দ্রোহ ও প্রেমের কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর জন্মদিন আজ। তিনি প্রেম ও দ্রোহ, স্বপ্ন ও বিপ্লবের কথা কবিতায় লিখেছেন সমানভাবে। কাব্যচর্চার পাশাপাশি সংগীত, নাটক, ছোটগল্পেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি বৈষম্যহীন সমাজব্যবস্থার স্বপ্ন দেখতেন।
প্রেম ও দ্রোহ
‘জাতির পতাকা আজ খামচে ধরেছে সেই পুরোনো শকুন।’ কিংবা ‘ভুল মানুষের কাছে নতজানু নই।’— এই নির্মম সত্য দৃঢ় প্রত্যয় আর বলিষ্ঠ কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। প্রেমিকার কাছে আকুল কণ্ঠে বলেছেন, আকাশের ঠিকানায় চিঠি দিতে—‘ভালো আছি ভালো থেকো, আকাশের ঠিকানায় চিঠি লিখো।’ কিংবা প্রিয় মানুষটার কাছে খুব বেশি কিছু চাননি। চেয়েছেন কিছু একটা, সেটা ভুল কিংবা মিথ্যে প্রবোধ। ‘অভিমানের খেয়া’ কবিতায় কবি লিখেছেন,
‘নির্মম ক্লেদে মাথা রেখে রাত কেটেছে প্রহর বেলা-
এই খেলা আর কতোকাল আর কতটা জীবন!
কিছুটাতো চাই- হোক ভুল, হোক মিথ্যে প্রবোধ,
অভিলাষী মন চন্দ্রে না-পাক, জোৎস্নায় পাক সামান্য ঠাঁই,
কিছুটাতো চাই, কিছুটাতো চাই।’একজন রুদ্র
১৯৫৬ সালের ১৬ অক্টোবর বরিশাল আমানতগঞ্জ রেডক্রস হাসপাতালে জন্মগ্রহণ করেন রুদ্র। তাঁর মূল বাড়ি বাগেরহাটের মোংলা উপজেলার মিঠাখালীর সাহেবের মাঠ গ্রামে। বাবার নাম ডা. শেখ ওয়ালিউল্লাহ ও মায়ের নাম শিরিয়া বেগম।
ছাত্রজীবনে লেখালেখি শুরু রুদ্রর। তার লেখাপড়ায় হাতেখড়ি আর লেখালিখিতে আগ্রহ দুটোই তৈরি হয় এই নানাবাড়িতে। সে সময় ঢাকার বিখ্যাত ‘বেগম’ আর কলকাতার ‘শিশুভারতী’ পত্রিকা আসতো তার নানাবাড়িতে। তার দুটি কবিতা উপদ্রুত উপকূল (১৯৭৯) ও ফিরে চাই স্বর্ণগ্রাম (১৯৮১) প্রকাশিত হয়। এ কবিতা দুটিই তাকে খ্যাতি এনে দেয়। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহর কাব্যগ্রন্থের মধ্যে মানুষের মানচিত্র (১৯৮৪), ছোবল (১৯৮৬), গল্প (১৯৮৭), দিয়েছিলে সকল আকাশ (১৯৮৮), মৌলিক মুখোশ (১৯৯০), একগ্লাস অন্ধকার (১৯৯২) উল্লেখযোগ্য।
হইচই ফেলে দিয়েছিলেন
টালমাটাল সত্তরের দশকে সমাজ ও রাজনীতির উত্থান-পতনে ত্যাগ ও প্রাপ্তি, ধ্বংস আর নির্মাণ, প্রত্যাশা আর আশাভঙ্গের অনিবার্য অস্থিরতার সময়টিতে যারা কলম চালিয়েছিলেন, যারা সেই সময়টাকে আত্মোপলব্ধি ও সৃষ্টিশীল উন্মাদনার দ্বারা এক চিরন্তন প্রতীতি প্রদান করেছেন, তাদের মধ্যে অন্যতম, কবি রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ। রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ হইচই ফেলে দিয়েছিলেন ‘বাতাসে লাশের গন্ধ’ কবিতা লিখে।
‘আজো আমি বাতাসে লাশের গন্ধ পাই
আজো আমি মাটিতে মৃত্যুর নগ্ননৃত্য দেখি,
ধর্ষিতার কাতর চিৎকার শুনি আজো আমি তন্দ্রার ভেতরে…
এ দেশ কি ভুলে গেছে সেই দুঃস্বপ্নের রাত, সেই রক্তাক্ত সময়?
বাতাসে লাশের গন্ধ ভাসে
মাটিতে লেগে আছে রক্তের দাগ।’রুদ্র ও তাসলিমা
রুদ্র বিয়ে করেন ২৯ জানুয়ারি, ১৯৮১ সালে। স্ত্রীর নাম লীমা নাসরিন। পরবর্তীকালে তিনি তসলিমা নাসরিন নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন ও নিজের বিতর্কিত লেখালেখির জন্য আলোচিত হন। রুদ্র বিয়ে করেছিলেন সামাজিক প্রথা ভেঙে, অভিভাবকের অমতে। রুদ্র-তসলিমার দাম্পত্য জীবন ভালোই কাটছিল। রুদ্রের উৎসাহ ও প্রেরণায় তসলিমাও পুরোপুরি জড়িয়ে যান লেখার জগতের সঙ্গে। কিন্তু রুদ্র-তসলিমার এই সুখের সংসার স্থায়ী হয়নি। ছয় বছর দাম্পত্য জীবন শেষে তারা আলাদা হয়ে যান। ১৯৮৬ সালে উভয়ের সম্মতিতে তালাক হয়।
রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ ও তসলিমা নাসরিন - ছবি - সংগৃহীত
অনিয়ন্ত্রিত জীবন
তুখোড় ধূমপান ও মদ্যপান, খাবারে অনিয়ম সব মিলিয়ে বাঁধিয়েছিলেন পাকস্থলীর আলসার। পায়ের আঙুলে হয়েছিল বার্জার্স ডিজিজ। গুরুত্ব তিনি কখনোই দেননি এসবকে। জীবনের শেষ পর্যায়ে তিনি নিয়মিত আসতেন নীলক্ষেত-বাবুপুরায় কবি অসীম সাহার ‘ইত্যাদি’-তে। অসীম সাহার কাছ থেকেই সবাই জানতে পারেন রুদ্র পেপটিক আলসার বাঁধিয়ে হাসপাতালে।
চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়
১৯৯১ সালের ২১ জুন ঢাকায় মৃত্যু হয় এই কবির। ২২ জুন রুদ্র মুহম্মদ শহিদুল্লাহ চলে যান অন্তিমশয়ানে তার চিরচেনা, শৈশবের স্মৃতিধন্য, মংলার মিঠেখালিতে।
‘চলে যাওয়া’ শব্দটি কানে বাজলেই বেজে ওঠে রুদ্রর কবিতা—
“চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়- বিচ্ছেদ নয়
চলে যাওয়া মানে নয় বন্ধন ছিন্ন-করা আর্দ্র রজনী
চলে গেলে আমারও অধিক কিছু থেকে যাবে আমার না-থাকা জুড়ে।”নয়া শতাব্দী/আরআর
মন্তব্য করুন
আমার এলাকার সংবাদ