ঢাকা, শনিবার, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১, ১৭ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

ভাঙল মিলনমেলা, নতুন বই প্রকাশে রেকর্ড

প্রকাশনার সময়: ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ২১:৩১

বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে শুধু বই নিয়ে যে মহোৎসব শুরু হয়েছিল এক মাস আগে তার সফল সমাপ্তি ঘটল। লেখক-পাঠক, প্রকাশক, শিল্পী-সাহিত্যিকদের পদচারণায় প্রতিটি দিনই মুখর ছিল বইমেলা প্রাঙ্গণ। শেষ দিনে বইমেলার যে রূপ ছিল তাকে শুধু মিলনমেলা বললে কমই বলা হয়, বলা যায় মহামিলন মেলা।

তবে এবার রেকর্ড সংখ্যক নতুন বই প্রকাশ হলেও বিক্রি হয়েছে ২০২২ সালের চেয়ে সাড়ে ৫ কোটি টাকার কম। এবার (২০২৩) বেরিয়েছে ৩ হাজার ৭৩০টি নতুন বই। বিক্রি হয়েছে প্রায় ৪৭ কোটি টাকার বই। ২০২২ সালে (৩১ দিনে) বিক্রি হয়েছিল ৫২ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই। সেবার নতুন বই বের হয়েছিল ৩ হাজার ৪১৬টি। ২০২০ সালের মেলায় ৮২ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছিল। করোনা ভাইরাস (কোভিড-১৯) মহামারির কারণে ২০২১ সালে বইয়ের বিক্রি কমে মাত্র ৩ কোটি ১১ লাখ টাকায় নেমে আসে।

মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) মেলা আয়োজক কমিটির সদস্য সচিব মুজাহিদুল ইসলাম জানান, ‘এবার নিবন্ধনকৃত মোট মোড়ক উন্মোচিত বইয়ের সংখ্যা ৭২২টি। ২০২২ সালে বাংলা একাডেমি মেলার মোট ৩১ দিনে ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছিল। এবার ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২৭ দিনে বাংলা একাডেমি ১ কোটি ২৪ লাখ টাকার বই বিক্রি করেছে। মেলায় স্থাপনকৃত আর্চয়ের পরিসংখ্যান থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দর্শনার্থীর সংখ্যা ৬৩ লাখ ৫৩ হাজার ৪৬৩ জন।

মেলা সচিব দাবি করে বলেন, ‘পুরো বইমেলার প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ৪৭ কোটি টাকার বই বিক্রি হয়েছে। তবে এটা প্রকৃত চিত্র বলা যাবে না। কারণ অনেক প্যাভিলিয়ন তাদের বিক্রির তথ্য দেয়নি। আবার অনেক প্যাভিলিয়নের বই বিক্রির তথ্য গ্রহণযোগ্য মনে হয়নি।’

আটাশ দিনের বইমেলা শেষে ১ মার্চ (বুধবার) থেকেই বাংলা একাডেমিতে নেমে আসবে সুনসান নীরবতা। শেষ দিনেও মেলায় প্রবেশ করতে হয়েছে দীর্ঘ লাইন দিয়ে। এদিন বাংলা একাডেমির বিক্রয়কেন্দ্রে দীর্ঘ লাইন চোখে পড়ে। পাঠকরা নতুন বইয়ের তালিকা হাতে নিয়ে স্টলে স্টলে গিয়ে কিনেছেন পছন্দের বইটি। কেউ এসেছিলেন শেষবারের মতো মেলা প্রাঙ্গণে ঘুরতে। মেলার সমাপনী দিনে মেলার প্রবেশদ্বার খুলে যায় বিকাল ৩টায়।

এবারের মেলা প্রসঙ্গে কথা হয় বিশিষ্ট কয়েকজনের সঙ্গে। প্রখ্যাত শিশুসাহিত্যিক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল বলেন, ‘বইমেলা তো শুধু আর বইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, এটি এখন জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে। প্রাণের টানেই সবাই আসে। পাঠকদের সন্তুষ্ট রাখা বেশ কষ্টকর। তারপরও চেষ্টা করে চলেছি পাঠকদের সন্তুষ্ট রাখতে।’

জনপ্রিয় কথাশিল্পী ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘সত্যিই মনটা খারাপ। আবার এমন একটি প্রাণোচ্ছল মেলার জন্য সারা বছরই অপেক্ষায় থাকব।’

অন্যপ্রকাশের প্রধান নির্বাহী মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘একুশে বইমেলা এ দেশের সাংস্কৃতিক জাগরণকে ক্রমাগত সংহত ও শাণিত করে তুলছে। এ মেলাকে কেন্দ্র করে সৃজনশীল প্রকাশনা জগতে গড়ে উঠছে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। পাশাপাশি গড়ে উঠছে বিশাল পাঠক সমাজ। সাহিত্য ও সৃজনশীল চিন্তাচেতনার যারা নিরন্তর সাধক, তাদের সংখ্যাও ক্রমেই বাড়ছে।’

বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক মুহম্মদ নূরুল হুদা বলেন, ‘মেলার সাফল্য নিয়ে আমরা অভিভূত। সবার সহযোগিতায়ই এমন সফল সমাপ্তি ঘটেছে। বইমেলাকে আরও আকর্ষণীয় করার জন্য সব মহলের পরামর্শ গ্রহণ করা হবে বলে তিনি জানান।’

এবারের মেলার মূল প্রতিপাদ্য ছিল- ‘পড়ো বই গড়ো দেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ’। পরপর দুই বার ভার্চুয়ালি উদ্বোধনের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সশরীরে ১ ফেব্রুয়ারি বইমেলা উদ্বোধন করেন। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারপ্রাপ্ত ১৫ জন লেখকের হাতে পুরস্কার তুলে দেন। এদিন বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত উল্লেখযোগ্য ৭টি বইয়ের মোড়ক উন্মোচনও করেন তিনি। বইগুলোর মধ্যে ছিল শেখ হাসিনা সম্পাদিত শেখ মুজিবুর রহমান রচনাবলি (প্রথম খণ্ড), রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ রচিত ‘আমার জীবননীতি আমার রাজনীতি’ এবং সেলিনা হোসেন ও মুহম্মদ নূরুল হুদা সম্পাদিত ‘জেলা সাহিত্যমেলা ২০২২ (প্রথম খণ্ড)।’

এবার বাংলা একাডেমি ও সোহরাওয়ার্দী উদ্যান মিলে ৬০১টি প্রতিষ্ঠানকে ৯০১ ইউনিটের স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। বাংলা একাডেমিসহ ৩৮টি প্রতিষ্ঠান উভয়প্রান্তে প্যাভিলিয়ন বরাদ্দ পায়। এক ইউনিটের ৩২৮টি, দুই ইউনিটের ৩২২টি, তিন ইউনিটের ১৫৯টি এবং চার ইউনিটের ৯২টি স্টল বরাদ্দ দেয়া হয়। শিশুদের জন্য ৭১টি প্রতিষ্ঠান ১১১টি ইউনিটের স্টল বরাদ্দ পায়। প্রতি শুক্র ও শনিবার বেলা ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত ছিল শিশু প্রহর।

করোনা ভাইরাসের (কোভিড-১৯) বিরূপ পরিস্থিতি না থাকার কারণে বাংলা একাডেমির পক্ষ থেকে শিশু-কিশোরদের জন্য আবৃত্তি, সংগীত ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল এবং বিজয়ীদের আনুষ্ঠানিকভাবে পুরস্কৃত করা হয়েছে। অন্যবারের মতো এবারও শিশু চত্বরে সিসিমপুর আয়োজিত অনুষ্ঠানাদি শিশুরা উপভোগ করে। মোট ১৬০টি লিটল ম্যাগাজিনকে স্টল দেয়া হয়। এবার নীতিমালা অমান্য করে স্টলের কাঠামো বানানোর কারণে ৩টি প্যাভিলিয়নকে সতর্ক করে পত্র দেয়া হয়। সুস্পষ্ট কিছু নীতি ভঙ্গ করায় মেলা শুরুর প্রথম দিকে ৯টি এবং পরে আরও ৮টি প্রতিষ্ঠানকে কঠোর সতর্কতামূলক পত্র দেয়া হয়। পরে অঙ্গীকারনামা দেয়ায় তাদের স্টল চালু রাখার অনুমতি দেয়া হয়।

মেলা শুরুর প্রথম পর্যায়ে নীতিমালা ভঙ্গের কারণে দুটি প্রতিষ্ঠানের দুটি বই কমিটি কর্তৃক নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় এবং আরও একটি বইয়ের প্রচারণা না করার জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে পত্র দেয়া হয়। বইমেলার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানকে ৩টি অংশে ভাগ করে নামকরণ করা হয়। শেখ রাসেল শিশু চত্বর, বঙ্গমাতা চত্বর এবং বঙ্গবন্ধু চত্বর। বাংলা একাডেমি অংশকে চিত্তরঞ্জন সাহা চত্বর নামে নামকরণ করা হয়। বইমেলায় অন্যবারের তুলনায় বেশি হারে ডিজিটাল ও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা প্রদান করা হয়েছে।

গুণীজনদের স্মৃতিতে একাডেমি এবার বইমেলায় চারটি পুরস্কার প্রদান করেছে। এগুলো হলো- চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার, মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার, রোকনুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার এবং শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার।

মেলার শেষ দিন মঙ্গলবার (২৮ ফেব্রুয়ারি) নতুন বই এসেছে ২৬৭টি। এদিন লেখক বলছি অনুষ্ঠানে নিজেদের নতুন বই নিয়ে আলোচনা করেন বাদল সৈয়দ, সালাহ উদ্দিন মাহমুদ, সৌম্য সালেক এবং পলি শাহিনা। এদিন সমাপনী অনুষ্ঠানে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন একাডেমির মহাপরিচালক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা। প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন ‘অমর একুশে বইমেলা ২০২৩’-এর সদস্য সচিব ডা. কেএম মুজাহিদুল ইসলাম। প্রধান অতিথি ছিলেন সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদ। ধন্যবাদ সূচক বক্তব্য রাখেন বাংলা একাডেমির সচিব এএইচএম লোকমান। সভাপতিত্ব করেন বাংলা একাডেমির সভাপতি কথাশিল্পী সেলিনা হোসেন।

এ সময় সেলিনা হোসেন বলেন, ‘বাংলা একাডেমি আয়োজিত অমর একুশে বইমেলা আমাদের জাতীয় জীবনে বড় একটি দিগন্ত। বই পাঠের মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের তরুণদের মধ্যে মানবিক দর্শন জাগ্রত হবে এবং বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হবে।’

অনুষ্ঠানে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২, কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ এবং অমর একুশে বইমেলা ২০২৩ উপলক্ষে বিভিন্ন গুণীজন স্মৃতি পুরস্কার প্রদান করা হয়। ক্যারোলিন রাইট এবং জসিম মল্লিককে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্ সাহিত্য পুরস্কার ২০২২ এবং কবি মোহাম্মদ রফিককে কবি জসীমউদ্দীন সাহিত্য পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়।

সমাপনী অনুষ্ঠানে ২০২২ সালে প্রকাশিত বিষয় ও গুণমানসম্মত সর্বাধিক সংখ্যক বই প্রকাশের জন্য আগামী প্রকাশনীকে চিত্তরঞ্জন সাহা স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হয়। ২০২২ সালে প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে শৈল্পিক ও গুণমান বিচারে সেরা বই বিভাগে আহমদ রফিক রচিত বিচ্ছিন্ন ভাবনা প্রকাশের জন্য জার্নিম্যান বুকস, মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ রচিত বাংলা একাডেমি আমার বাংলা একাডেমি বইয়ের জন্য ঐতিহ্য এবং হাবিবুর রহমান রচিত ঠার : বেদে জনগোষ্ঠীর ভাষা প্রকাশের জন্য পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স লিমিটেডকে মুনীর চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়।

২০২২ সালে প্রকাশিত শিশুতোষ বইয়ের মধ্য থেকে গুণমান বিচারে সর্বাধিক গ্রন্থ প্রকাশের জন্য ময়ূরপঙ্খিকে রোকনুুজ্জামান খান দাদাভাই স্মৃতি পুরস্কার-২০২৩ প্রদান করা হয়। ২০২৩ সালের অমর একুশে বইমেলায় অংশগ্রহণকারী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্য থেকে নান্দনিক অঙ্গসজ্জায় সেরা প্রতিষ্ঠান হিসেবে পুঁথিনিলয় (প্যাভিলিয়ন), নবান্ন প্রকাশনী (২-৪ ইউনিট), উড়কি (১ ইউনিট)-কে শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী স্মৃতি পুরস্কার ২০২৩ প্রদান করা হয়।

নয়াশতাব্দী/এমএস

নয়া শতাব্দী ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন

মন্তব্য করুন

এ সম্পর্কিত আরো খবর
  • সর্বশেষ
  • জনপ্রিয়

আমার এলাকার সংবাদ