ঢাকা, রবিবার, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বর্বরতার সাক্ষী ‘খুনিয়া দিঘী’ বধ্যভূমি

প্রকাশনার সময়: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩:১১ | আপডেট: ১৪ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩:৫৫

ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার পৌর শহরের জিরো পয়েন্ট থেকে মাত্র সিকি মাইল দক্ষিণে পাকা রাস্তা সংলগ্ন এলাকায় অবস্থিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সময়ে পাকিস্তানি হানাদারদের নির্মম বর্বরতার সাক্ষী ‘খুনিয়া দিঘী’ বধ্যভূমি। যা এ জেলার তো বটেই দেশের বড় বধ্যভূমিগুলোর মধ্যেও একটি।

৬ একর আয়তনের এ খুনিয়া দিঘী প্রায় দুইশ’ বছর আগে স্থানীয় কোনও জমিদার খনন করেছিলেন। তৎকালীন আমলে এই এলাকার ব্যবসায়ীরা দিঘীর পাশ দিয়ে ব্যবসা করতে ভারতের রায়গঞ্জে যেতেন। দিঘি এলাকাটি নির্জন জঙ্গলাকীর্ণ ছিল। এখানে এক ব্যবসায়ীকে খুন করে দিঘীর পাড়ে ফেলে রাখা হয়েছিল। তখন থেকেই এর নাম হয়ে যায় খুনিয়া দিঘী।

ধারণা করা হয়, মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রায় কয়েক হাজার মানুষকে হত্যা করে এই দিঘীতে ফেলে রেখেছিল। বিজয়ের মাস ডিসেম্বর এলেই ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলা হানাদারদের সেই পাশবিক নির্যাতন ও হত্যাযজ্ঞের কথা স্মরণ করে শিউরে ওঠেন এখানকার মানুষ। সেসময় বিভিন্ন এলাকা থেকে স্বাধীনতাকামী নিরীহ লোকজনদের ধরে এনে এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে একটি শিমুল গাছের সঙ্গে হাতের তালুতে পেরেক ঠুকে ঝুলিয়ে রেখে রাইফেল ও বেয়নেট দিয়ে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালানো হতো। এরপর সেই হতভাগ্য নিরীহ মানুষগুলোকে দিঘীর পাড়ে দাঁড় করে ব্রাশফায়ার করতো হানাদার বাহিনী। তাদের দোসর রাজাকাররা লাশগুলো ভাসিয়ে দিত দিঘীর জলে। সেখানেই লাশগুলো পচে গলে পানির সঙ্গে মিশে যেত। হাজার লাশ আর রক্তে দিঘীর পানির রং সব সময়ই থাকতো লাল। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানি সেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় এলাকার তরুণী ও সুন্দরী নারীদের পিতা-মাতা এবং স্বামীর উপস্থিতিতেই ধরে এনে ক্যাম্পে আটকে রেখে চালাতো পাশবিক নির্যাতন। সেই স্মৃতি মনে হলে আজও শিউরে ওঠেন এখানকার মানুষ।

খুনিয়া দিঘীর পাড়ে পাক বাহিনীর নির্মম নির্যাতনের নিরব সাক্ষী সেই শিমুল গাছটি এখন ডালপালা বিস্তার করে বিরাট আকার ধারণ করেছে। শহীদদের স্মৃতি ধরে রাখতে ওই পুকুর পাড়ে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করা হয়েছে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন হানাদার বাহিনীর নিষ্ঠুরতম নির্যাতনের বর্ণনা করতে গিয়ে রাণীশংকৈল ডিগ্রি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ তাজুল ইসলাম বলেন, ‘পাকিস্তানি সেনারা আমার ভাই নজরুল ইসলামকে ধরে এনে এই খুনিয়া দিঘীতেই হত্যা করেছে। ক্যাম্পে আটকে রেখে ওরা সুন্দরী নারীদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালাত। এতে তাদের অনেকে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েছিলেন। দেশ স্বাধীনের পর তাদের অনেকের কোলে জন্ম নেয় পিতৃ পরিচয়হীন সন্তান। যাদের আর পুনর্বাসন করা হয়নি। এছাড়া খান সেনারা স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় পীরগঞ্জ, রাণীশংকৈল, হরিপুর উপজেলার কয়েক হাজার লোককে ধরে নিয়ে এসে রাণীশংকৈলের খুনিয়া দিঘীর পাড়ের একটি শিমুল গাছের সঙ্গে হাতের তালুতে পেরেক ঠুকে ঝুলিয়ে রেখে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর জানতে নির্যাতন চালায়। পরে হত্যা করে লাশ ভাসিয়ে দিতো এই খুনিয়া দিঘীর জলে।’

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান খুনিয়া দিঘীর বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, সেসময় পাকহানাদার বাহিনী সাজুয়া গাড়ি নিয়ে রাস্তায় টহল দিত যাকে যেখানে পেতো সেখান থেকে নিয়ে এসে খুনিয়া দিঘীতে নির্মম হত্যাযজ্ঞ চালাত। এছাড়া উপজেলার তৎকালীন রাণীশংকৈল প্রাথমিক বিদ্যালয় বর্তমান সরকারি মডেল স্কুলের ভবনের সামনেও তারা গণহত্যা চালাই‌। আনুমানিক ৭ বছর আগে শহীদদের স্মরণে সেখানে একটি স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও নলদিঘি, নেকমরদ সহ বিভিন্ন জায়গায় গ্রামে গ্রামে ঘুরে গণহত্যা চালায় তৎকালীন পাক হানাদার বাহিনী।

যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবু সুফিয়ান আরও বলেন, প্রথম দিন পাকহানাদার বাহিনীরা রাণীশংকৈলে প্রবেশ করে বলিদ্বারার মহেন চন্দ্র, রাণীশংকৈলের ছাত্রনেতা মনসুর আলী এবং সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি নফিজ উদ্দীন মাস্টারকে ধরে তাদের সাজুয়া গাড়িতে করে কোথায় নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছে তার সন্ধান এখনো পাওয়া যায়নি।

বর্তমান দায়িত্বপ্রাপ্ত উপজেলা মুক্তিযোদ্ধার ভারপ্রাপ্ত কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা হবিবর রহমান বলেন, খুনিয়া দিঘীর কথা মনে হলে এখনো চোখে পানি চলে আসে। তৎকালীন পাকবাহিনী মুক্তিকামী সাধারণ মানুষদের উপজেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে নিয়ে এসে প্রথমে পাশবিক নির্যাতন চালাত। এক পর্যায়ে সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করিয়ে ব্রাশ ফায়ারের মাধ্যমে হত্যা করে এ খুনিয়া দীঘিতে ফেলে দিত। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পরেও দুই থেকে তিন মাস পুকুরের পানি লাল বর্ন ধারণ করেছিল। পরবর্তীতে পুকুর থেকে হাড়গোড় উঠিয়ে বর্তমানে যেখানে স্মৃতিসৌধ আছে সেই স্থানে পুঁতে রাখা হয়েছে।

খুনিয়া দীঘি নিয়ে বলতে গিয়ে স্থানীয় বাসিন্দা নূর বকস জানান, রাজাকারদের সহযোগিতায় পাকবাহিনী হরিপুর সহ বিভিন্ন জায়গা থেকে মানুষ ধরে নিয়ে এসে কখনো ৫ জন, কখনো ৭জন এবং ১০ জন মানুষকে এক রাত রেখে পরের দিন সকাল ১০ টায় লাইনে দাঁড় করিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে দিঘীর পানিতে ফেলে দিত।।

প্রসঙ্গত, প্রতি বছর ১৬ই ডিসেম্বর ও ২৬ শে মার্চ রাত ১২টা এক মিনিটে তোপধ্বনির পর ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানানো হয় খুনিয়া দিঘীর শহীদদের।

নয়াশতাব্দী/জেডআই

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ