১৪ ডিসেম্বর। পুরান ঢাকায় তখন সন্ধ্যা নেমেছে। আজকাল সন্ধ্যাগুলো বড় অদ্ভুত হয়ে দেখা দেয় বাংলার আকাশে। এমন বর্ণিল কিংবা আলো-আঁধারির সন্ধ্যায় মন উচাটন করে ওঠে মায়ায়, ভালোবাসায় কিংবা নতুন ভোরের প্রত্যাশায়। ঘরে ফেরা পাখিগুলোও বিষাদ অথবা হরষের ডানা মেলে উড়ে যায় নীড়ে। শঙ্কা আর মুক্তির দোলাচলে কায়েতটুলির একটি বাসা দুলছে। বাসায় বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সার মোমবাতি জ্বালিয়ে ব্যস্ত আছেন কাজে। তখন তার স্ত্রী পান্না কায়সার শিশু কন্যাকে ফিডারে দুধ খাওয়াচ্ছেন। ঠিক এমন সময় দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ হলো। শহীদুল্লা কায়সারের ছোট ভাই ওবায়দুল্লা এসে বললেন, ‘বড়দা দরজায় কে যেন কড়া নাড়ছে খুলে দেব?’
বললেন, ‘নিশ্চয়ই মুক্তিযোদ্ধারা হবে। জলদি দরজা খুলে দে।’ তিনি নিজেও আলমারি খুলে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য সংগৃহীত অর্থ গুণতে লাগলেন। কিন্তু না। মুক্তিযোদ্ধারা এলেন না। এলেন কালো কাপড়ে মুখ জড়ানো চার- পাঁচজন তরুণ। বলল, ‘শহীদুল্লা কায়সার কে?’ জবাবে শহীদুল্লা কায়সার বললেন, ‘আমিই শহীদুল্লা কায়সার। কী দরকার বলুন?’
তখন একজন বলল, ‘আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে একটু ’ বলে তাকে ধরলো। এর মধ্যে তার বোন ও স্ত্রী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনারা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?’ জবাবে তরুণরা সিঁড়ি ভেঙে নামতে নামতে বলল, ‘তাকে কিছুক্ষণ পর আমরা ছেড়ে দেব।’
কিন্তু সেই যে গেলেন আর ফিরে এলেন না শহীদুল্লা কায়সার। যাওয়ার আগে শুধু একবার হালকা গলায় বললেন ‘ভালো থেকো।’
স্ত্রী পান্না কায়সারের সঙ্গে শহীদুল্লাহ কায়সার।
এর আগেও একবার সিগারেটের প্যাকেটের উল্টোপাশে স্ত্রীকে লিখে ছিলেন, ‘প্রিয়তমা সুপান্না কায়সার, আমার ছেলে-মেয়েগুলোকে তুমি যত্নে রেখো। আমি জানি, তুমি পারবে। তুমি ভালো থেকো। আমি কখনো কোথাও তোমার কাছ থেকে হারিয়ে যাবো না।’
শহীদুল্লাহ কায়সারের জন্ম ফেনীর মজুপুরে, ১৯২৭ সালে। পিতা মাওলানা মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহ আর মাতা সৈয়দা সুফিয়া খাতুন। বাবা-মা নাম রেখে ছিলেন আবু নঈম মোহাম্মদ শহীদুল্লা। কিন্তু তিনি শহীদুল্লা কায়সার নামে পরিচিত। ১৯৪২ সালে প্রবেশিকা উত্তীর্ণ হয়ে ভর্তি হন প্রেসিডেন্সি কলেজে। প্রেসিডেন্সি কলেজে অর্থনীতি পাশের পর অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর করেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে। একইসঙ্গে চালিয়ে গেছেন রিপন কলেজে আইনের পড়াশোনা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে এমএ শেষ করতে ভর্তি হলেও পড়াশোনা শেষ করতে পারেননি।
শহীদুল্লা কায়সার বিয়ে করেছিলেন পশ্চিমবঙ্গের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য জোহরা বেগমকে। কিন্তু জেলে যাওয়ার পর স্বামীর মুক্তি অনিশ্চিত জেনে জোহরা কলকাতায় ফিরে যান ও আইনিভাবে দুজনের তালাক সম্পন্ন হয়। ১৯৬৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিয়ে করলেন পান্না কায়সারকে। তাদের দুজনের সংসারে জন্ম নেন অমিতাভ কায়সার ও শমী কায়সার।
ছেলে অমিতাভ কায়সার ও মেয়ে শমী কায়সারের সঙ্গে শহীদুল্লা কায়সার।
১৪ বছরে বয়সে শহীদুল্লা কায়সার রাজনীতি শুরু করেন। যোগ দেন মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলনে। তবে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দেওয়ার মধ্য দিয়ে রাজনীতিতে পুরোদস্তুর প্রবেশ করেন। তার ৪ বছর পরে হন পার্টির সদস্য। পরবর্তীতে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য।
শহীদুল্লা কায়সারের পরিব্যাপ্তি ছিল ত্রিমুখী। একদিকে সাংবাদিকতা, একদিকে রাজনীতি আবার একদিকে সাহিত্যকর্ম। ‘দেশপ্রেমিক’ ছদ্মনামে রাজনৈতিক পরিক্রমা ও ‘বিশ্বকর্মা’ ছদ্মনামে বিচিত্রা কথা শীর্ষক উপ-সম্পাদকীয় রচনা যার প্রকৃষ্ট প্রমাণ। ভাষা আন্দোলনে রাজনৈতিক ভূমিকার কারণে ১৯৫২ সালের ৩ জুন তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন। বিচারে তাকে সাড়ে ৩ বছরের কারাদণ্ড হয়েছিল। ১৯৫৫ সালে মুক্তি পাওয়ার কিছুদের মধ্যেই তিনি ফের গ্রেফতার হন। ১৯৫৮ সালে তিনি মুক্তি পেলেন।
দৈনিক সংবাদের সম্পাদকীয় বিভাগে সহকারী সম্পাদক হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন ওই বছরই কিন্তু ৭ অক্টোবর সামরিক আইন জারি হওয়ার এক সপ্তাহের মধ্যে ১৪ অক্টোবর তাকে জননিরাপত্তা আইনে ফের গ্রেফতার করে আইয়ুব সরকার। এরপর তিনি মুক্তি পেলেন প্রায় ৪ বছর পরে ১৯৬২ সালের অক্টোবরে। কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ফের ফিরে এসেছিলেন দৈনিক সংবাদে।
সাহিত্যিক জীবনের সূচনা হয়েছিল জেলে বসেই। ছোটগল্প, রম্য, কবিতা, চিঠিপত্র অনেক কিছুই লিখেছেন। সারেং বউ আর সংশপ্তক তো আছেই। জীবনের শেষ উপন্যাস কবে পোহাবে বিভাবরী তার যুদ্ধ চলাকালে লেখা।
শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন, একজন বুদ্ধিজীবী। স্বাধীনতার প্রশ্নে মৃত্যুকে বরণ করতে সদা প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালরাত্রির গণহত্যার পর যখন বহু শিল্পী, বুদ্ধিজীবী ও সাহিত্যিক দেশ ছেড়ে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন, নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য হন্নে হয়ে ঘুরেছেন, তখন শহীদুল্লা কায়সার ছিলেন ঢাকায়। কাজ করছেন দৈনিক সংবাদে।
২৫ মার্চ কালরাত্রে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী পুড়িয়ে দিল দৈনিক সংবাদের অফিস। এসময় অনেকেই তাকে বলেছিলেন দেশ ছেড়ে চলে যেতে। অনেকে বললেন, এই মুহূর্তে দেশে থাকা আপনার উচিত নয়। আপনি ভারতে চলে যান। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে আবার ফিরে আসবেন। ওরা কাউকেই রাখবে না।
তিনি নিজেও শুনেছিলেন ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘটনা। কমরেড মনি সিংহ বলেছিলেন, এই মুহূর্তে তোমার থাকা আর ঠিক না। ভারত থেকেও কাজ করা যাবে। জবাবে তিনি স্পষ্টভাবে বলেছিলেন ‘সবাই যদি চলে যায় মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য করবে কে?’
মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের জন্য থেকে গেলেন এই দেশে। পুরান ঢাকায়। যখন পাক বাহিনীর দোসররা তার ঘরের দরজায় কড়া নামছিল মৃত্যুর বার্তা নিয়ে, তখনো তিনি ভাবছিলেন, হয়তো মুক্তিযোদ্ধরা এসেছে। তাদের সহযোগিতা করতে হবে। তাদের দেওয়ার জন্য গুণছিলেনও জমানো টাকা।
এই সেই বাসা, যেখান থেকে শহীদুল্লা কায়সারকে তুলে নেওয়া হয়েছিল।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তার মতো কমিউনিস্ট, বিপ্লবী লেখক ও সাংবাদিকের বিপদ হওয়াটা খুব স্বাভাবিক ছিল জেনেও দেশের বাইরে যাননি তিনি। তার কারণে তার পরিবারকে নানা জায়গায় পালিয়ে বেড়াতে হয়েছে। অনেকেই দেশের বাইরে যাওয়ার আগে নিজেদের রেশন কার্ড সুফিয়া কামালের হাতে দিয়ে গিয়েছিলেন। সুফিয়া কামাল সেগুলো দিয়ে রেশন সংগ্রহ করে রাখতেন। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতেন শহীদুল্লা কায়সার। তার দুই বাচ্চাই তখন ছোট শিশু। তাদের জন্য দুধ কম কিনে মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার কিনতেন তিনি। স্ত্রীকে বলতেন, বাচ্চাদের দুধের বদলে চাল বেঁটে খাওয়াতে।
শহীদুল্লা কায়সার জানতেন তার স্বজাতির অগ্রসর মানুষ হিসেবে তার দিকে তার স্বজাতি তাকিয়ে থাকে। তার সারা জীবনের কর্ম আর সৃজনশীলতা দিয়ে তিনি সেই তাকিয়ে থাকার মূল্য দিয়েছিলেন। এই মূল্য এমনকি তিনি নিজের জীবন দিয়ে দিতে পিছ–পা হননি।
রায়েরবাজার বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের অনেকের লাশ চিহ্নিত করা গেলেও পাওয়া যায়নি শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের লাশ। কেউ জানে না কোথায় রাখা হয়েছে তার লাশ। এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধা আর অনেক বুদ্ধিজীবীদের কবরের মধ্যে তারটাও আছে। তাতে কিছু যায়-আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে।
নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ