নড়াইল জেলা জজ আদালতের ২৫ গজ দূরে ডাক অফিসের দ্বিতল বাড়ির পেছনে বধ্যভূমি। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাঙালি নারী-পুরুষকে ধরে এনে এখানে নির্যাতন করত। নির্যাতন-ধর্ষণের পর ক্যাম্পের পেছনে দেয়ালঘেরা জঙ্গলে হত্যা করে মাটিচাপা দিত। এখানে শহিদদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে সংরক্ষিত করা হয়েছে গণকবর, বধ্যভূমি ও স্মৃতিসৌধ।
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে মানুষের বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাষণে স্বাধীনতার যে আহ্বান ছিল, নড়াইলের মুক্তিপাগল জনতা সে আহ্বানে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ওই সময় নড়াইলের এসডিও’র বাসভবনকে স্থানীয় মুক্তিযুদ্ধের হাই কমান্ডের সদর দফতর করা হয়। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে তৎকালীন নড়াইলের এসডিও কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, এমএনএ খন্দকার আব্দুল হাফিজ, এমপিএ শহিদ আলী খান, আওয়ামী লীগ নেতা এখলাছ উদ্দিন, বিএম মতিয়ার রহমান লোহাগড়া হাইস্কুলে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা ও নড়াইলের সংগঠিত মুক্তিযোদ্ধাদের এক করে বিশাল বাহিনী যশোর অভিমুখে পাঠিয়ে দেন।
এ দিকে নড়াইলের জামায়াত নেতা মাওলানা সোলায়মান ও আওয়াল মন্ডলের নেতৃত্বে ‘শান্তিবাহিনী গঠিত হয়’। এ বাহিনীর সদস্যদের দিয়ে দেশপ্রেমিক শত শত মানুষকে ধরে এনে নড়াইল ডাকবাংলোয় আটকে রাখা হতো। এসব ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কাল্পনিক অভিযোগ এনে মাওলানা সোলায়মান রেজিস্ট্রারে যাদের নামের পাশে লালকালি দিয়ে ‘রিলিজ ফর ইভার’ লিখে দিত, তাদের গভীর রাতে নড়াইল শহরের লঞ্চঘাটের প্লাটুনের ওপর নিয়ে গিয়ে গলা কেটে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়া হতো। এভাবে মাওলানা সোলায়মান ও আওয়াল মন্ডল চেনা-অচেনা সহস্রাধিক মানুষকে গলা কেটে হত্যা করেছে বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়।
মাওলানা সোলায়মান ও আওয়াল মন্ডলসহ অন্যান্য রাজাকাররা তুলারামপুরের আওয়ামী লীগের সদস্য, নড়াইল ভিসি স্কুলের মাস্টার শহিদ আতিয়ার রহমান তরফদার, শহিদ আ. সালাম তরফদার, শহিদ মকবুল হোসেন সিকদার, শহিদ মাহাতাব তরফদার, শহিদ মোকাম মোল্যা, শহিদ কাইজার মোল্যা, শহিদ আলতাফ হোসেন তরফদার, শহিদ রফিকুল উদ্দিন তরফদার ও চাচড়া গ্রামের শহিদ ফয়জুর রহমানসহ অনেককে ধরে এনে শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকায় নিয়ে যায়। সেখানে হত্যা করে কবর খুঁড়ে পুতে রাখে। এটা এখন গণকবর নামে জানে মানুষ।
৬ এপ্রিল সকালে পাক হানাদার বাহিনী দুটি জেট বিমান থেকে নড়াইল শহরের ওপর ব্যাপকভাবে মেশিনগানের গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে। এরপর নড়াইল শহর জনশূন্য হয়ে পড়ে। ১৩ এপ্রিল হানাদার বাহিনীর একটি দল নড়াইল শহরের চৌরাস্তায় রেস্টুরেন্ট মালিক মন্টুকে গুলি করে আহত করে এবং হরিপদ সরদার, ভাটিয়া গ্রামের কালু বোস, সরসপুর গ্রামের প্রফুল্য মিত্রকে ধরে নিয়ে দাইতলা পুলের কাছে গুলি করে ফেলে রেখে চলে যায়।
এদিকে ক্যাপ্টেন দোহারের উদ্যোগে লোহাগড়ার ইতনা ও আওড়িয়ায় প্রশিক্ষণ শিবির খোলা হয়। এ কারণে মধুমতি-নবগঙ্গা নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের ভাটিয়াপাড়াস্থ হানাদার বাহিনীর ক্যাম্প থেকে তাদের দোসরদের সহযোগিতায় গানবোট যোগে ইতনা গ্রামে নৃশংস অভিযান চালিয়ে ওই গ্রামের ৫৮ জন নারী-পুরুষ-শিশুকে হত্যা করা হয়।
দেশ হানাদার মুক্ত করার এক দুর্জয় আকাঙ্ক্ষা নিয়ে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সদর থানায় উজির আলী, লোহাগড়া থানায় মোক্তার আলী, কালিয়া থানায় ওমর আলী এবং মুজিব বাহিনীর কমান্ডার হিসেবে সদর থানায় শরীফ হুমায়ুন কবীর, শেখ আজিবর রহমান, লোহাগড়া থানায় শরীফ খসরুজ্জামান, কালিয়া থানায় আব্দুল মজিদ সরদারকে নিযুক্ত করা হয়। পরে তারা নড়াইলে প্রবেশ করে।
অক্টোবর মাস থেকে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের মুক্তিপাগল মানুষের মনে এক বিশ্বাস জন্মাতে থাকে যে হানাদার বাহিনী বা তাদের দোসররা আর বেশিদিন টিকতে পারবে না। ডিসেম্বর মাসের প্রথম দিকেই নবগঙ্গা নদীর উত্তর ও পূর্বাঞ্চল হানাদার মুক্ত হয়ে যায়। লোহাগড়া থানা পাক হানাদার বাহিনীর ঘাঁটিকে ৭ ডিসেম্বরের মধ্যে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডাররা আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেন।
তবে তারা আত্মসমর্পণ না করায় ৮ ডিসেম্বর শরীফ খসরুজ্জামান, দবির উদ্দিন, ইউনুস আহমেদ, লুৎফর মাস্টার, আলী মিয়া, লুৎফর বিশ্বাসসহ আরও অনেক গ্রুপ এক হয়ে সম্মিলিতভাবে তিন দিক থেকে লোহাগড়া থানা আক্রমণ করে। প্রচণ্ড যুদ্ধের পর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করে।
এরপর মুক্তিযোদ্ধারা নড়াইলে হানাদার বাহিনীর ঘাঁটির দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী শেখ আজিবর রহমান, এস এম ফজলুর রহমান জিন্নাহের নেতৃত্বে নড়াইল কলেজের দক্ষিণে মাছিমদিয়া গ্রামে সমবেত হয়ে পুলিশ-রাজাকারদের ওপর অতর্কিত হামলা চালালে এই যুদ্ধে তরুণ মুক্তিযোদ্ধা জয়পুরের মিজানুর রহমান হানাদার বাহিনীর হাতে শহিদ হন।
মিজানুর রহমানের মৃতদেহ হানাদার বাহিনীর দোসররা হাত-পা বেঁধে বাঁশে ঝুলিয়ে রাখে। পরে নড়াইল শহর প্রদক্ষিণ করে কৃতিত্ব দেখায় এবং ছবি তোলে। এ ঘটনার পর ৯ ডিসেম্বর রাতে বিজয়ের তীব্র আকাঙ্ক্ষা নিয়ে কমান্ডার ফজলুর রহমান জিন্নাহ, আমির হোসেন, উজির আলী, শরীফ হুমায়ুন কবীর, আ. হাই বিশ্বাসের নেতৃত্বে বর্তমান নড়াইল সরকারি ভিক্টোরিয়া কলেজের দক্ষিণ দিক থেকে আক্রমণ চালায়। তবে পাল্টা আক্রমণে বাগডাঙ্গা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা মতিয়ার রহমান শহিদ হন। এ সময় শহরের পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাংলোতে অবস্থানরত ৪০ জন পাক মিলিটারিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিলে তারা অস্বীকার করেন। এ সময় মুক্তি বাহিনীর সদস্যরা চারদিক থেকে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ শুরু করলে পাক মিলিটারিরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়। এখানে কয়েকজন পাক মিলিটারি নিহত হয় এবং অন্যদের জেলহাজতে পাঠানো হয়।
প্রবল ঠাণ্ডাকে উপেক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধারা সারা রাত শহরে বিজয় উল্লাস করতে থাকে ও জয় বাংলা সে্লাগানে শহর মাতিয়ে তোলে এবং ১০ ডিসেম্বর সকালের দিকে নড়াইলকে পাক হানাদার মুক্ত ঘোষণা করা হয়। পরে মুক্তি পাগল হাজারো জনতার উপস্থিতিতে ডাকবাংলো প্রাঙ্গণে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ