কিশোরগঞ্জের ১১টি বধ্যভূমিতে সাম্প্রতিক সময়ে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের কাজ চলছে। এক বছরেরও বেশি সময় আগে ভিত্তিপ্রস্তর হয়েছিল, কিন্তু কাজের গতি খুবই মন্থর।
প্রশাসন জানিয়েছে, স্মৃতিসৌধগুলো নির্মিত হবে একই ডিজাইনের। প্রত্যেকটা স্মৃতিসৌধের প্রস্তর ফলকে শহিদদের নাম খোঁদায় করে লেখা থাকবে। জেলা পরিষদের সহায়তায় গণপূর্ত বিভাগের মাধ্যমে নতুন ডিজাইনের জেলায় প্রস্তাবিত ১১টি স্মৃতিসৌধের প্রত্যেকটি ব্যয় ধরা হয়েছে ৮০ লাখ টাকা। জেলা সদরের বধ্যভূমির মধ্যে অন্যতম শোলমারা বধ্যভূমি, বড়ইতলা গ্রামের বধ্যভূমি, ধুলদিয়া রেলওয়ে সেতু বধ্যভূমি, নীলগঞ্জ বাজার ব্রিজ বধ্যভূমি, সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি ঘাট বধ্যভূমি উল্লেখযোগ্য। এসব বধ্যভূমিতে যাদের কবর রচিত হয়েছে, কোনো সরকারই তাদের পরিবারের খোঁজ রাখেনি। বিভিন্ন দিবস উপলেক্ষে কেউ কেউ এসে ফুল দিয়ে যায় তাদের কবরে। নিন্মে এসব বধ্যভূমি নিয়ে আলোকপাত করা হলো-
শোলমারা বধ্যভূমি : কিশোরগঞ্জ সদর উপজেলার মহিনন্দ ইউনিয়নের শোলামারার বধ্যভূমি। ১৯৭১ সনে পাকহানাদার বাহিনীরা বাঙালিদের এনে নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে এখানে কবর দিত। কিশোরগঞ্জ শহরের আখড়াবাজার এলাকার মুক্তিযোদ্ধা কামরুজ্জামান কামরুর বাবা অবসরপ্রাপ্ত খাদ্য কর্মকর্তা নবী হোসেন ভুঞা,করিমগঞ্জ উপজেলার নোয়াবাদ গ্রামের মুক্তিকামী যুবক আবু বাক্কার সিদ্দিকসহ অসংখ্য বাঙালিকে হত্যা করে পাকহানাদার বাহিনী। শহিদদের হত্যা করে লাশ খালের পানিতে ভাসিয়ে দিতো পাকবাহিনী। পরে লাশগুলো ভেসে পাশ্ববর্তী ভাস্করখিলা বিলসহ আসপাশের এলাকায় ডোবা পানিতে ভেসে থাকতো। স্বাধীনতার পরে ৯জন শহিদদের ক্ষত-বিক্ষত লাশ উদ্ধার করে জনগণ শোলমারা সেতুর পাশে ইটখলায় তাদের গণকবর দিয়েছিল।
বড়ইতলা স্মৃতিসৌধ
বড়ইতলা গ্রামের বধ্যভূমি : ১৯৭১ সনে স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে ১৩ অক্টোবর কিশোরগঞ্জের বরইতলায় পাকহানাদার বাহিনী গণহত্যা চালিয়ে ৩৬৫ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। সেই থেকে এই দিনটি এখন বড়ইতলা গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করে আসছে স্থানীয়রা। তাদের পরিবার এখনো মানবেতর জীবন-যাপন করছেন। তাদের খবর রাখে না কেউ। এখনো মেলেনি শহিদ পরিবারের স্বীকৃতি ও মর্যাদা।
জানা যায়, ১৯৭১ সালের ১৩ অক্টোবর সকাল ১০টার দিকে কিশোরগঞ্জ থেকে ট্রেনে করে কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের বড়ইতলা নামক স্থানে আসে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এ দেশীয় দোসর রাজাকার, আলবদর, আলশামস। পরে তারা পার্শ্ববর্তী দামপাড়া গ্রামে প্রবেশ করে ৪-৫ জন নিরীহ স্থানীয় বাসিন্দাকে নির্বিচারে গুলি করে হত্যা করে। ঘটনার আকস্মিকতায় প্রাণে বাঁচতে কর্শাকড়িয়াইল ইউনিয়নের দামপাড়া, বীরদামপাড়া, কড়িয়াইল, তিলকনাথপুর, গোবিন্দপুর, চিকনিরচরসহ আশপাশের মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য ছোটাছুটি করতে থাকে। এ সময় রাজাকাররা গ্রামের সাধারণ মানুষকে সভার কথা বলে ডেকে বড়ইতলায় নিয়ে যায়। পরে তাদের মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করা হয়। স্থানীয় রাজাকাররা পাক সৈন্যদের নিয়ে গ্রামে গ্রামে গিয়ে বাড়ি ঘরে লুটতরাজ, নারী নিপীড়ন ও অগ্নি সংযোগ করে। এ সময় এক রাজাকার গুজব ছড়ায় যে, গ্রামবাসী দুই পাকিস্তানিকে মেরে ফেলেছে। এ গুজবের পর বর্বর পাক হানাদাররা স্থানীয় রাজাকারদের সহযোগিতায় কিশোরগঞ্জ-ভৈরব রেললাইনের পাশে বড়ইতলা নামক স্থানে নিরীহ ৩৬৫ গ্রামবাসীকে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে, রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করে।
ধুলদিয়া রেলওয়ে সেতু বধ্যভূমি : কিশোরগঞ্জের গচিহাটা রেলস্টেশনের কাছে ধুলদিয়া রেলওয়ে সেতু বধ্যভূমিতে বাঙালিদের নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। যাদের হত্যা করা হয়েছে তাদের কয়েকজন হলেন সুধীর জীবন বীর, শশাংক জীবন বীর, শৈবাল জীবন বীর, বিপুল জীবন বীর, বাদল জীবন বীর, অরুণ চন্দ্র রায়, মোহাম্মদ আলী, হরলাল পোদ্দার, মো. ইমাম হোসেন, মো. ইসরাইল, অজিত চন্দ্র সরকার, নগেন্দ্র ভৌমিক, দেবেন্দ্র ভৌমিক, মো. শুকুর মামুদ প্রমুখ।
করিমগঞ্জের শহিদ বুদ্ধিজীবী ডা. আবদুস ছোবহান
নীলগঞ্জ বাজার ব্রিজ বধ্যভূমি : ১৩৭৮ বঙ্গাব্দের ২৩ ভাদ্র পাক সেনাবাহিনী কিশোরগঞ্জের বেপারীপাড়া গ্রামে আটজনকে ধরে নিয়ে নীলগঞ্জ বাজারস্থ ধলেশ্বরী নদীর ব্রিজে দাঁড় করিয়ে গুলি করে। এতে গোপাল চন্দ্র বর্মণ, সুভাষ চন্দ্র বর্মণ, হলধর বর্মণ, মুকুন্দ বর্মণ, কেবল চন্দ্র গোস্বামী, সজনী বর্মণ, যুধিষ্ঠির বর্মণসহ মোট সাতজন নিহত হয়। একমাত্র সুবোধ চন্দ্র বর্মণ গুলি করার সময় নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রাণে বেঁচে যান।
সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি ঘাট বধ্যভূমি : কিশোরগঞ্জ শহরের সিদ্ধেশ্বরী কালীবাড়ি ঘাটে শহরের বিভিন্ন জায়গা থেকে অসংখ্য মানুষকে ধরে এনে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এখানে যাদের হত্যা করা হয় তাদের মধ্যে মহিউদ্দিন আহমেদ, ছফিরউদ্দিন, প্রফুলস্নকুমার সরকার, যোগেন্দ্র চন্দ্র মজুমদার, পরিতোষ চন্দ্র সরকার, তাপস প-িত, বামা চরণ সাহা, নবীন চন্দ্র সাহা রায়, শৈলেশ চন্দ্র পতি, সুধাংশু চন্দ্র সাহা, বিকাশ চন্দ্র সরকার প্রমুখের নাম পাওয়া যায়।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ