ১৯৭১ সালের ৬ নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামাবাসীর সঙ্গে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সম্মুখ যুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে ১২ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাসহ মোট ৪০ জন শহীদ হন। তাদেরকে গণকবর দেয়া হয়। দীর্ঘদিন পর সেখানে শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ হলেও বর্তমানে অবহেলায় পড়ে আছে স্মৃতিসৌধটি।
এব্যাপারে পাবনা জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীরমুক্তিযোদ্ধা আ.স.ম আব্দুর রহিম পাকন জানান, ইতোমধ্যে জেলার অধিকাংশ গণকবর ও বধ্যভূমিগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এখনও যেগুলো চিহ্নিত হয়নি, সেগুলোর বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করে মহান মুক্তিযুদ্ধে আত্মত্যাগকারী বীর যোদ্ধাদের স্মৃতিরক্ষা করা হবে।
নয়াশতাব্দী/জেডএম
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ