স্বাধীনতার ৫২ বছর পরও অরক্ষিত ও অবহেলায় পড়ে আছে নেত্রকোনার অন্তত ১৩টি বধ্যভূমি। নেয়া হয়নি রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ। অরক্ষিত বধ্যভূমিগুলোতে নির্মাণ করা হয়নি কোন স্মৃতিসৌধ কিংবা স্মৃতিফলক। বর্তমান সরকারের উন্নয়নের ধারায় দেশের অনেক পরিবর্তন হলেও নেত্রকোনার বধ্যভূমিগুলোর তেমন কোনও পরিবর্তন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারাসহ অনেকেই।
স্থানীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক, ইতিহাসবিদ ও শহীদ পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ছোট-বড় ২১টি বধ্যভূমির সন্ধান জানা গেছে।
এগুলো হচ্ছে- জেলা সদরের মোক্তারপাড়া এলাকার মগড়া নদীর ব্রীজ, সাতপাই কালীবাড়ি মোড় সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর, চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর, চল্লিশা রেল ব্রীজ, ঠাকুরাকোনা ব্রীজ, পূর্বধলা উপজেলার ত্রিমোহনী ব্রীজ, পুকুরিয়াকান্দা, জারিয়া রেলস্টেশন সংলগ্ন কংস নদীর তীর, রাজপাড়া গ্রামের ডা. হেম বাগচীর বাড়ির আঙ্গিনা, দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি গ্রাম সংলগ্ন সোমেশ্বরী নদীর তীর, গাওকান্দিয়া, কেন্দুয়া উপজেলার ঘোড়াইল, ধূপাগাতি গ্রাম, কেন্দয়া সদরের ভূমি অফিস সংলগ্ন বাজী নদীর তীর, কেন্দুয়া বাজার, বারহাট্টা উপজেলার লাউফা গ্রাম, মোহনগঞ্জ উপজেলা সদরের স্মশানঘাট, সাপমরা খাল, কলমাকান্দা উপজেলার থানা এলাকার উব্দাখালি নদীর ঘাট, নাজিরপুর বাজারের দই মহাল ও আজগড়া গ্রাম।
জেলার ইতিহাসবিদ আলী আহম্মদ খান আইয়ূব জানান, ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল থেকে ৯ ডিসেম্বর পর্যন্ত এসব বধ্যভূমি সমূহে ৩২১ বার গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে এসব গণহত্যার শিকার হয়েছিল প্রায় ১০ হাজার বাঙ্গালী নারী-পুরুষ।
তিনি আরও জানান, ৭১’র ২২ সেপ্টেম্বর গভীর রাতে পূর্বধলার ত্রিমোহিনী ব্রীজের ওপর একটি বড় হত্যাজজ্ঞ ঘটেছিল। সেদিন হানাদাররা সেখানে ২৭জন নিরিহ মানুষকে হাত বেঁধে সারিবদ্ধভাবে বসিয়ে গুলি করেছিল। এদের মধ্যে ২৬ জন মারা গিয়েছিলেন। অন্য একজন নেত্রকোনা শহরের উকিল পাড়ার বাসিন্দা প্রফুল্ল চন্দ্র সরকার তখন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলন।
সেদিনকার ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী প্রফুল্ল সরকার (৭৪) বলেন, ৭১’র ২২ সেপ্টেম্বর পাকহানাদাররা আমাদেরকে ধরে নিয়ে গভীর রাতে ত্রিমোহিনী ব্রীজের ওপর হাত বেঁধে বসিয়ে গুলি করে। তখন গুলিবিদ্ধ হয়ে সুরেন্দ্র চন্দ্র সাহা রায়, কামিনী কুমার চক্রবর্তী, নিশিকান্ত সরকার, সুরেন্দ্র চন্দ্র দে, কমল চন্দ্র সাহা, সুনীল চন্দ্র সাহা, সতীশ চন্দ্র সরকার, দুর্গানাথ চক্রবর্তী, ব্রজেন্দ্র চন্দ্র সরকার, মতিলাল সাহা (১), মতিলাল সাহা (২) পীযুষ কান্তি সাহা, দীপক কুমার সাহা, দিলীপ কুমার পাল, সন্তোষ চন্দ্র পাল (১), সন্তোষ চন্দ্র পাল (২), রমেন্দ্র নারায়ণ চক্রবর্তী, অজিত কুমার সাহা, সতীশ চন্দ্র সাহা, স্বদেশ দত্ত, যোগেন্দ্র চন্দ্র সরকার, বিনন্দ চন্দ্র দে, মনীন্দ্র চন্দ্র সাহা, বিনয়ভূষণ সরকার ও দীনেশ চন্দ্র সরকারসহ ২৬জন মারা যায়। এ সময় হানাদাররা মনে করেছিল আমিও গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা গেছি। কিন্তু আমার গায়ে তখন গুলি লাগেনি। তবে গায়ে গুলি না লাগলেও মারা যাবার ভান করে ব্রীজের ওপর লুটিয়ে পড়েছিলাম। এক পর্যায়ে হানাদাররা রাতেই এখাকার সব কটি লাশ ব্রীজের নীচে নদীতে ফেলে দেয়। সাথে আমাকেও ফেলে দিয়ে এখান থেকে চলে য়ায় তারা। তখন নদীর অল্প পানিতে আমি দাড়ানোর সুযোগ পাই এবং রশিতে বাঁধা হাতের বাঁধ খুলে পাশের একটি বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাই। তার পরের দিন নেত্রকোনায় বাসায় ফিরে আসি।
তিনি বলেন, গণহত্যার শিকার শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে এবং তাদের স্মৃতি রক্ষায় জেলার যেসব বধ্যভূমিতে স্মৃতিসৌধ কিংবা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি তার সব কটিতে তা নির্মাণ করা এখন সময়ের দাবি।
নেত্রকোনা জেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের সাবেক কমান্ডার ও বীর মুক্তিযোদ্ধা হায়দার জাহান চৌধুরী বলেন, ‘স্বাধীনতার এতো বছরেও কেন জেলা শহরের মোক্তারপাড়া ব্রীজ সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর, সাতপাই এলাকায় মগড়া নদী তীর, চন্দ্রনাথ উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন মগড়া নদীর তীর, কেন্দুয়া উপজেলার ধোপিগাতি, ঘোড়াইল, বাজী নদীর তীর, দুর্গাপুর উপজেলার বিরিশিরি, পূর্বধলার ত্রিমোহনী এলাকার বধ্যভূমি ছাড়া নেত্রকোনার অন্যান্য বধ্যভূমিসমূহে স্মৃতিসৌধ কিংবা স্মৃতিফলক নির্মাণ করা হয়নি তা আসলে অবাক করার মত বিষয়’। আমরা চাই এসব স্থানে শহীদদের নাম সম্বলিত স্মৃতিসৌধ কিংবা স্মৃতিফলক দ্রুত নির্মাণ করুক প্রশাসন।
বুধবার (১৩ ডিসেম্বর) রাত ৯টার দিকে এ ব্যাপারে নেত্রকোনা জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিস বলেন, মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশনা পেলে বধ্যভূমিসমূহে কাজ করার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
নয়াশতাব্দী/জেডআই
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ