ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

‘মিসড ইউ মার্জিনালি’

প্রকাশনার সময়: ৩১ অক্টোবর ২০২৩, ২১:৪৪

ওদের ইউনিভার্সিটি বন্ধুদের ভিডিও গ্রুপ কল এই একটু আগেই শেষ হলো মাত্র। অর্পা শুরুর দিকে জয়েন করে কিছুক্ষণ বন্ধুদের সাথে গল্প করল ,হাসা হাসি, বেশ মজা হলো আজ দীর্ঘদিন পর। শিহাব তখনও জয়েন করেনি কলে। অর্পা নিজের অজান্তেই হয়ত ইতিউতি তাকাচ্ছিল। মনে মনে একটু হলেও আশা ছিল, ইচ্ছে ছিল শিহাব জয়েন করলে বহু বছর পরে বাস্তবে না হোক, ভার্চুয়ালি হলেও শিহাবের সাথে দেখা হবে। কিন্তু গল্প, আড্ডায়, হাসাহাসিতে দেখতে দেখতে আধা ঘণ্টা পেরিয়ে গেল। শিহাব জয়েন করল না। অর্পা মনে মনে ভাবল, কী হতে পারে শিহাবের? অনেকদিন থেকেই তো ওদের মেসেঞ্জার গ্রুপে কথা হচ্ছিল, আজ ওদের ভিডিও কল আড্ডা হবে, দেশ-বিদেশ থেকে বন্ধুরা জয়েন করবে, শিহাবও গ্রুপে বেশ আগ্রহ দেখিয়েছিল। তাহলে ওর জয়েন না করার কি কারণ হতে পারে? ইচ্ছে করেই কি শিহাব এমনটি করল? নাকি কোনো কাজে বিজি সে ? এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে অর্পার মনটা বিষণ্ণ হয়ে পড়ল। বন্ধুদের অর্পা বলল, ‘তোরা কথা বল, আমার একটু জরুরি কাজ আছে।’

‘কি ব্যাপার এখনই লিভ নিবি? এত তাড়াতাড়ি? কতদিন পরে তোকে দেখলাম বল তো ! তুই কিন্তু আগের মতোই সুন্দরি আর এখনও কি ইয়াং লুকিং মাশাল্লাহ!’ আমেরিকা থেকে অর্পাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু মিতা বলল ।

‘নারে ,আজ আসি । আবার কথা হবে ,দেখা হবে ইনশাল্লাহ। তোরা ভালো থাকিস’ বলে অর্পা জুম লিংক থেকে বেরিয়ে যেতেই দেখে শিহাব জয়েন করল তখনই লিংকে। ইশ, একটু আগে হলেই দেখা হত, কথা হত। এখন কি করবে সে? অর্পা মনে মনে ভাবে। চাইলে একটু পরেই কোন কাজের উসিলায় আবার জয়েন করা যায়, দেখা যায়। কিন্তু থাক ওরা ওরাই গল্প করুক। ভেবে অর্পা মোবাইল হাতে অন্য কাজ করতে থাকে, একটু ফেসবুকেও ঢু মারে। কিচেনে গিয়ে এক মগ গ্রিন টি বানিয়ে নিয়ে আসে। চায়ে চুমুক দিতে দিতেই অর্পা দেখে ওদের গ্রুপ কল শেষ। সেদিকে একটু লক্ষ্য করতেই অর্পার মেসেঞ্জারে একটি ক্ষুদে বার্তা ভেসে আসে, ‘মিসড ইউ মার্জিনালি!’

ক্ষুদে বার্তাটি পাঠিয়েছে আর কেউ নয়; শিহাব!

ওটুকু মাত্র কথা, তিনটে মাত্র শব্দ আর কিছুই নেই । এর চেয়ে বেশি কিছু লেখাটা ওর একদমই স্বভাব বিরুদ্ধ ।

অর্পাও খুব ছোট করেই উত্তর দেয়, ‘আ্যাজ ইউ অলয়েজ লাভ টু ডু দ্যাট!’ সাথে সাথেই শিহাব সিন করেছে মেসেজটা দেখা গেল কিন্তু এরপর আর কোনো উত্তর নেই। উত্তর চায়ও না অর্পা। আশাও করে না সে কোন কিছু শিহাবের থেকে ।

অর্পার মন নিমিষেই হারিয়ে যায় আজ থেকে সেই পঁচিশ বছর আগে। যখন ওরা ঢাকা ইউনিভার্সিটির সোশ্যাল সাইনসের স্টুডেন্ট ছিল। শিহাব বরাবরই অসম্ভব মেধাবী আর ভীষণ পড়ুয়া টাইপের ছেলে ছিল। শত ভাগ ‘বুকিশ বয়’ যাকে বলে। আর অর্পা ছিল অনেকটাই আমুদে, চঞ্চলা হরিণীর মতো ঘুরে বেড়াত একদল বান্ধবীর সাথে। কথায় কথায় হেসে গড়িয়ে পড়া আর মজা করা, শুধুমাত্র পরীক্ষার আগ দিয়ে পড়ালেখায় সিরিয়াস হওয়া টাইপ মেয়ে। শুধু অর্পা কেনো ক্লাসের কোনো মেয়ের সাথেই অনেক কম কথা বলত শিহাব, যাও বলত সেটাও নেহায়েত প্রয়োজনেই ।

ওরা সেকেন্ড ইয়ারে পড়ার সময় একদিন অর্পা ইউনিভার্সিটিতে লাইট পিংকের মধ্যে সাদা লখনৌউ স্টিচের কাজ করা একটি সালোয়ার কামিজ পড়ে ভার্সিটি গিয়েছিল। সেদিন ওদের ক্লাস মেট, সিনিয়র, জুনিয়র অনেকেই অর্পাকে বলেছিল ভীষণ মানিয়েছে নাকি এই রঙটিতে ওকে। দুপুরের দিকে টিএসসিতে আড্ডা মারছিল ওরা বন্ধুরা। অর্পার হঠাৎ করেই চোখ পড়ে গিয়েছিল শিহাবের চোখে। সে চোখের ভাষা পড়া আজ পর্যন্ত কোনো তরুণীকে শিখে নিতে হয়নি। সে চোখে ছিল শুধুই মুগ্ধতার আর ভালোবাসার চাহনি। অর্পা নিমিষেই চোখ সরিয়ে ফেললেও তার পুরো শরীরে অদ্ভুত এক ভালোলাগার অনুরণন ছড়িয়ে পড়ল। শিহাব তার দিকে এভাবে তাকিয়ে কি দেখছিল? উফ, এত গভীর চাহনী শিহাবের! অনেক দিন গভীর রাতে ঘুম ভেঙে গেলেও এসব নানা কথা মনে হত অর্পার। অর্পার এই সদ্য তরুণী জীবনে ছেলেদের এমন মুগ্ধ দৃষ্টি তো আরও দেখেছে কিন্তু কেনো জানি শিহাব, শুধুই শিহাব ওর ভাবনায় আলোড়ন তুলে যায় ।

শিহাবের ভালোবাসাটা অনুভব করা যায় কিন্তু দেখা যায় না, বোঝা যায় না। বরাবরের অন্তর্মুখী শিহাব নিজেও জানে না কখন, কিভাবে সে অর্পাকে গভীরভাবে ভালোবেসে ফেলেছিল। অর্পার সবকিছুই ওর কাছে ভীষণ ভীষণ ভালো লাগত। অর্পার হাসি, অর্পার তাকানো, অর্পার কথা বলার স্টাইল, অর্পার চঞ্চলতা। হঠাৎ করেই সেদিনের সেই স্নিগ্ধ, শুভ্র, গোলাপী মেয়েটি এক বুকিস বয়ের’ হার্ট থ্রব’ হয়ে যায়। সবচেয়ে মজা হতো বন্ধুরা একসাথে কোথাও বেড়াতে গেলে বা টিএসসি/ চন্দ্রিমা উদ্যানের আড্ডাতেও শিহাব সব সময় অর্পার একদম মুখোমুখি বসত যাতে অর্পাকে সরাসরি দেখা যায়, দুজনের যাতে চোখাচোখি হয়। সেটি যে শিহাব ইচ্ছে করেই বসত সেটি অর্পা যেমন বুঝত তেমনি ওদের অন্য বন্ধুরাও বুঝতে পারত। এ নিয়ে কম হাসাহাসি, খেপানো, খুনসুটি হয়নি বন্ধুদের মধ্যে। এভাবে দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেলো ওদের ভার্সিটির তিনটি বছর।

অর্পার প্রতি শিহাবের নিখাদ ভালোবাসায় কোনো কমতি ছিল না আর অর্পাও নিজেও বুঝেনি কখন, কিভাবে শিহাব ওর মনের গভীরে আসন গেড়ে নিয়েছিল। মজার ব্যাপার হচ্ছে ওদের দুজনের চাক্ষুষ কথা যত না হত তার চেয়ে বেশি কাল্পনিক কথা হতো। ভালোবাসার মানুষটির সাথে মনে মনে, গুনগুন করে কথা বলা আসলেও অসাধারণ এক ঐশ্বরিক অনুভূতি। তবে সব কল্পনা যেমন বাস্তবে রূপ নেয় না তেমনই শিহাবের ও অর্পাকে সরাসরি আর প্রপোজ করা আর হয়ে ওঠে না। ফাইনাল পরীক্ষার পরে অর্পার মা-বাবা বিয়ের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে ওঠেন। চারদিকে অনেকগুলো ভালো ভালো বিয়ের প্রপোজাল আসে। অর্পার পিঠাপিঠি ছোট বোনেরও বিয়ের প্রস্তাব আসা শুরু হয়েছে কাজেই এখন আর অর্পার রাজি না হয়ে উপায় কি !

কোন এক ছুটির দিন অর্পাকে দেখতে এসেই জামানের মা আংটি পড়িয়ে দিয়ে গেলেন। জামান পেশায় ইঞ্জিনিয়ার, বুয়েট থেকে পাশ করা। এম এস করতে দেশের বাইরে যাবে আর এখন সরকারি চাকরিতে আছে। সুপাত্র বলতে যা বোঝায় একবাক্যে জামান ঠিক তাই। অর্পার আসলে বলার কিছুই ছিল না। অর্পা মানা করতে পারেনি। অর্পা নিশ্চুপ ছিল, শুধু ওর দুটো চোখের অবিরল বর্ষণে বিছানার বালিশ ভিজে গিয়েছিল। অর্পার এনগেজমেন্টের সপ্তাহ খানেক পরে ছিল পহেলা ফাল্গুন। টিএসসিতে পাশাপাশি হাটতে হাটতে শিহাব বাসন্তি শাড়ি আর খোঁপায় গাঁদা ফুলে অপরূপা অর্পাকে বলেছিল, কথা আছে তোমার সাথে।

আহা, যে কথাটি শোনার জন্য এতদিন আকুল হয়েছিল অর্পার দেহ-মন-প্রাণ এখন সেই কথাটি কি বলবে শিহাব? কিন্তু এত কাঙ্ক্ষিত কথাটি শুনতে বা শিহাবের বলতে একটু দেরি হয়ে গিয়েছিল। অর্পা আর কি করতে পারত ? অর্পার কিছুই করার ছিল না। একদম হুট করেই অর্পার বিয়ে হয়ে যায় জামানের সাথে। বিয়ের বছর দেড়েকের মধ্যেই মেয়ে নুহার জন্ম, অফিস, সংসার, বাচ্চা আস্তে আস্তে শিহাব স্মৃতি হতে। তখন অর্পা একটি প্রাইভেট ফার্মে কাজ করে। হঠাৎ করেই একদিন শিহাব আসে ওর অফিসে, একদমই আচানক, কিছুটা উদভ্রান্ত । অর্পা জিজ্ঞেস করে, কেমন আছো শিহাব ?

আমি পরশু অস্ট্রেলিয়া চলে যাচ্ছি অর্পা। যাওয়ার আগে ভাবলাম তোমার সাথে দেখা করে যাই ।

অর্পা কিছু বলে না শিহাবকে। কোনো উত্তর দেয় না, ভালো-মন্দ কোনো কথাই ওদের মধ্যে হয় না। অর্পার টেবিলে মুখোমুখি দু’জন নিঃশ্চুপ বসে থাকে ঘণ্টা দেড়েক প্রায়। অনেক সময় অনেক কথার চেয়েও নীরবতা বেশি কিছু বুঝিয়ে যায়, অনুভব করিয়ে যায়। অনুভূতির গভীরে স্পর্শ করে যায় ।

নীরবতা ভাঙে শিহাবই।

আসি অর্পা।

ভালো থেকো শিহাব, নিজের যত্ন নিও অস্ফুট স্বরে অর্পা বলে ।

শিহাব চলে যায় অর্পার অফিস থেকে, অর্পার জীবন থেকে। এরপর দু/ তিনবার শিহাবের সাথে দেখা হয় অর্পার বন্ধুদের গেট টুগেদারে। একসময় সাংসারিক ব্যস্ততায় সেটাতেও ছেদ পড়ে, আরেকটি মেয়ের মা হয় অর্পা। শিহাব ও বেশ পরে বিয়ে করে। সেও একটি ছেলের বাবা, এখন অস্ট্রেলিয়ার নাগরিক, বেশ ভালো অবস্থা তার ওখানে। ধুলো পড়া শিহাবের স্মৃতি আবার টাটকা হতে থাকে বছর দশেক আগে অর্পার ফেসবুকে শিহাবকে খুঁজে পেয়ে। যেদিন প্রথম শিহাব ওর ফ্রেন্ডলিস্টে আসে আর অর্পার সাথে সামান্য চ্যাট হয়, অর্পা আবার ফিরে যায় তার তারুণ্যের সেই দিনগুলোতে। ভুলে যায় সময়, দিনক্ষণ, মাঝের এতগুলো চলে যাওয়া বছর। মনে হয় শিহাব ওর চোখের সামনেই আছে, মুখোমুখি বসে, মাথাটি নিচু করে, পুরু ফ্রেমের চশমা চোখে দিয়ে। শিহাবকে একটু ছুঁয়ে দিতে খুব খুব ইচ্ছে করে অর্পার। অর্পা ডাকে, শিহাব .. শি.. হা .. ব .... শি...হা ...ব..!

অর্পা তুমি রেডি তো? আমি আসছি একটু পরেই। তোমাদের ডিনারে নিয়ে যাব আজ বাটন রোজে। জামানের ফোনে অর্পার সম্বিত ফিরে আসে ।

অর্পা আর শিহাবের ভার্চুয়াল যোগাযোগেরও পেরিয়ে গিয়েছে প্রায় দশটি বছর। ওরা দুজনেই জানে, ওরা একে অন্যের খুব ভালো বন্ধু। হয়তো অর্পা শিহাবের হতে পারত, কিন্তু হয়নি সেটা। বিধাতার ইচ্ছে ছিল না সেটা। ওরা মেনে নিয়েছে এই বাস্তবতা। তারপরেও মানুষের মন বলে কথা। এখনও ফেসবুক/মেসেঞ্জারে শিহাব নামটি দেখলেই অর্পার মন কেমন করে, শিহাবেরও তাই। শিহাবের নামের পাশে জ্বলতে থাকা সবুজ বাতি যেনো ওদের অপ্রকাশিত ভালোবাসার প্রজাপতি। ওদের দু’জনের ভালোবাসার প্রকাশ আজও নেই, ওদের উচ্ছাসের কোন জোয়ার কখনও ছিল না, আজও নেই। তবে তাতে ওদের মনে ভালোবাসার কমতি হয়নি কখনই ।

শিহাবকে এখনও অনলাইনে দেখা যাচ্ছে। ওর নামের পাশের সবুজ বাতিটি জানান দিচ্ছে শিহাবের উপস্থিতি । ওরা দু'জন চাইলেই এখনই কথা বলতে পারে মেসেঞ্জার, হোয়াটস অ্যাপে, অডিও কল, ভিডিও কল, চ্যাটিং ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠতে পারে দু জনের মধ্যে। ওদের বন্ধু-বান্ধব বা পরিচিত মহলে এ ধরনের সম্পর্ক এখন অনেক ঘরে ঘরেই। কিন্তু ওরা সেটি কখনও করেনি, আজও করবে না। কারণ ওরা দু’জনেই জানে, ভালবাসা মানে শুধুই তাকে নিজের করে পাওয়া নয়। ভালবাসা মানে, তুমি ভালো আছো তো? যেখানেই থাক, যেভাবেই থাক, তুমি ভালো থেক। ভালোবাসা মানে পবিত্রতা, ভালোবাসা ভালোবাসাই ।

শিহাবকে এখন আর অনলাইনে দেখা যাচ্ছে না। অস্ট্রেলিয়াতে এখন প্রায় রাত বারোটা। শিহাব হয়তো ঘুমুতে গিয়েছে। অর্পা কানে হেডফোন লাগিয়ে শুনে,

‘দুই ভুবনের দুই বাসিন্দা

বন্ধু চিরকাল

রেল লাইন বহে সমান্তরাল’গানটি ।

অর্পার চোখের কোল বেয়ে পানি গড়িয়ে পড়ে। ঝাপসা হয়ে আসা দৃষ্টিতে অর্পা মেসেঞ্জারে আবার দেখে, আবার পড়ে শিহাবের পাঠান শেষ টেক্সটটি, ‘মিসড ইউ মার্জিনালি!’

নয়া শতাব্দী/আরআর

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ