যুদ্ধের ভয়াবহ গণহত্যার স্মৃতি বিজড়িত আরেকটি স্থান গল্লামারী। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্নিকটে ময়ূর নদীর তীরে অবস্থিত এই গল্লামারী। ১৯৭১ এর মহান মুক্তিযুদ্ধে খুলনা অঞ্চলের অন্যতম বধ্যভূমি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান রেডিও স্টেশন (গল্লামারী রেডিও সেন্টার) ভবনে মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষদের ধরে এনে নির্মম নির্যাতন করে হত্যাকরে গল্লামারী নদীতে ফেলে দেয়া হতো। শহরের দু'কিলোমিটার অভ্যন্তরে গল্লামারী খালের পাশে এই বধ্যভূমির অবস্থান।খুলনা শহর মুক্ত হওয়ার পর গল্লামারী খাল ও এর আশপাশের স্থান থেকে প্রায় পাঁচ ট্রাক ভর্তি মানুষের মাথার খুলি ও হাড়গোড় পাওয়া যায়। ধারণা করা হয় ওই স্থানে আনুমানিক ১৫ হাজার মানুষ হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর রেডিও সেন্টার (বর্তমান বাংলাদেশ বেতার, খুলনা কেন্দ্র) নগরীর নূরনগর এলাকায় স্থানান্তরিত হয়েছে। সেখানে ১৯৯৫ সালে প্রথম একটি স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়।
খুলনা শহর থেকে ৩ কিলোমিটার দূরের জায়গাটি তখন বেশ নির্জন ছিল। সে সময় এখানে ছিল রেডিও পাকিস্তানের খুলনা কেন্দ্র। পাকিস্তানি বাহিনীর কিছু সদস্য কেন্দ্রটির নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন।
নির্জনতা এবং পাশে বয়ে চলা ময়ূর নদের (যা এখন মৃতপ্রায়) কারণেই এই স্থানকে বধ্যভূমির জন্য বেছে নেওয়া হয়। নদীর তীরে থাকা বেশ খানিকটা জায়গাজুড়েই ছিল রেডিও স্টেশন, যা মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নির্যাতন ও হত্যাকেন্দ্রে রূপান্তরিত হয়। এখানে দিনের বেলায় নিরীহ মানুষকে ধরে নিয়ে আসা হতো। পরে সেই বধ্যভূমির ওপরেই গড়ে ওঠে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর তৎকালীন রেডিও স্টেশনটির নাম হয় ‘শহীদ নজরুল ইসলাম ভবন’। বর্তমানে ভবনটি পুরাতন প্রশাসনিক ভবন হিসেবেও পরিচিত।
মুক্তিযুদ্ধের সময় খুলনার গল্লামারী বধ্যভূমিতে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের দোসররা ঠিক কত লোককে হত্যা করেছে, তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই। এ নিয়ে উল্লেখ করার মতো কোনো গবেষণা হয়েছে বলে জানা যায়নি।তবে অমল কুমার গাইনের লেখা গণহত্যা-বধ্যভূমি ও গণকবর জরিপ: খুলনা জেলা বইয়ের আছে, ‘গল্লামারীতে প্রায় প্রতিদিন গণহত্যা চালানো হতো। সে হিসাবে ধরলে এপ্রিল থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এখানে কমপক্ষে ২৫০টি গণহত্যা হয়েছে। কয় হাজার মানুষকে এখানে হত্যা করা হয়েছে, তা না জানলেও আনুমানিক সে সংখ্যা ১০ হাজারের কম হবে না।’
আজ যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল ফটক, ঠিক তার সামনে দিয়ে ছিল একটি বড় খাল। সেই খাল দিয়ে প্রতিনিয়ত যাতায়াত করতো হানাদার বাহিনীর গানবোট। যুদ্ধের সময় এই খালে ভেসে থাকত অজস্র লাশ। এদিকে, খুলনা-সাতক্ষীরা সড়কের বিশ্ববিদ্যালয়ের আগে বাঁ পাশে নির্মাণ করা হয় ‘খুলনা গল্লামারী স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ’। ১৯৯৯ সালে জেলা প্রশাসন এটি নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। স্মৃতিসৌধের পাশেই তৈরি করা হয় একটি মুক্তমঞ্চ।
এরপর ২০০৭ সালে জেলা পরিষদ উদ্যোগ নেয় ওই এলাকায় একটি আধুনিক স্মৃতিসৌধ নির্মাণের। ওই প্রকল্পের জন্য তিন একর খাস জমি অধিগ্রহণ করা হয়। ২০০৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১১ সালে মূল স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন হলেও এরপর অর্থাভাবে থেমে আছে নকশার বাকি কাজ।
১৩ ডিসেম্বর গল্লামারী স্মৃতিসৌধ এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বছরের অন্যান্য সময় অবহেলিত থাকলেও শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, বিজয় দিবস ও স্বাধীনতা দিবসে স্মৃতিসৌধটিকে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও রং-চং করা হয়। শ্রমিকদের পরিচ্ছন্নতার কাজ করছে। এছাড়া এবারই স্মৃতিসৌধে প্রবেশের সড়কে ইট বিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। তবে এখনও পূর্ণতা পায়নি স্বাধীনতা স্মৃতিসৌধ কমপ্লেক্সের।
স্মৃতিসৌধের তত্ত্বাবধায়ক হায়দার শিকদার বলেন, কার নেতৃত্বে ছয় জন শ্রমিক পরিছন্নতার কাজ করছেন।
নয়াশতাব্দী/এফআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ