বধ্যভূমি। নামটি একদিকে যেমন মুক্তিকামী বাঙালির ত্যাগের প্রতীক তেমনি এটি একই সাথে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতার বাস্তব প্রমাণ।
যুদ্ধকালীন যখন মানুষ জীবন বাঁচানোর তাগিদে সীমান্ত পাড়ি জমাচ্ছিল ঠিক তখন কিছু বাঙালি তার মাতৃভূমির টানে ৫৬ হাজার বর্গমাইলকেই আপন করে নিয়েছিল। পরিণামে তারা পেয়েছিল পৃথিবীর নির্মম মৃত্যুর স্বাদ। তবে এই সাহুসে বাঙালির স্মৃতির সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হাজারো বধ্যভূমি। যা আজও স্মৃতিতে অমলিন।
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির তথ্যমতে, এদেশে প্রায় ৯৪২টি বধ্যভূমি রয়েছে। এরমধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে ১১৬টি স্থানকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বধ্যভূমি হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। যারমধ্যে কুমিল্লা জেলা মুক্তিযোদ্ধা অফিসের তথ্যমতে, ৩২টিই কুমিল্লার।
কুমিল্লার বধ্যভূমিগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো- সদর উপজেলার রসুলপুর বধ্যভূমি, রামমালা বধ্যভূমি, নাঙ্গলকোট বধ্যভূমি, দেবিদ্বার বধ্যভূমি, লাকসামের বেলতলী বধ্যভূমি, কুমিল্লা সেনানিবাসের এমআর চৌধুরী গ্রাউন্ডের পাশের বধ্যভূমি ও কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় বধ্যভূমি, চিতোষী খেয়াঘাট বধ্যভূমি।
রসুলপুর বধ্যভূমি : কখনো নিজের কবর নিজেকে খুঁড়তে শুনেছেন! মনে হতে পারে এও সম্ভব। হ্যাঁ সম্ভব। কুমিল্লা শহর থেকে পাঁচ কি.মি. দূরে অবস্থিত রসুলপুরগ্রামে এভাবেই পাঁচশতাধিক নারী পুরুষকে দিয়ে নিজের কবর খুঁড়িয়ে কবরের সামনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়। এরপর তা কোনোরকম মাটি চাপা দেয়া হয়।
রামমালা বধ্যভূমি : নগরীর রামমালা এলাকায় অবস্থিত সার্ভে ইন্সটিটিউটের ভিতরে পুকুর পাড়ে রয়েছে একটি বধ্যভূমি। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ ভোর ৬টার দিকে প্রথমে পাক হানাদার বাহিনী যখন রামমালা এলাকায় আক্রমণ চালায় তখন ওই এলাকার অনেক মানুষ সার্ভে ইন্সটিটিউটের ভেতরে আশ্রয় নেয়। তখন পাকিস্তানি সেনারা ব্রাশ ফায়ার করে গণহারে সাধারণ মানুষ, আনসারদের হত্যা করে। এরপর গর্ত করে গণকবর রচনা করে যায় হানাদার বাহিনী। স্থানীয় সূত্র মতে, এই বধ্যভূমিতে রয়েছে কমপক্ষে ৫শ’ লোকের সমাধি।
নাঙ্গলকোট বধ্যভূমি : নাঙ্গলকোটের পরিকোট বধ্যভূমিতে নোয়াখালী, নাঙ্গলকোট ও আশেপাশের অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নিমর্মভাবে হত্যা করে তিনটি কবরে গণ সমাহিত করে পাক হানাদার বাহিনী। এ বধ্যভূমিতে কতজনের মরদেহ সমাহিত হয়েছে তা অজানা রয়ে গেছে।
দেবিদ্বার বধ্যভূমি : দেবিদ্বার উপজেলা সদরের ডাক বাংলোর সামনে অবস্থিত বধ্যভূমিটি পাক হায়ানাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞের স্বাক্ষী । ১৯৭১ সালের ২৪ জুলাই পাক হায়ানারা মুরাদনগর উপজেলার বাখরাবাদ গ্রামে হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে ১৪২ জনকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এর মধ্যে অনেক নারীও নির্যাতনের শিকার হন। পরে আরও ১৯ জনকে ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে ওই গর্তে মাটি চাঁপা দেওয়া হয়েছিল।
বেলতলী বধ্যভূমি : ৭১ এর যুদ্ধকালীন সময়ে কুমিল্লার লাকসাম রেলওয়ে জংশনের পাশে দক্ষিণে বেলতলীর এ বধ্যভূমিতে কমপক্ষে ১০ হাজার বাঙ্গালিকে নির্মমভাবে হত্যার পর মরদেহ মাটি চাঁপা দিয়েছিল পাক হানাদার বাহিনী।
পাক সেনাদের নিষ্ঠুর নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের নিরব সাক্ষী লাকসাম রেলওয়ে জংশন কলোনির শ্রীধাম চন্দ্র দাশ তার মামা সুরেন্দ্র দাস ও উপেন্দ্র দাস জানান, পাক বাহিনী ওইসময় সিগারেট ফ্যাক্টরি থেকে নারী-পুরুষের হাজার হাজার মরদেহ নিয়ে বধ্যভূমিতে গর্ত করে মাটি চাঁপা দিয়েছে।
কুমিল্লা সেনানিবাসের এমআর চৌধুরী গ্রাউন্ডের পাশের বধ্যভূমি : ১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ কুমিল্লা সেনানিবাসে চলে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। কুমিল্লা সেনানিবাসে অবস্থানরত বাঙ্গালি সেনা কর্মকর্তা, সেনা সদস্য, সেনানিবাসে অবস্থানরত বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ এবং কুমিল্লা শহর থেকে ধরে নেওয়া ব্যক্তিবর্গসহ প্রায় ৫ শতাধিক লোককে সেনানিবাসে হত্যা করা হয়।
কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় বধ্যভূমি : সদরের পাচঁথুবী ইউনিয়নে কৃষ্ণপুর ধনঞ্জয় এলাকায় এ বধ্যভূমিটি অবস্থিত। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম দিকে দুপুরে এই এলাকায় বসবাসরত শিশু-নারী, কৃষকসহ ৩৭ জন সাধারণ মানুষকে ধরে এনে ব্রাশ ফায়ার করে নির্বিচারে হত্যা করে ঘাতক হানাদাররা।
চিতোষী খেয়াঘাট বধ্যভূমি: কুমিল্লার ডাকাতিয়া নদীর চিতোষী খেয়াঘাট বধ্যভূমিতে অনেক নারী-পুরুষকে হত্যা করে মাটি চাপা দেওয়া হয়েছিল।
স্থানীয় মানুষজন বলেন, মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসজুড়ে চলে এখানে হত্যাযজ্ঞ। এমন কোনো দিন নেই যেদিন এখানে হত্যাযজ্ঞ না চালানো হয়েছে।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ