ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

আনোয়ার পাশা : স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন নক্ষত্র

প্রকাশনার সময়: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩:৩২ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩:৪৬
শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা

‘পুরোনো জীবনটা সেই পঁচিশের রাতেই লয় পেয়েছে। আহা, তাই সত্য হোক। নতুন মানুষ, নতুন পরিচয় এবং নতুন একটি প্রভাত। সে আর কতো দূরে? বেশি দূর হতে পারে না। মাত্র এ রাতটুকু তো! মা ভৈঃ। কেটে যাবে।’

শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা তার রাইফেল, রোটি, আওরাত বইয়ের শেষের দিকে এই আশার কথা লিখেছেন। বলেছেন স্বপ্নের কথা। নতুন প্রভাতের কথা। জানতে চেয়েছিলেন সে আর কত দূর! একদিন আঁধার কেটে ভোরের আলোয় পৃথিবী হেসেছে। জন্ম হয়েছে নতুন প্রভাতের। নতুন দিগন্তের। লাল-সবুজের পতাকার। সে আর বেশি দূরে ছিল না। তার শহিদ হওয়ার দুদিন পরই এ দেশের আকাশে স্বাধীনতার পতাকা পতপত করে উড়েছে। ভোর এনেছিলেন আনোয়ার পাশা, কিন্তু ভোর দেখা হলো না তার।

বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ প্রভাষক। ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঈসা খান রোডের বাসায় তিনি। এ সময় একটা গাড়ি এসে তার বাসার সামনে দাঁড়ায়। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ওরা আনোয়ার পাশাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। দেশ স্বাধীনের পর ২ জানুয়ারি তার মরদেহ পাওয়া যায় মিরপুরের বধ্যভূমিতে। আরও কয়েকজন শহীদ বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদ প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়। আনোয়ার পাশা ২৫ মার্চের হত্যাযজ্ঞ পেরোতে পারলেও পার হতে পারেননি ১৪ ডিসেম্বর।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে শহীদ বুদ্ধিজীবী আনোয়ার পাশা

আনোয়ার পাশার জন্ম মুর্শিদাবাদের বহরমপুর মহকুমার রাঙ্গামাটি চাঁদপাড়া ইউনিয়নের ডবকাই গ্রামে। বাংলা সন অনুযায়ী ২ বৈশাখ ১৩৩৫। তিনি ১৯৪৬ সালে মাদরাসা পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে কৃতকার্য হন। কিন্তু ১৯৪৮ সালে আইএ পরীক্ষা দিয়ে পাস করেন বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে। এরপর তিনি চলে আসেন রাজশাহী কলেজে। এখান থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক পাস করেন ১৯৫১ সালে এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যেই স্নাতকোত্তর সম্মাননা অর্জন করেন।

আনোয়ার পাশার কর্মজীবন শুরু মানিকচক হাই মাদরাসায় শিক্ষকতার মাধ্যমে। পরে তিনি ১৯৫৪ সালে ভাবতা আজিজিয়া হাই মাদরাসায় এবং ১৯৫৭ সালে সাদিখান দিয়ার বহুমুখী উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি পাবনা এডওয়ার্ড কলেজে প্রভাষক হিসেবে যোগ দেন এবং পরবর্তী সময়ে এ কলেজেরই বাংলা বিভাগের অধ্যাপক হিসেবে কর্মরত থাকেন।

১৯৬৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে অস্থায়ী প্রভাষক হিসেবে যোগদান করেন। পরে ১৯৬৯ সালে অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী অধ্যক্ষ থাকাকালে তিনি স্থায়ী প্রভাষক হন। ১৯৭০ সালে তিনি জ্যেষ্ঠ প্রভাষক পদে পদোন্নতি পান। মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত তিনি এখানেই কর্মরত ছিলেন। আনোয়ার পাশা ও মহসিনা খাতুন দম্পতি দুই ছেলের জনক।

স্ত্রী মহসিনা খাতুন ও দুই সন্তানের সঙ্গে আনোয়ার পাশা

বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাসটির নাম রাইফেল, রোটি, আওরাত। বন্দিশিবিরের ভয়াবহতার মধ্যে বসে আশার অভয়বাণী শোনানোর এমন গল্প বিশ্বসাহিত্যে বিরল। এই কাজটিই করেছেন আনোয়ার পাশা রাইফেল, রোটি, আওয়াত গ্রন্থে। ২৫ মার্চের গণহত্যা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষক-কর্মচারীদের হত্যার নির্মম কাহিনী, বিশ্ববিদ্যালয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষের শিক্ষকদের বিশ্বাসঘাতকতার কথা, মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের নানাভাবে সহযোগিতাকারী মানুষদের ত্যাগের গল্প, শহীদ পরিবারের সদস্যদের হাহাকার, চারপাশের মানুষের মননে-আচরণে সাম্প্রদায়িকতা-অসাম্প্রদায়িকতার দ্বন্দ্ব—সবই উঠে এসেছে এ উপন্যাসে।

যুদ্ধ চলার সময়ে আনোয়ার পাশা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের আর্থিকভাবে সাহায্য করেছেন। সেই সময় তিনি রেডিওতে অনুষ্ঠান করতেন। যে অনুষ্ঠান দেশের পক্ষে যায় না, সে অনুষ্ঠান তিনি করতেন না। প্রকাশ্য পাকিস্তানের বিরোধিতা করতেন তিনি। তার পরিবারের চেয়েও বড় হয়ে উঠেছিল বাংলাদেশ। আর তাইতো পরিবারের নিরাপত্তার কথা না ভেবে দেশের স্বাধীনতা নিয়েই উদ্বিগ্ন ছিলেন তিনি। দেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে তিনি আপস করেননি। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার এই অধ্যাপক লিখছেন দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্মান্তিক কিন্তু গৌরবময় সময়ের দলিল। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম উপন্যাস রাইফেল, রোটি, আওরাত

আনোয়ার পাশা ছিলেন কবি, ঔপন্যাসিক ও প্রাবন্ধিক। তার সাহিত্যকর্মে ফুটে ওঠে দেশাত্মবোধ, মননশীলতা এবং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তাচেতনা। তার সাহিত্য জীবনের সূচনা ছাত্রাবস্থায়। রাজশাহী কলেজে বিএ শ্রেণিতে পড়ার সময় তিনি হাস্নাহেনা শিরোনামে একটি রম্যরচনা প্রকাশ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত প্রথম উপন্যাস রাইফেল, রোটি, আওরাত রচনার জন্য তিনি মরণোত্তর স্বাধীনতা পদকে ভূষিত হন। এ ছাড়া তার উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্মের মধ্যে রয়েছে- উপন্যাস : নীড় সন্ধানী (১৯৬৮), নিশুতি রাতের গাথা (১৯৬৮)। কাব্য : নদী নিঃশেষিত হলে (১৯৬৩), সমুদ্র শৃঙ্খলতা উজ্জয়িনী (১৯৭৪), অন্যান্য কবিতা (১৯৭৪)।

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ